বঙ্গ-নিউজ: বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িত বলে প্রমাণ রয়েছে সরকারের কাছে। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদে মদতদাতা শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন প্রফেসর গিয়াসউদ্দিন আহমেদকে বরখাস্তের পর লাইব্রেরিয়ানকেও বরখাস্ত করা হয়েছে। চাকরি হারাচ্ছেন ডিনসহ আরও ৪/৫ জ্যেষ্ঠ শিক্ষক। জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততায় ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার ও অতীশ দীপংকর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রারের প্রোফাইল (আমলনামা) সংগ্রহ করেছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা।জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানে বাধ্য হয়েই নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের তালিকা প্রণয়ন করে গোয়েন্দাদের হাতে তুলে দিচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ইতোমধ্যে ইস্টার্ন ও অতীশ দীপংকর ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের তালিকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছে। এর আগে গত ১৪ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের একটি প্রতিনিধিদল এনএসইউ ক্যাম্পাসে পরিদর্শনে গেলে কর্তৃপক্ষ জানায়, তাদের শতাধিক শিক্ষার্থী নিখোঁজ রয়েছে।
কিন্তু জামায়াতের মালিকানাধীন এশিয়ান, মানারাত, নদার্ন, ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়, ভিক্টোরিয়া, রয়েল, প্রাইম এশিয়া, আইইউবিএটি, দারুণ ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জঙ্গি সম্পৃক্ততার বিষয় এড়িয়ে যাচ্ছেন। তথ্য প্রদানের ব্যাপারে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা নানা কৌশলে সরকারি সংস্থাকে এড়িয়ে চলছেন বা সেলফোন বন্ধ রাখছেন বলে শিক্ষকরা জানিয়েছেন।
এছাড়া ব্র্যাক, ইস্ট ওয়েস্ট, আমেরিকান ইন্টা., ড্যাফোডিল, ইন্ডিপেনডেন্ট, আহছানিয়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিখোঁজ শিক্ষার্থী ও গতিবিধি সন্দেহজনক- এমন শিক্ষকদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে উদ্যোক্তা এবং শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার দায়ে ৪/৫ জন শিক্ষককে বরখাস্ত করা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে এনএসইউর ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমি এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলতে চাচ্ছি না। কারো নাম প্রকাশ করতে চাচ্ছি না। নাম প্রকাশ করলে সবাই সতর্ক হয়ে যাবে। তবে শীঘ্রই গণমাধ্যমকে বিস্তারিত জানাতে পারব।’
গত ১৭ জুলাই রাজধানীতে স্বরাষ্ট্র ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় আয়োজিত জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবিরোধী মতবিনিময় সভায় এনএসইউ উপাচার্য ঘোষণা দেন, ‘সার্জারি অপারেশনের মাধ্যমে নর্থ সাউথ থেকে জঙ্গিবাদ সমস্যা নির্মূল করা হবে। যেসব শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত, তাদের প্রতি নর্থ সাউথের পক্ষ থেকে ঘৃণা জানাচ্ছি।’
গত ১ জুলাই গুলশানের আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলকারীদের আশ্রয় দেয়ার অভিযোগে গ্রেফতার হয়ে রিমান্ডে থাকা নর্থ সাউথের স্কুল অফ লাইফ সায়েন্স অনুষদের ডিন? গিয়াস উদ্দিন আহসান (জিইউ আহসান) গত জুলাই সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় অবস্থিত বেসরকারি ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে এই সপ্তাহে গোয়েন্দা সংস্থার কাছে নিখোঁজ ছয় শিক্ষার্থীর নাম দেয়া হয়েছে। তবে এই ছয় শিক্ষার্থী জঙ্গি বা সন্ত্রাসী কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত নয় কর্তৃপক্ষ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আবুল বাশারের জীবন বৃত্তান্ত খতিয়ে দেখছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জামায়াত সমর্থক ব্যক্তির তৎপরতায় প্রায় দেয় মাস আগে মানারাত ইন্টা. ইউনিভার্সিটি ছেড়ে ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেয় আবুল বাশার।
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির (এনএসইউ) উপ-উপাচার্যকে বরখাস্তের পর শিক্ষার্থীদের জঙ্গি কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ করার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান ড. মোস্তাফিজুর রহমানকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। দু’একদিনের মধ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও চার-পাঁচজন শিক্ষকের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল ও তাদের পদত্যাগে বাধ্য করার সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনএসইউ ট্রাস্টি বোর্ডের একজন সদস্য জানিয়েছেন, ‘বিজনেস অনুষদের ডিন প্রফেসর মাহবুবুর রহমান, প্রফেসর হান্নান মিয়া, ড. জসিম উদ্দিন আহমেদ ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক ড. আবুল এল হক ও ড. আউয়ালের বিরুদ্ধে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে ও রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত থাকার অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এরা চাকরি হারাতে পারেন।’
নিজেদের ছয়জন শিক্ষার্থীর নিখোঁজের তথ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছে অতীশ দীপংকর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও গোয়েন্দা সংস্থা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার সোহেল আল বিরণীর আমলনামাও খতিয়ে দেখছে, যার বাবা পাবনা জেলা জামায়াতের আমীর। সোহেল আল বিরণী ক্যাম্পাসে বসেই ইসলামী ছাত্রশিবিরের কার্যক্রম পরিচালনা করেন বলে একাধিক শিক্ষক জানিয়েছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪/৫ জন জামায়াতপন্থি শিক্ষকের ব্যাপারেও তীক্ষ্ন নজরদারি করছে সরকারি সংস্থা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অতীশ দীপংকর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও সাবেক উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. আবুল হোসেন সিকদার বলেন, ‘পাঁচ-ছয়জন শিক্ষার্থী ৩/৪ মাস ধরে ক্যাম্পাসে আসছে না, এর মানে এই নয় যে তারা জঙ্গি। কেন এসব শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে আসছে না, সে বিষয়টি খতিয়ে দেখছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।’
ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য আবুল কাশেম হায়দার বলেন, ‘অসুস্থতাসহ নানা কারণে কিছু শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকতে পারে। এর মানে সবাই জঙ্গি নয়।’ তাহলে গোয়েন্দাদের কাছে কেন ছয় শিক্ষার্থীর নাম দেয়া হয়েছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তা জানা নেই।’
ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির দু’জন শিক্ষক বলেন, ‘বহিরাগত ছেলেরা প্রায়ই ক্যাম্পাসে ঢুকে উসকানিমূলক লিফলেট বিলি করে। শিক্ষার্থীরা এগুলোর প্রতিবাদ করলে তাদের জোরপূর্বক ক্যাম্পাসের বাইরে নিয়ে মারধর করা হয়। অতীতে ছাত্রশিবির করেছেন এমন ৪/৫ জন লিফলেট বিলিকারীদের সহযোগিতা করতো। কিন্তু সম্প্রতি সিসি ক্যামেরা লাগানোর ফলে ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের আনাগোনা কিছুটা কমেছে।’
গত ১ জুলাই রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় ও ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে হামলা চালায় জঙ্গিরা। এই হামলায় অংশ নেয়া দুই জঙ্গি নিবরাস ইসলাম ও আবির রহমান নর্থ সাউথের সাবেক শিক্ষার্থী। কয়েক বছর আগে থেকেই বিভিন্ন সময় জঙ্গি হামলাতেও এই বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীর নাম আলোচনায় আসে। নর্থ সাউথের শিক্ষকদের বিরুদ্ধেও জঙ্গিদের সহযোগিতা করার অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
বাংলাদেশ সময়: ২২:৩৭:৫৩ ৪৪৪ বার পঠিত