বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তার ‘বহে জলবতী ধারা’ বইয়ে লিখেছেনÑ ‘পৃথিবীর যারা শ্রেষ্ঠ মানুষ, হজরত মুহাম্মদ (সা.), যিশুখ্রিস্ট, গৌতমবুদ্ধ কিংবা শেকসপিয়র, দান্তে, হোমার, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, নিউটন, আইনেস্টাইন, শেখ সাদীÑ আসলে শেষ বিচারে এরা কারা? এরা তো শিক্ষকই। মানবজাতির শিক্ষক। তাহলে শিক্ষকের চেয়ে বড় কে?’ সত্যিই শিক্ষকের চেয়ে বড় কেউ নেই। আর এই সত্য জেনে এসেছি ছোটবেলা থেকে, যখন গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম। স্কুলটা আমাদের বাড়ি থেকে চার-পাঁচ মিনিটের হাঁটার দূরত্বে ছিল। বাড়ির পাশ দিয়ে দলে দলে ছেলেমেয়েরা কাসে যেত। সেই হিসেবে আমার স্কুলমুখী হওয়াটা কঠিন কোনো বিষয় ছিল না। কিন্তু ভয় ছিল একটাইÑ তা হলো ‘আনোরালী স্যার’। স্যারের নামটা মূলত আনোয়ার আলী নাকি, সেটা ওই বয়সে তো জানা সম্ভব হয়নি, এখনো জানি না। তখন কাসে একাধিক বেত নিয়ে যাওয়ার অনুমতি ছিল। কিন্তু আনোরালী স্যারকে বেত হাতে দেখেছি খুব কমই। তার চেহারাটাই ছিল একটা বেত। দেখলেই কলিজা শুকিয়ে যেত। আর গলার স্বর এমন বজ্রগম্ভীর ছিল, কিছু বললে শরীরে কাঁপুনি উঠে যেত। যাহোক, কয়েকদিন স্কুলে যাওয়ার পর একদিন মাকে বললামÑ আমি আর যাব না। আনোরালী স্যারকে ভয় লাগে। কেন ভয় লাগে তার কারণ ব্যাখ্যা করতে না পারলেও মা আমার সমস্যাটা বুঝলেন। আব্বা বাড়িতে ফেরার পর বিষয়টা খুলে বলে তিনি তাকে অনুরোধ করলেন, আনোরালী স্যারের সঙ্গে যেন কথা বলেন। আব্বা চমকে উঠলেনÑ ‘কী কথা বলব?’ মা বললেনÑ ‘বাচ্চাকাচ্চারা তার গলার স্বর শুনলেই ভয় পায়। তাকে একটু বলবেন যাতে ওদের সঙ্গে একটু নরম গলায় কথা বলেন।’ আব্বা এবার রেগে গেলেনÑ ‘শিক্ষক কীভাবে ছাত্রের সঙ্গে কথা বলবেন, সেটা আমি শিখিয়ে দেব? শিক্ষককে আমি শেখাতে যাব? তুমি কি চাও শিক্ষকের সঙ্গে আমি বেয়াদবি করি?’ আব্বার এই কথাগুলো সেই পাঁচ-সাড়ে পাঁচ বছর বয়সেই আমার মনে দারুণভাবে দাগ কেটেছিল। আমার মনে তখনই এই বিশ^াস তৈরি হয়েছিল, শিক্ষকরা যা করবেন, যা বলবেন, তাই সঠিক। তাদের কিছু বলতে বা বোঝাতে যাওয়াটা বেয়াদবি। বছরদশেক আগে যখন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হলাম, কেন যেন খুব ইচ্ছে হলো আনোরালী স্যারের সঙ্গে দেখা করি। ছোটবেলায় তার গম্ভীর চেহারা দেখে এক মুহূর্তের জন্য হলেও যে তাকে অপছন্দ করেছিলাম, এর জন্য ক্ষমা চাই। গ্রামে গেলাম। পরদিন স্যারের বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে স্যারের ছেলের সঙ্গে দেখা হলে জানতে পারি মাসখানেক আগে স্যার মারা গেছেন। স্যারের মৃত্যুর খবর শুনে সেদিন স্বাভাবিক থাকতে পারিনি। কেঁদে ফেলেছিলাম। আনোরালী স্যারের মৃত্যুর খবরের চেয়ে শ্যামল কান্তি স্যারের অপমানিত খবরটি কোনো অংশেই কম বেদনার ছিল না। কিন্তু এ খবর আমার চোখে পানি আনেনি। বরং আমি বিস্মিত হয়েছি, বাকরুদ্ধ হয়েছি। রাজনীতি করার তো অনেক বিষয় আছে। সাধারণ একজন শিক্ষককে নিয়ে কেন রাজনীতি করতে হবে? কেন তাকে মারপ্যাঁচে ফেলে অপদস্থ করতে হবে? আমার এই প্রশ্নগুলো যে অমূলক, সেটা পাঠক যেমন বোঝেন, আমিও বুঝি। কারণ যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। তবে যেটি হয়নি, তা হলোÑ অপরাধীর বিচার। হ্যাঁ, বিচার এতটুকুই হয়েছে, স্কুল কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। যদি প্রকৃত অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিয়ে কেবল কমিটি ভেঙে দেওয়ার শাস্তিটুকু দিয়েই দায়িত্ব শেষ বলে মনে করা হয়, তাহলে ব্যাপারটা হবে পুরনো একটা গল্পের মতো। এক লোক তার বউকে এমন পেটানো পেটাল যে, শেষ পর্যন্ত বউটা মারাই গেল। কিন্তু এই লোকের মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। সদম্ভে এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। নিহত বউয়ের বাপ-ভাইয়েরা সালিশ ডাকল। সালিশে বসল গ্রামের মাথারা। মাথাদের আবার বিশেষ দরদ ছিল লোকটার ওপর। সালিশের শুরুর দিকে তারা বেশ গালমন্দ করল লোকটাকে। মাঝের দিকে এসে তাদের গলার স্বর নরম হয়ে এলো। আর শেষদিকে এসে মাথাদের একজন সিদ্ধান্ত দিলÑ যেহেতু এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, সে তার বউকে নিজহাতে হত্যা করেছে, তাই তার ঘরের আলমারির চাবি কেড়ে নেওয়া হবে। বাদীপক্ষ বিস্ময় প্রকাশ করলÑ আলমারির চাবি কেড়ে নিলে কী হবে? জবাব এলোÑ আলমারির ভেতর গহনা আছে, শেরোয়ানি আছে। আলমারির চাবি কেড়ে নেওয়া হলে সে গহনা-শেরোয়ানিও বের করতে পারবে না, আরেকটা বিয়েও করতে পারবে না। বাদীপক্ষ হায় হায় করে উঠলÑ এটা কী ধরনের বিচার! গ্রামের মাথারা এই বলে দ্রুত কেটে পড়ল যে, তাদের অন্য জায়গায় সালিশ আছে। শ্যামল কান্তি চাকরি ফেরত পাওয়ার পাশাপাশি সম্মানও ফেরত চেয়েছেন। কিন্তু যেভাবে তার সম্মান কেড়ে নেওয়া হয়েছে, এরপর কি সেটা আর ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব? নিশ্চয়ই নয়। তবে দেশের মানুষ যদি এক কাতারে দাঁড়ায়, তাহলে তিনি অন্তত সান্ত¡নাটুকু পেতে পারেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, এখানেও আমরা বিভক্ত। কেউ কেউ তো প্রকাশ্যেই বলছেন, সংসদ সদস্য যা করেছেন তা ঠিকই করেছেন। নইলে ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী নাকি তাকে মেরেই ফেলত। কিন্তু আমরা এই নেতিবাচক কথাগুলো শুনতে চাই না। কোনো বিভাজন দেখতে চাই না। আমরা চাই সঠিক বিচার। যেন বাদশাহ আলমগীরের পুত্রকে পড়ানো সেই শিক্ষকের মতো শ্যামল কান্তিও উচ্চকণ্ঠে বলতে পারেনÑ ‘আজ হতে চির উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির…।’
বাংলাদেশ সময়: ১৪:৩৯:১৪ ৫২৪ বার পঠিত