বঙ্গ-নিউজঃ .স্বপ্ন নিয়ের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, কারা তাঁদের অনুপ্রেরণা দেন। টেলিফোনে মোট ২০ জন কিশোর-তরুণের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। স্বপ্ন নিয়ের ফেসবুক পেজের মাধ্যমেও জানার চেষ্টা করা হয়েছে, কাকে তরুণেরা অনুপ্রেরণা বলে মনে করেন। সেখানে গতকাল দুপুর পর্যন্ত মোট ৪৭ জন মন্তব্য করেছেন। যে ছোট্ট জরিপ আমরা করেছি, তাতে সারা দেশের তরুণদের আইকন বা দৃষ্টান্তমূলক ব্যক্তিদের সবাই হয়তো উঠে আসেননি, কিন্তু এতে ভাবনার একটা দিক ধরা পড়েছে। এই ভাবনায় অনুপ্রাণিত হয়ে আরও অনেক তরুণ হয়তো নতুন করে ভাবতে পারবেন, কাদের অনুপ্রেরণায় তাঁরা এগিয়ে যাবেন।
তরুণেরাই পরিবর্তন আনেন, যুগে যুগে, কালে কালে। সেই আগুয়ান তরুণদের চেতনার ক্যানভাস রাঙিয়ে দেন যাঁরা, তাঁরাই তো তাঁদের পথপ্রদর্শক! স্বপ্ন নিয়ের পক্ষ থেকে কথা বলা হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। জানতে চাওয়া হয়েছে কাদের কাজে তাঁরা প্রভাবিত হন, কারা তাঁদের অনুপ্রেরণা।
বেশি শোনা গেছে যে নামগুলো
তরুণদের কথায় যে নামগুলো এসেছে, সেগুলো বৈচিত্র্যময়। যেমন রয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মাদার তেরেসা, নেলসন ম্যান্ডেলা, কাজী নজরুল ইসলাম; তেমনি আছেন ক্রিকেট মাঠের মাশরাফি বিন মুর্তজা থেকে ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ। দুনিয়া কাঁপানো এই ব্যক্তিত্বরা কেন তাঁদের অনুপ্রেরণা, সে কথাও শোনা হলো তাঁদের মুখেই।
কেন তারা অনুপ্রেরণা?
ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজের ছাত্রী মুন্নি আক্তার বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। মুন্নি বলেন, ‘তাঁর মতে, স্পষ্ট ভাষায় মানুষের অধিকারের কথা বলতে আর কাউকে দেখিনি।’ কুমিল্লার ইস্পাহানী পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির সুলগ্না স্নেহা বলে, ‘নেলসন ম্যান্ডেলার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন, সমাজের সব মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার যে আদর্শ তিনি তৈরি করেছেন, তা আমাকে ভীষণভাবে আন্দোলিত করে।’
ফেসবুক পেজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ মিজানুর রহমান মন্তব্য করেছেন, ‘সত্যজিৎ রায়কে আমি রোল মডেল ভাবি। তাঁর বানানো সিনেমা, লেখা উপন্যাস যত দেখি বা পড়ি, তত মুগ্ধ হই। তাঁর অসংখ্য গুণের অন্তত একটা গুণ যেন আমি ধারণ করতে পারি।’
রংপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শাহনেওয়াজ খানের আদর্শ হচ্ছেন মহান বিপ্লবী আর্নেস্তো চে গুয়েভারা। মানুষের কল্যাণ ও সুখের জন্য চের আত্মত্যাগ শাহনেওয়াজকে অনুপ্রাণিত করে। সিলেট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সাইদ যেমন ই-কমার্স সাইট আলিবাবার নির্মাতা জ্যাক মাকে রোল মডেল ভাবেন। দিনাজপুর সরকারি কলেজের রেজাউল ইসলামের আদর্শ কাজী নজরুল ইসলাম। ‘সবার ওপরে যে মানুষ সত্য, এটাই ছিল নজরুলের সাহিত্য ও জীবন-চেতনার পরম সত্য। তাই তাঁর জীবনাদর্শ সমাজে প্রতিষ্ঠা করাই আমার একান্ত ব্রত।’ বেগম রোকেয়া ও শহীদ জননী জাহানারা ইমামের কথা বলেছেন নারায়ণগঞ্জের ইফফাত রহমান। বলেছেন, ‘তাঁদের সাহস আমাকে অনুপ্রাণিত করে।’
ক্রীড়াবিদেরাও পিছিয়ে নেই
বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের মিশফাকুর রহমানের আদর্শ সাকিব আল হাসান। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের পরিশ্রমী জীবন তাঁকে অনুপ্রেরণা জোগায়। জামালপুরের ডিগ্রিরচর হেফাজ উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র তৌফিক হাসান বলেছে জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার কথা। তৌফিকের মতে, ‘বারবার ভেঙে পড়ার পরও কীভাবে উঠে দাঁড়াতে হয়, মাশরাফি ভাই সেটা শিখিয়েছেন।’ বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের ফরহাদ মৃত্তিকা দেশসেরা সার্ফার হতে চান। তাই তাঁর আদর্শ অদম্য সার্ফার বেথানি হ্যামিলটন। ‘দৃঢ়প্রত্যয়ী এই নারীর হাল না ছাড়ার মনোভাব আমাকে দারুণ অনুপ্রাণিত করে।’ মৃত্তিকা বলেন।
পরিবারের কেউ হতে পারেন দৃষ্টান্ত
শুধুই যে বিখ্যাত ব্যক্তি তাঁদের অনুপ্রেরণার উৎস, এমন নয়। গোপালগঞ্জ সরকারি কলেজের শেখ পূরবী যেমন অনুসরণ করেন তাঁর মুক্তিযোদ্ধা বাবা শেখ মিজানুর রহমানের আদর্শ। আবার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মেহেরুন মৌরী একক কোনো ব্যক্তি নন, চারপাশের যত ভালো কিছু রয়েছে, তার সবই তিনি গ্রহণ করার চেষ্টা করেন।
এ তো গেল শিক্ষার্থীদের কথা। শোনা যাক একজন শিক্ষকের কথা। সত্যিকার অর্থে কাকে রোল মডেল ভাববেন তরুণেরা। জিজ্ঞেস করেছিলাম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্র্যাকের শিক্ষক ও সংগীতশিল্পী তাহসান রহমান খানকে। তিনি বলেন, ‘প্রত্যেকে তাঁর চিন্তা ও চেতনার জায়গা থেকে পছন্দের কাউকে অনুসরণ করে থাকেন। তবে প্রথম রোল মডেল তাঁর পরিবারের কেউ হতে পারেন। বাবা কিংবা মা। তাহলেই একজন মানুষের শুরুটা ভালো হয়।’
জামিলুর রেজা চৌধুরীপছন্দের মানুষকে অনুসরণ করি
জামিলুর রেজা চৌধুরী, প্রকৌশলী ও শিক্ষাবিদ
আমরা তো ছেলেবেলা থেকে পরিবার, সমাজ বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পছন্দের মানুষকে অনুসরণ করি। তিনি হতে পারেন বাবা, শিক্ষক বা দেশ-বিদেশের বিখ্যাত কেউ। তাই আমার মনে হয়, কোনো একক ব্যক্তি কারও অনুপ্রেরণা হতে পারেন না। একেকজন মানুষের একেক ধরনের ভালো গুণ আমাদের আকৃষ্ট করে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এমনই মনে করি। আমার বেলায়, একসময় বাবাকে অনুসরণ করেছি, অনেক সময় কোনো প্রিয় শিক্ষককে অনুসরণ করতাম। যখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এলাম, এ বিষয়ে খ্যাতিমানদের অনুসরণ করা শুরু করলাম। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে যখন একটু অভিজ্ঞতা হলো, তখন চেষ্টা করতাম স্ট্রাকচারাল ডিজাইনে ড. এফ আর খানের মতো যাঁরা বিশ্বে নামকরা, তাঁদের মতো হতে। এভাবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছি। তাই তরুণদের বলব, কোনো একক ব্যক্তির জীবনের সবদিক অনুসরণ না করে কয়েকজন মানুষকে অনুসরণ করতে পারো। সবার ভালো গুণাবলির সমষ্টি নিজের পথচলায় কাজে লাগাতে পারো।
সেলিনা হোসেনশেখ মুজিব, নেলসন ম্যান্ডেলা বা ফিদেল কাস্ত্রো
সেলিনা হোসেন, কথাসাহিত্যিক
ষাটের দশকে আমাদের বেড়ে ওঠার সময়টা ছিল গণজাগরণের। সে সময়ে আমরা অনুসরণ করার মতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পেয়েছি। একটি জাতির সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, আর্থসামাজিক আন্দোলনে সারা জীবন তাঁর যে সোচ্চার অবস্থান, তরুণেরা তা অনুসরণ করতে পারে। আমাদের দেশ ও সংস্কৃতির বাইরের কারও কথা যদি বলি, আমি নেলসন ম্যান্ডেলার কথা বলব। এই বিশ্বনেতা ২৭ বছর জেল খেটেছেন। তবু তিনি হাল ছাড়েননি, মানুষের পক্ষে কাজ করেছেন। তাদের মুক্তির আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সফল হয়েছেন। তেমনি কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রোর কথা বলতে পারি। মানুষের পক্ষে থাকার জন্য তিনি ক্ষমতায় থেকেছেন। তাঁর আদর্শের জায়গায়, দর্শনের চিন্তা থেকে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করলেন। এটা একটা বিশাল দিক। তরুণেরা নেতৃত্বের জায়গায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে বঙ্গবন্ধু, নেলসন ম্যান্ডেলা বা ফিদেল কাস্ত্রোর মতো নেতাকে রোল মডেল ভাবা উচিত। তরুণেরা যদি দেশের কথা ভাবে, নিজের অস্তিত্বের কথা ভাবে, নিজের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের কথা ভাবে, তাহলে তাদের অবশ্যই নিজস্ব অবস্থানে ফিরে আসতে হবে। ধর্ম পবিত্র বিশ্বাস। ধর্ম কখনো বলেনি মানুষ হত্যা করে নিজের বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করার কিংবা নিজের দর্শনকে আলোকিত করার কথা।
বাংলাদেশ সময়: ৬:০৩:১১ ৩৭৫ বার পঠিত