বঙ্গ-নিউজঃ
সরকারি ব্যয় পর্যালোচনা কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সিপিডি বলছে, সরকারি অর্থ কীভাবে, কতটা গুণগত মান ধরে খরচ হচ্ছে, এর অর্থের সুফল কারা পাচ্ছে-এসব নিয়ে এ কমিশন গঠন করা যেতে পারে।
গতকাল রোববার আগামী অর্থবছরের বাজেট পর্যালোচনা নিয়ে সংলাপ অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধে এ সুপারিশ করা হয়েছে। রাজধানীর লেকশোর হোটেলে এ সংলাপের আয়োজন করে সিপিডি। সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইদুজ্জামানের সভাপতিত্বে এতে মন্ত্রী, সাবেক মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদেরা অংশ নেন।
সংলাপের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান। মূল প্রবন্ধে বলা হয়, আগামী অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নের বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো লক্ষ্য অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ, বরাদ্দ অনুযায়ী ব্যয় করার সক্ষমতা বৃদ্ধি, পাইপলাইনে থাকা বিদেশি সহায়তা আনা এবং সরকারি ব্যয়ের গুণগত মান নিশ্চিত করা। সিপিডির মতে, কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা জাতি এবং এর সম্ভাবনার মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কর্মসংস্থানের গতিও আগের চেয়ে কমে গেছে।
নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) আইন নিয়ে সিপিডি বলেছে, করদাতা ও আদায়কারীর এখনো প্রস্তুতি পর্যাপ্ত নয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের যে সাতটি সুপারিশ রয়েছে, এর প্রতিফলন আইনে থাকা উচিত। নতুন মূসক আইনটি ভালো। কিন্তু মূসক আরোপের ক্ষেত্রে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করলে এটা সেলস ট্যাক্সের মতো হয়ে যাবে।
তৈরি পোশাক ও অন্য পাঁচটি খাতে যে অগ্রিম উৎসে কর দশমিক ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে দেড় শতাংশ আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। সিপিডি মনে করে, এটা পুনর্বিবেচনা করা উচিত।
সিপিডি আরও বলছে, পানামা পেপারস কেলেঙ্কারির মাধ্যমে জানা যাচ্ছে, দেশ থেকে টাকা পাচারের পরিমাণ বেড়েছে। এ অর্থকে আইনের আওতায় আনতে বেনামি সম্পদ আইন প্রণয়ন ও কৃষিপণ্যের জন্য স্থায়ী কৃষি মূল্য কমিশন গঠনের সুপারিশও করেছে সিপিডি।
সিপিডির অন্য সুপারিশগুলো হলো সামরিক অর্থনীতি আরও পরিষ্কার করা, স্থানীয় সরকার বাজেটে আলাদা কিন্তু সমন্বিত করা, বিদেশি ঋণ সহায়তার নীতিমালা প্রণয়ন এবং সরকারি সম্পদের অধিগ্রহণে স্বচ্ছতা আনা। আলোচনা: সংলাপের প্রধান অতিথি পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বাংলাদেশ উন্নয়নের একটি মডেল। জিডিপির প্রবৃদ্ধির সূচক অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অর্জন সম্পর্কে সুস্পষ্ট করেছে। বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়, ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যমুক্ত এবং ২০৪০ সালের মধ্যে উন্নত ১০টি দেশের কাতারে শামিল হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি।’
অর্থ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবদুর রাজ্জাক বলেন, অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা এবং বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা। এ জন্য গ্যাস, বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হবে এবং সুদের হার কমাতে হবে। সড়ক, বন্দরসহ অবকাঠামো সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকতে হবে।
অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, সড়ক, বন্দরসহ বড় অবকাঠামো না থাকলে বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসে না। সরকার এখন এসব অবকাঠামো নির্মাণ করছে। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছে।
সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, কোন ভিত্তির ওপর এখন প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে তা দেখতে হবে। আট বছর আগেই মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। বিএনপি সরকারের আমলেই এ ধরনের প্রবৃদ্ধি অর্জনের মৌলিক সংস্কার করা হয়েছিল। তখন বেসরকারি বিনিয়োগনির্ভর প্রবৃদ্ধি হয়েছিল।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, বর্তমানে যাঁরা বাজেটের রাজস্ব নীতি ঠিক করছেন, তাঁরাই রাজস্ব আদায় করছেন। একই প্রতিষ্ঠানের এই দুটো কাজ করা ঠিক নয়।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বলেন, ব্যাংকিং খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ রয়েছে। কিন্তু সরকারের ঋণ করার প্রবণতা বেশ কম। বিনিয়োগ না হওয়ার কারণে ব্যাংকিং খাতটি শ্লথ।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, এ দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের অবজ্ঞা করা হয়। পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার ভাতা বৃদ্ধির সুপারিশ করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরুপাক্ষ পালের মতে, ব্যাংকবহির্ভূত খাতই ব্যাংকিং খাতকে আঘাত করছে। ব্যাংকবহির্ভূত অর্থায়ন কমানো উচিত।
সিডওর সাবেক চেয়ারপারসন সালমা খান বলেন, এবারের বাজেটে লৈঙ্গিক দৃষ্টিভঙ্গি নেই। অথচ ২০৩০ সালের মধ্যে সিদ্ধান্ত নারী-পুরুষের সমতা আনতে হবে।
উন্নয়ন নিয়ে বিতর্ক: সংলাপে বাংলাদেশের উন্নয়ন কি সঠিক পথেই আছে, এ নিয়ে সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর এ বিতর্ক হয়। এ বিতর্কে অংশ নেন সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইদুজ্জামানও।
পরিকল্পনামন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় বিনিয়োগ সম্পর্কে বলেন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনের চেয়ে জিডিপি-বিনিয়োগ অনুপাত বাংলাদেশের বেশি। ওই সব দেশ যদি নিম্ন বিনিয়োগ করে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন বা উন্নতি করতে পারে, তবে বাংলাদেশ কেন পারবে না? ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশে উন্নীত হবে।
পরিকল্পনামন্ত্রীর এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে এম সাইদুজ্জামান বলেন, নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছে একমাত্র দক্ষিণ কোরিয়া। উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হতে ওই দেশটি তখন শিল্প খাতে বিপুল বিনিয়োগ করেছিল। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতেও যথেষ্ট বিনিয়োগ হয়েছে। তাঁর মতে, বাংলাদেশে বিনিয়োগ সমস্যা রয়েছে। এ ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপরও তিনি জোর দেন।
পরিকল্পনামন্ত্রী বক্তব্য দিয়েই অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেন। এরপর বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘মুস্তফা কামাল সাহেবের কথা শুনে মনে হচ্ছে, ২০৪১ সালের আগে কোনো নির্বাচন হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ইদানীং অনেকে বলার চেষ্টা করেন, আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র। আমরা কি গণতন্ত্র চাই না? এ যুগে এসে কি ‘উন্নয়ন আগে, পরে গণতন্ত্র’ এ সিদ্ধান্ত নিতে হবে? যতক্ষণ গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন-এসব প্রতিষ্ঠা না হবে, ততক্ষণ বেসরকারি বিনিয়োগ হবে না।
বাংলাদেশ সময়: ১:০৮:৪০ ৪২৮ বার পঠিত