বঙ্গ-নিউজ:আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অধীনে কাজ করেছেন। কলকাতায় তার জনপ্রিয়তা কতটুকু, তখনো ‘সোনালী কাবিন’ বাংলাদেশে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি, কলকাতায় ছোট্ট সাইজের বই বেরিয়ে গেল সনেট সিকোয়েন্স নিয়ে।
তার সম্পর্কে আমার বন্ধু কবি-সমালোচক, সম্পাদক উত্তম কুমার দাশ লিখেছিলেন, তীব্র আবেগময় হলেও এ ধারার কবিতা স্থাপত্য ধর্মী
তোমার হাতে ইচ্ছে করে খাওয়ার
কুরুলিয়ার পুরনো কই ভাজা,
কাউয়ার মতো মুন্সী বাড়ির দাওয়ায়
দেখবো বসে তোমার ঘষা মাজা
বলবে নাকি, এসেছে কোন গাঁওয়ার?
ভাঙলে পিঠে কালো চুলের ঢেউ
আমার মতো বোঝেনি আর কেউ,
তবু যে হাত মাড়িয়ে দিয়ে হাওয়ায়
শহরে পথ দেখিয়ে দিলে যাওয়ার।
এখনকার কবিতা বুঝিটুঝি না, বেশ স্মার্টভঙ্গিতে যারা বলেন, তাদের সামনে এই কবিতাটি পড়ে দেখতে পারেন। কবিতাটি কবি আল মাহমুদের লেখা, কবিতার নাম ‘তোমার হাতে’। ইচ্ছাটা খুবই সামান্য, মাছ ভাজা খাওয়া, ফাউ হিসেবে যে আগ্রহ ব্যক্ত হয়েছে, সেও এমন কিছু অসাধারণ নয়, তবে চিত্রটি অপূর্ব, কাউয়ার মতো মুন্সী বাড়ির দাওয়ায় বসে তোমার ঘষা-মাজা দেখব। আমরা তো কুত্তা-বিলাই বলি, ক’জন আর কুকুর-বেড়াল বলি? তবে লেখার সময় ঠিকই প্রমিত বাংলায়ই লিখি। তেমনি কাউয়া, না জয়নুলের কাক নয়, আল মাহমুদের- তাই কাউয়া। প্রত্যাখ্যানের বেদনা-অপমান কখন ধুয়ে মুছে গেছে। আরেকটি কবিতা পড়ুন। নাম, ‘ত্যাগে দুঃখে’।
আজকাল চোখে আর অন্য কোন স্বপ্নই জাগে না।
কবিতার কথা বুঝি, কবিতার জন্যে বহুদূর একাকী গিয়েছি
পদচারণার স্মৃতি সারাদিন দুঃখবোধ ঐকান্তিক সখ্যতা ভেঙেছে
ত্যাগে দুঃখে ভরে আছে সামান্য পড়ার ঘর
সন্তানসহ দুঃখী সঙ্গিনীর মুখ।
অবোধ বাল্যেও নাকি একটা ছোট কাপও ভাঙিনি-
আমার আম্মা প্রায়ই আমার বোনের কাছে শৈশব শোনান।
সুন্দর ফ্লাওয়ার ভাস জ্যান্ত পাখির ডানা কবিতার ছন্দ ইত্যাদি
কেন জানি বহু চেষ্টা সত্ত্বেও আমি
কিছুতেই ভাঙতে পারি না।
ক্রিশেনথিমাম নাকি ইতস্তত ছড়িয়ে লাগালে
অবশেষে উদ্যান বড় সুন্দর দেখায়। কই, আমি তো এখনও
আমার উদ্ভিদগুলো সাজিয়ে লাগাই!
শুধু কবিতায় নয়, বাংলাদেশে আল মাহমুদ কথাশিল্পী হিসেবে যেমন তেমনি নিজের লেখালেখি সম্পর্কেও তো কম লেখেননি। এই কবিতায় শৈশবকে টুং করে বাজিয়ে দিয়ে, মিষ্টি আলাপ দিয়ে শুরু করলেন, জানিয়ে দিলেন তার কবিতার বৈশিষ্ট্য, নিজের মুখেই। ঔদ্ধত্য, বেপরোয়া মনে হতেই পারে, তবে তিনি কবিতা সম্পর্কে, নিজের কবিতা সম্পর্কে বেশ ক’টি বই লিখেছেন, যা অবশ্য একই সঙ্গে আনন্দদায়ক এবং তাকে জানা-বোঝার জন্য সহায়ক। শুধু তাই নয়, এ লেখাটি উপস্থাপন করার বড় কারণ অকপট লেখা, তার নিজের নান্দনিক অভিযাত্রার পদচিহ্ন ধরা পড়েছে। তার প্রথম বইয়ের নামও ‘লোক-লোকান্তর’ এই নিয়মেরই কবিতা, একবার পড়ে দেখুন তো।
লোক-লোকান্তর
আমার চেতনা যেন একটি শাদা সত্যিকার পাখি
বসে আছে সবুজ অরণ্যে এক চন্দনের ডালে,
মাথার ওপরে নীচে বনচারী বাতাসের তালে
দোলে বন্য পানলতা, সুগন্ধ পরাগে মাখাপাখি
হয়ে আছে ঠোঁট তার। আর দু’টি চোখের কোটরে
কাটা সুপারির রঙ, পা সবুজ, নখ তীব্র লাল
যেন তার তন্ত্রে মন্ত্রে ভরে আছে চন্দনের ডাল
চোখ যে রাখতে নারি এত বন্য ঝোপের ওপরে।
তাকাতে পারি না আমি রূপে তার যেন এত ভয়
যখনি উজ্জ্বল হয় আমার এ চেতনার মণি,
মনে হয় কেটে যাবে, ছিঁড়ে যাবে সমস্ত বাঁধুনি
সংসার সমাজ ধর্ম তুচ্ছ হয়ে যাবে লোকালয়।
লোক থেকে লোকান্তরে আমি যেন স্তব্ধ হয়ে শুনি
আহত কবির গান। কবিতার আসন্ন বিজয়।
আমি এ কবিতাটি কয়েকবারই পড়েছি। ছয় দশকের মাঝামাঝি সময়ে, যখন বইটি বেরোয়, তার প্রকাশনা থেকে শুরু করে প্রকাশনা উৎসবেও যুক্ত ছিলাম। কবিতায় নাকি শব্দটির প্রয়োগ দেখলেন? না পারি অর্থে- তিন দশকের অভিভাবকদের ধমক যে খাননি। এটাই কি যথেষ্ট। আর যে মানসিকতা প্রকাশ, শুধু কি কবিতার আসন্ন বিজয়, এ দেশের নির্যাতিত, বঞ্চিত মানুষদের নয়? আল মাহমুদ প্রায়ই বলে থাকেন, কবির কাজ দেশবাসীকে স্বপ্ন দেখানো, হতাশ-ক্লান্ত চোখে আশার আলো ফোটানো। ঊনসত্তরের সেই প্রবল প্রহরে তার মতো কে শোনাতে পারেন, বৃষ্টির দোহাই বিবি, তিল বর্ণ ধানের দোহাই। এ রকম অসাম্প্রদায়িক খাঁটি বাঙালি উচ্চারণ বাঙালি কত বছর পর শুনেছিলেন?
আল মাহমুদ যে সনেট সিকোয়েন্স সৃষ্টির জন্য বাংলা কবিতায় অমর হয়ে থাকবেন, সে তার ‘সোনালী কাবিন’। ঊনসত্তর-সত্তর সালে লেখা। চট্টগ্রামের ইকবাল রোডের চিলেকোঠায় লেখা, তার কক্ষসঙ্গী ছিলেন, বাংলা লোকগানের আরেক কিংবদন্তি শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব। ছয় দফা, এগারো দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, কী প্রবল গর্জন-অভ্যুত্থান, অপর দিকে ভারতের তরাই অঞ্চলে নকশাল আন্দোলন, যার মূলে মাও সে তুংয়ের বিপ্লবী চেতনা। দশম সংখ্যক সনেটটি পড়-ন।
শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে কিরাতেরা উঠিয়েছে হাত
হিয়েনসাঙের দেশে শান্তি নামে দেখো প্রিয়তমা,
এশিয়ায় যারা আনে কর্মজীবী সাম্যের দাওয়াত
তাঁদের পোশাকে এসো এঁটে দিই বীরের তকোমা।
আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন,
পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণীর উচ্ছেদ,
এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ
যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ।
তারপর তুলতে চাও কামের প্রসঙ্গ যদি নারী
খেতের আড়ালে এসে নগ্ন করো যৌবন জরদ,
শস্যের সপক্ষে থেকে যতটুকু অনুরাগ পারি
তারো বেশী ঢেলে দেবো আন্তরিক রতির দরদ,
সলাজ সাহস নিয়ে ধরে আছি পট্টময় শাড়ি
সুকণ্ঠি কবুল করো, এ অধমই তোমার মরদ।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অধীনে কাজ করেছেন। কলকাতায় তার জনপ্রিয়তা কতটুকু, তখনো ‘সোনালী কাবিন’ বাংলাদেশে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি, কলকাতায় ছোট্ট সাইজের বই বেরিয়ে গেল সনেট সিকোয়েন্স নিয়ে।
তার সম্পর্কে আমার বন্ধু কবি-সমালোচক, সম্পাদক উত্তম কুমার দাশ লিখেছিলেন, তীব্র আবেগময় হলেও এ ধারার কবিতা স্থাপত্য ধর্মী। বাক্যবন্ধের গঠন শব্দসজ্জার সুদৃঢ় বন্ধন, এবং ছন্দের সুনিয়ন্ত্রিত রূপবিন্যাস আল মাহমুদের কবিতার বহিরঙ্গ বৈশিষ্ট্য। তার কবিতার গঠনগত বিন্যাস নৈপুণ্যেই তিনি বাংলা ভাষার বিশিষ্ট সনেট শিল্পী।
না, শুধু সনেট শিল্পীই নন, তিনি মহাকাব্য রচনায় হাত দিয়েছেন, মাত্র দুই কিস্তি পড়ার সুযোগ আমার হয়েছে। এ ছাড়াও আরো অনেক কিছু বলার আছে তার সম্পর্কে, তবে এখন নয়, অন্য কোনো সময়।
বাংলাদেশ সময়: ৬:১৫:১৭ ৫০১ বার পঠিত