বগুড়ার যন্ত্র বিজ্ঞানী আমীর হোসেন কৃত্রিমভাবে মানুষের হাত ও পা তৈরির কাজ শুরু করেছেন। তিনি তার নিজস্ব আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স সাইনটিস্ট টেকনোলজি ল্যাবরেটরিতে একাজ করে আবারো আলোচনায় এসেছেন। এর আগে তিনি জ্বালানিবিহীন গাড়ি, ইট তৈরির মেশিন, গুটি ইউরিয়া সার তৈরির মেশিন, গবাদী পশুর খাদ্য তৈরির মেশিন, ধান, ভুট্টা মাড়াই মেশিন, বীজ বপন মেশিনসহ প্রায় ৩ ডজন মেশিন উদ্ভাবন করে মানুষের মাঝে ব্যপক সাড়া জাগিয়েছিলেন।
আমীর হেসেনকে বগুড়ার মানুষ যন্ত্র বিজ্ঞানী হিসেবেই চেনেন। তার বাবার রেখে যাওয়া একটি ওয়ার্কসপের উত্তরাধিকার সূত্রে মালিক তিনি। তার আবিষ্কৃক যন্ত্রের মধ্যে কৃষি যন্ত্রপাতি বেশি। ১৯৭৮ সালে তিনি যখন ১৮-২০ বছরের টগবগে যুবক তখন তিনি তার নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি করলেন শ্যালোমেশিনের লায়নার এবং পিস্টন। সে সময় জাপান ছাড়া ওই দুইটি যন্ত্র বিশ্বের আর কোন দেশ তৈরি করেনি। এঅঞ্চলের গরীব কৃষক তাদের শ্যালোম্যানের জন্য যন্ত্র দুটো অনেক চড়া দামে কিনতে হতো। আমির হোসেনের তৈরি লায়নার এবং পিস্টন কম দামে বাজারে ছাড়ায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের ব্যবসায়ীরা তখন জাপান ছেড়ে বগুড়ার যন্ত্র কিনতে শুরু করে। প্রথম সফলতার পর আমির হোসেনকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। এক দুই করতে করতে আবিষ্কার করেন প্রায় তিন ডজন যন্ত্র। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি কৃত্রিম হাত-পা তৈরি করে তাক লাগিয়ে দিলেন বগুড়াবাসীকে। তার নিজস্ব আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স সাইনটিস্ট টেকনোলজি ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিমভাবে মানুষের হাত ও পা তৈরির কাজ শুরু করেছেন। গত ২৪জুন এক ব্যক্তির পা সংযোজনের মাধ্যমে এ কার্যক্রম শুরু করেন। তার লক্ষ্য স্বল্প খরচে খুব সহজেই যেকোন বয়সী পুরুষ ও নারীর শরীরে তার হারানো হাত ও পায়ের স্থলে কৃত্রিমভাবে তৈরি হাত-পা সংযোজনের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দেয়া।
বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনায় অনেকে হাত ও পা হারান। বিশেষ করে সাভারের রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বহু মানুষ পঙ্গু হয়। তখন থেকে আমির হোসেন এ কাজের চিন্তা করেন। গত তিন মাস আগে তিনি এ কাজ শুরু করেছেন। এ পর্যন্ত কৃত্রিম পা সংযোজনের জন্য ১০টি ডাইস এবং অন্যান্য যন্ত্রাংশ তৈরি করেছেন তিনি। তার ল্যাবে আগামী দু’মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কৃত্রিম পা সংযোজন কাজ পুরোদমে শুরু করা সম্ভব হবে। ইতোমধ্যে যে দু’জনের মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে কৃত্রিম পা স্থাপন করা হয়েছে তা সফল হয়েছে। তাদের হাঁটুর উপরে কেটে ফেলা হয়েছে। এদের একজন আখের রস বিক্রেতা রুবেল ও অন্যজন বগুড়া আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন অফিসের কর্মকর্তা অসিত কুমার মন্ডল। তাদের পা সংযোজনের আশ্বাস দিলে তারা আমির হোসেন কাছে পা স্থাপন করে নেন। প্রথমে অসিত কুমার মন্ডল নামের এক ব্যক্তির হারানো পায়েরস্থলে কৃত্রিম পা সংযোজনের কাজ করেন। তিনি ২০০৩ সালে এক দুর্ঘটনায় তার ডান পা হারান। এরপর থেকে তিনি ক্র্যাসারের সাহায্যে চলাফেরা করছেন। আগামী দেড় থেকে দুমাসের মধ্যে কৃত্রিম পা সংযোজনের কাজ শেষ হলে তিনি অনেকটা স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারবেন বলে জানান আমির হোসেন।
তিনি জানান, তার মরহুম মাতা ও পিতার নামে প্রতিষ্ঠিত মরিয়ম-আব্দুল জব্বার ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ১০জন পা হারানো ব্যক্তির পায়ে কৃত্রিম পা ফ্রি সংযোজন করে দেয়া হবে। এ ছাড়া পরবর্তীতে স্বল্প খরচে এ কাজ করবেন। টাকার অভাবে অনেক পঙ্গু মানুষ যারা বিদেশ থেকে আমদানীকৃত দামী কৃত্রিম পা ও হাত সংযোজন করতে পারেন না তাদেরকে তিনি সহযোগিতা করবেন।
আমির হোসেনের চিন্তা একটি পূর্নাঙ্গ ল্যাবরেটরি বা হাসপাতাল তৈরি করে দেশেই কৃত্রিম পা ও হাত সংযোজনের ব্যবস্থা করা। যাতে দেশের অসংখ্য মানুষ স্বল্প খরচে কৃত্রিম পা ও হাত সংযোজনের সুযোগ পাবেন। বিদেশে গিয়ে ৩০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা খরচ করা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে আমির হোসেনের প্রযুক্তি কৃত্রিম পা ও হাত সংযোজন সবার পক্ষেই সহজ হবে এবং তারা স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারবেন।
এই যন্ত্র বিজ্ঞানী মনে করেন, শুধু বাংলাদেশে নয় ভারতেও এ ধরনের ল্যাবরেটরি নেই যেখানে কৃত্রিম পা ও হাত সংযোজন করা যায়। এ ব্যবস্থা রয়েছে চীন, জার্মান, আমেরিকাসহ উন্নত রাষ্ট্রে। কৃত্রিম পা ও হাত তৈরির অন্যতম উপকরণ কার্বন ফাইবার প্লেট। দেশের বাইরে থেকে এ উপকরণ আমদানি করতে হয়। এ উপাদান শুল্ক মুক্ত আমদানি করতে পারলে বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠীর সেবা করা সম্ভব হবে।
আমির হোসেন বগুড়া শহরের কাটনারপাড়ার টিকাদার লেনের স্থায়ী বাসিন্দা। ১৮৮০ সালে দাদার কামারশালা থেকে বাবা আব্দুল জোব্বার ধলু ১৯৪০ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। আমির হোসেন শিক্ষা জীবনে ম্যাকানিক্যাল ও ইলেকট্রিক্যালে ডিপ্লোমা এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং পাস। লেখা পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ২ ঘণ্টা করে কাজ শেখা বাধ্যতামূলক ছিল আমিরের। এভাবে বাবার ওয়ার্কসপে কাজ শিখেছেন আমির হোসেন। কাজ শেখার ব্যস্ততার কারণে লেখাপড়ায় আর এগুতে পারেননি তিনি। বাবার মৃত্যুর পর কারখানার দায়িত্ব পড়ে তার ওপর। তখন থেকে শুরু হয় গবেষণা।
আমির হোসেন জানান, সরকারি সহযোগিতা পেলে বিনামূল্যে প্রতি মাসে ১০জনের কৃত্রিম হাত ও পা সংযোজন করা সম্ভব।
বাংলাদেশ সময়: ১০:১৭:০৮ ৪৪৪ বার পঠিত