বঙ্গ-নিউজঃতথ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে মানব সভ্যতার ব্যাপক উন্নতি সাধন হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই অগ্রগতিকে কাজে লাগিয়ে উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নিজেদের অর্থনীতিকে করেছে সমৃদ্ধ। পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। আর এই অগ্রগতিকে সামনে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন তথ্য প্রযুক্তির সঙ্গে ক্ষুদে ও তরুণ শিক্ষার্থীদের সখ্যতা। সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ৮ম বারের মতো চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো বিজ্ঞান, শিল্প ও প্রযুক্তি মেলা।
বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগার (বিসিএসআইআর) চট্টগ্রাম গত ২০ থেকে ২২ মার্চ তিনদিনব্যাপী এই মেলার আয়োজন করে। এতে দারুণ উৎসাহ-উদ্দীপনায় অংশ নিয়েছে এক ঝাঁক ক্ষুদে ও তরুণ শিক্ষার্থী। যাদের বলা চলে ক্ষুদে বিজ্ঞানীও।
মেলায় অংশ নেয়া ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের স্বপ্ন যেন আকাশ ছোঁয়া। দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কিছু করার ভাবনা প্রতিনিয়ত তাড়িত করে তাদের। হয়তো সুযোগ হয়ে ওঠে না বলেই তা প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। অবশেষে তাদেরকে সেই সুযোগটি করে দিয়েছে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগার (বিসিএসআইআর) চট্টগ্রাম।
বিসিএসআইআর প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত এই মেলায় চট্টগ্রামের ১৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানভিত্তিক ১০৬টি প্রজেক্ট উপস্থাপন করে। নিজেদের মেধা ও শ্রম দিয়ে তৈরি প্রজেক্টগুলো শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী চিন্তারই বহিঃপ্রকাশ। যার মধ্য দিয়ে তারা জানান দিয়েছে, সুযোগ পেলে তারাও পাল্টে দিতে পারে বিশ্বকে। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশের জন্য, বিশ্বের জন্য তারাও আবিষ্কার করতে পারেন নতুন কিছু।
যা এর আগে কেউ ভাবেনি, আবিষ্কারও করেনি। এমনই ১০৬টি প্রজেক্ট নিয়ে জমে উঠেছিলো মেলা। যা দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে দর্শনার্থীরা। ক্ষুদে শিক্ষার্থী, শিক্ষক-অভিভাবক থেকে শুরু করে বাদ যায়নি ছোট্ট শিশুটিও। একটির পর একটি ষ্টল ঘুরেছেন আর বিস্ময় ভরা চোখে ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের কাছে বর্ণনা শুনেছেন। ক্ষুদে বিজ্ঞানীরাও উৎসাহ নিয়েই প্রজেক্টের খুঁটি-নাটি ব্যাখ্যা করেছেন দর্শনার্থীদের কাছে।
ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের প্রযুক্তিগুলো: যানবাহন ও শিল্পকারখানা থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ায় প্রতিনিয়ত বিষাক্ত হচ্ছে পরিবেশ। অলিগলি থেকে শুরু করে গোটা শহর এখন এই বিষাক্ত বায়ুতে বিপর্যস্ত। মুক্ত নিঃশ্বাস নেয়ার জায়গাটুকুও যেন নেই। বাতাসে মিশতে না দিয়ে রিসাইকেলের মাধ্যমে এই বিষাক্ত ধোঁয়া থেকে লবণ ও পানি উৎপাদন করার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন সাউথ এশিয়ান কলেজের একাদশ শ্রেণির দুই শিক্ষার্থী।
৪ বছর আগে ঘুমের মধ্যে এই প্রজেক্টটি নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন শোয়েব সাইদ। সুযোগ পেয়ে সহপাঠী অনির্বান দাশ বর্মনকে নিয়ে প্রকল্পটির একটি মডেল (রুপরেখা) তৈরি করেছেন এই ক্ষুদে বিজ্ঞানী। তাদের এই প্রজেক্টটির নাম দেয়া হয়েছে ‘ফ্লোয়িং গ্যাস রিসাইকেল প্রজেক্ট’।
দৈনন্দিন জীবনে সাবান আমাদের অনেক কাজে লাগে। সাবান তৈরির প্রযুক্তি নিয়ে এসেছেন বিএন স্কুল এন্ড কলেজের দুই ক্ষুদে শিক্ষার্থী। আফরি রহমান ও কাজী রোবায়েত জাহান নামের অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া দুই ক্ষুদে বিজ্ঞানী উপস্থাপন করেন কীভাবে সাবান তৈরি করা যায়। ইঞ্জিন চালিত বোট চালাতে তেলের প্রয়োজন পড়ে। রেডিয়েন্ট স্কুলের দুই ক্ষুদে বিজ্ঞানী নিয়ে এসেছেন সোলার বোট প্রজেক্ট।
প্রজেক্ট সম্পর্কে বলতে গিয়ে দশম শ্রেণি পড়ুয়া সাইফুল আলম সাকিব ও মাসুম ইবনে সৈয়দ জানায়, সোলার বোট হবে সোলার বিদ্যুতে চালিত বিশেষায়িত শ্রেণির বোট। যাতে তেলের প্রয়োজন হবে না। এতে করে তেলের ব্যবহার কমবে। পাশাপাশি খরচও অনেক কমে যাবে।
এছাড়াও কেউ এসেছে যানজট বিহীন নগরী গড়ার প্রকল্প নিয়ে। ভূমিকম্প থেকে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যাবে তারই উপায় সন্ধান করেছে কেউ। জ্বালানি বিহীন গাড়ি চালানোর কৌশলও উপস্থাপন করেছে কেউ। আবার বাতাস থেকে বিদ্যুৎ উদ্ভাবন, গ্যাস সাশ্রয় পদ্ধতি, আবর্জনা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কীভাবে সম্ভব তাও দেখাতে চেয়েছে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া এসব ক্ষুদে বিজ্ঞানী।
বিজয়ী হলো যে প্রকল্পগুলো: মেলায় ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের তিনটি বিভাগে বিভক্ত করা হয়। ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণি ‘এ’, নবম ও দশম শ্রেণি ‘বি’ এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিকে ‘সি’ বিভাগে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই তিন বিভাগ থেকে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিসেবে মোট নয়টি প্রজেক্টকে বিজয়ী ঘোষণা করে এর উদ্ভাবনকারীদের ক্রেষ্ট ও সনদপত্র প্রদান করা হয়।
কলেজ পর্যায়ে প্রথম স্থান লাভ করে সাউথ এশিয়ান কলেজের তিন শিক্ষার্থীর উদ্ভাবনকৃত ‘গাছের হাতে গাছের জীবন, পোকার মরণ’ শীর্ষক প্রজেক্টটি। প্রজেক্টটির মডেল তৈরি করেছেন আতিফা সুলতানা, জান্নাতুল ফেরদৌস ও উর্মি দাশ। তারা জানায়, বীজ থেকে চারা জন্মানোর আগেই তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো এবং পরিবেশ বান্ধব কীটনাশক ব্যবহার করে পোকা-মাকড়ের হাত থেকে গাছকে রক্ষার মডেলটি উপস্থাপন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে খরচও কমবে। যার ফলে পরিবেশ বান্ধব পদ্ধতিতে কৃষকের ঘরে স্বচ্ছলতা আসবে। সর্বোপরি কৃষিক্ষেত্রে প্রভূত উন্নয়ন ঘটবে।
দ্বিতীয় হয়েছে বিজ্ঞান ক্লাবের দুই শিক্ষার্থীর উদ্ভাবনকৃত ‘সেলফোন কন্ট্রোলার রোবট’ শীর্ষক প্রজেক্ট। এর মডেল তৈরি করেছেন একাদশ শ্রেণির হাসান মুরাদ ও আব্দুল্লাহ আল আদনান। চট্টগ্রাম বিজ্ঞান কলেজের দুই শিক্ষার্থী মো. আশফাকুর রহমান ও মিজানুর রহমানের উদ্ভাবনকৃত ‘ম্যাজিক অব রিফ্লেকশন’ প্রজেক্টটি তৃতীয় স্থান অর্জন করে।
নবম ও দশম শ্রেণি পর্যায়ে প্রথম হয় চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের দুই শিক্ষার্থী মুজতাহিদ জামান ও রাফা নানজেবার উদ্ভাবনকৃত ‘ম্যাকিং সিমেন্ট আউট অব এ্যাশ’ প্রজেক্টটি। ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ স্কুল এন্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী মো. তাসনিমুল নেহাল সাকিব ও মো. মাইনুল হাসান অনিকের উদ্ভাবনকৃত ‘দ্যা এয়ারগান’ প্রজেক্টটি দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে। তৃতীয় হয় বিসিএসআইআর ল্যাবরেটরী হাই স্কুলের দুই শিক্ষার্থী মো. নুর আলম ও মো. শাহিদুল ইসলামের তৈরি ‘ডিজিটাল লাইটিং এন্ড চার্জিং সিস্টেম’ শীর্ষক প্রজেক্টটি।
অন্যদিকে ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যায়ে প্রথম হয় বিএএফ শাহীন কলেজের দুই শিক্ষার্থী মেহেদী আল মর্তুজা ও পিনাক চক্রবর্তীর তৈরি ‘ইনক্রেজিং পাওয়ার অব সোলার প্যানেল’ প্রজেক্ট। দ্বিতীয় হয় রেডিয়েন্ট স্কুল এন্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির দুই শিক্ষার্থী মোবথাসিম ফারহান চৌধুরী ও মামুনুর রশিদের তৈরি ‘মোবাইল ফোনের মাধ্যমে লাইট বা ফ্যান নিয়ন্ত্রণ’ এবং ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ স্কুল এন্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির দুই শিক্ষার্থী নওশীন রাসেল ও তাসফিয়া তাবাসসুমের তৈরি ‘বন্যার পানি পরিমাপের যন্ত্র’ শীর্ষক প্রজেক্টটি তৃতীয় স্থান অর্জন করে।
অংশগ্রহণকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: এবারের মেলায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশ নৌবাহিনী স্কুল এন্ড কলেজ, ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ স্কুল এন্ড কলেজ, চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ, সায়েন্স ক্লাব, চট্টগ্রাম বিজ্ঞান কলেজ, কূলগাঁও সিটি কর্পোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়, চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট উচ্চ বিদ্যালয়, বিসিএসআইআর ল্যাবরেটরী উচ্চ বিদ্যালয়, চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউট, বিএএফ শাহীন কলেজ, সেন্ট প্লাসিড উচ্চ বিদ্যালয়, রেডিয়েন্ট উচ্চ বিদ্যালয়, সাউথ এশিয়ান কলেজ, ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, সেন্ট স্কলাস্টিকা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, সানোয়ারা ইসলাম বালক উচ্চ বিদ্যালয়, বে ভিউ স্কুল ও পাঁচলাইশ এস এম নাছির উদ্দিন সিটি কর্পোরেশন মহিলা কলেজ।
বাংলাদেশ সময়: ১৯:৪৪:১০ ৭৫৩ বার পঠিত