বঙ্গ-নিউজ: পছন্দমতো নির্বাচন কর্মকর্তা নিয়োগ না দেওয়ায় চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাকে স্থানীয় সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী মারধর করেছেন। এ অভিযোগ পাওয়ার পর সাংসদের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। একই সঙ্গে বাঁশখালীর সব কটি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে। গতকাল বুধবার বিকেলে কমিশনের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়।
নির্বাচন কর্মকর্তাকে মারধর করায় সাংসদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে মামলা করা হবে বলে জানান নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মামলা কে এবং কীভাবে করবে, সে বিষয়ে কমিশন সচিবালয়ের আইন শাখা থেকে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে পরামর্শ দেওয়া হবে।
এর আগে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে বরগুনা-২ আসনের সাংসদ শওকত হাচানুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করে। এ ছাড়া বিভিন্ন অভিযোগে হুইপ আতিউর রহমান আতিক, মুনিরুল ইসলামসহ কয়েকজন সাংসদকে সতর্ক করে কারণ দর্শানো নোটিশ পাঠানো হয়।
৪ জুন বাঁশখালীর ১৪টি ইউনিয়নে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। তবে গত ২৬ মে উপজেলার খানখানাবাদ, গণ্ডামারা ও ছনুয়া ইউনিয়নের নির্বাচন স্থগিত করা হয়। এই তিন ইউনিয়ন ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বাঁশখালীর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলামকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে ডেকে নেন সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। ইউএনও তখন তাঁর দপ্তরে ছিলেন না। বাঁশখালীর ইউএনও এবং নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় একই ভবনে। জানা যায়, ইউপি নির্বাচনের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও পোলিং কর্মকর্তাদের নিয়োগ নিয়ে নির্বাচন কর্মকর্তার কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সাংসদ। একপর্যায়ে ইউএনওর কার্যালয়ের দরজা বন্ধ করে নির্বাচন কর্মকর্তাকে মারধর করেন সাংসদ।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে নির্বাচন কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম গতকাল সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমপি সাহেব আমাকে ইউএনও সাহেবের কার্যালয়ে ডেকে পাঠালে আমি যাই। এরপর তিনি দরজা বন্ধ করে আমাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করেন। একপর্যায়ে আমাকে চড়-থাপ্পড় মারতে থাকেন। ভেতরে আমরা দুজনই ছিলাম। আমি চিৎকার করলে তিনি দরজা খুলে দেন। এরপর তাঁর অনুসারী আরও কয়েকজন কক্ষে প্রবেশ করেন। তাঁরাও আমাকে এলোপাতাড়ি কিল, ঘুষি ও লাথি মারতে থাকেন।’
জাহিদুল ইসলামের গালে, নাকের পাশে ও থুতনিতে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তিনি বাঁশখালী থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে গতকাল বিকেলে চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে যান।
সাংসদ কেন চড়াও হলেন, তা জানতে চাইলে জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এমপি সাহেব বাঁশখালীতে তাঁর পছন্দের প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে আমাকে চাপ প্রয়োগ করে আসছিলেন। আমি তাঁকে বলি, স্যার, জনগণ ভোট দিলে আপনার প্রার্থী জিতবে। আমি কীভাবে আপনার প্রার্থীকে জেতাব? এরপর আমার ওপর চড়াও হন তিনি।’
তবে সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমান গতকাল সন্ধ্যায় মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাহিদুল বেছে বেছে জামায়াত-শিবির ক্যাডারদের নির্বাচনী দায়িত্ব দিয়েছে। আমি অনেক অভিযোগ পেয়ে তাঁকে ইউএনও সাহেবের কার্যালয়ে ডেকে পাঠাই। এরপর ভুয়া নির্বাচন কর্মকর্তা নিয়োগের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে জাহিদুল আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। উত্তেজিত হয়েও তিনি কথা বলছিলেন। এসব নিয়ে বাগ্বিতণ্ডা হয়েছে। মারধরের ঘটনা সত্য নয়। তিনি সহানুভূতি পাওয়ার জন্য মারধরের অভিযোগ করছেন।’
সাংসদের বক্তব্যের বিষয়ে জাহিদুল ইসলাম বলেন, বাহারছড়া ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী তাজুল ইসলাম সাংসদের ব্যক্তিগত সহকারী। ওই প্রার্থী কয়েক দিন আগে তাঁর কাছে একটি তালিকা পাঠান। ওই তালিকায় যাঁদের নাম রয়েছে, তাঁদের নির্বাচনী দায়িত্ব দিতে বলেন। কিন্তু সেই তালিকা পুরোপুরি অনুসরণ না করায় সাংসদ তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ হন। তিনি বলেন, সাংসদ মারধর করার পর নিজেই দরজা খুলে দেন। এরপর সাংসদের অনুসারীরাও তাঁকে মারতে থাকেন। তখন সেখানে একজন পুলিশ সদস্যও ছিলেন। মারধর করার সময় সেই পুলিশ সদস্য তাঁর হাত চেপে ধরেন, যাতে তিনি নড়তে না পারেন। একপর্যায়ে ওই পুলিশ সদস্য তাঁকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘এমপি সাহেবের কথার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। তাঁর কথা শোনেননি কেন?’
পুলিশ সদস্যের নাম জানতে চাইলে জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ওই পুলিশের নাম জানি না। মারধর সামাল দিতে আমি ব্যস্ত ছিলাম। একপর্যায়ে আমাকে বাঁশখালী থেকে চলে যেতে বলা হয়।’
বাঁশখালীর বাহারছড়া ইউনিয়নের স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ও আওয়ামী লীগের সমর্থক এম বখতিয়ার উদ্দিন চৌধুরী গতকালের ঘটনার জন্য সাংসদ মোস্তাফিজকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে তিনি পছন্দের ব্যক্তিদের চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দিয়েছেন। আমাকে হারানোর জন্য এমপি সাহেব নির্বাচন কর্মকর্তাকে মারধর করলেন।’
এ অভিযোগের বিষয়ে বাহারছড়া ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী তাজুল ইসলামের বক্তব্য জানা যায়নি।
ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে বাঁশখালীর ইউএনও মো. শামসুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার কার্যালয়ে দুজনের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে বলে শুনেছি। তবে এসবের সত্যতা আমি যাচাই করে দেখিনি। কারণ, আমি ঘটনার সময়ে উপকূলীয় এলাকায় ত্রাণ বিতরণ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম।’
বাঁশখালীর সাংসদের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্তের বিষয়ে কমিশন সচিবালয়ের যুগ্ম সচিব (আইন শাখা) মোহাম্মদ শাহজাহান গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ইতিমধ্যে বাঁশখালীর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলমগীর হোসেনকে মামলা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মামলায় উপজেলা নির্বাচন অফিসের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে বাদী করতে বলা হয়েছে।
এদিকে ইউপি নির্বাচনে নারী, সংখ্যালঘু ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অনুরোধ জানিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছেন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব সিরাজুল ইসলাম। গত মঙ্গলবার চিঠিটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। চিঠিতে কমিশন বলেছে, সারা দেশে বিভিন্ন জায়গায় নির্বাচনী সহিংসতা হচ্ছে, যা নির্বাচনের স্বাভাবিক পরিবেশ বিঘ্নিত করছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে কি না, সে বিষয়ে কমিশনকে কিছু জানানো হয়নি।
বাংলাদেশ সময়: ১১:২১:৪৩ ৪০৪ বার পঠিত