প্রিয় লেখক ও চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়। ছোটদের জন্য দারুণ সব গল্প-উপন্যাস লিখেছেন তিনি। ফেলুদা, প্রফেসর শঙ্কুর মতো চমকপ্রদ চরিত্র তো তাঁরই সৃষ্টি। আগামীকাল এই কিংবদন্তির মৃত্যুবার্ষিকী। নিজের ছেলেবেলার নানা অভিজ্ঞতা থেকে তিনি যখন ছোট ছিলাম নামে একটা বই লিখে গেছেন। তাঁর স্মরণে আজ চলো সেই বই থেকেই খানিকটা অংশ পড়ে নেওয়া যাক।
ছুটি জিনিসটা যে কী, আর তার মজাটাই বা কী, সেটা ইস্কুলে ভর্তি হবার আগে জানা যায় না। এক তো রবিবার আর নানান পরবের ছুটি আছে, তা ছাড়া আছে গ্রীষ্মের আর পুজোর ছুটি। এই দুটো বড় ছুটি আসার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই মনটা খুশির সুরে বাঁধা হয়ে যেত। ছুটির মধ্যে কলকাতায় পড়ে আছি, এ জিনিস তখন কমই হতো।
খুব বেশি করে মনে পড়ে দুটো ছুটির কথা।
একবার আমাদের বাড়ির লোক, লখনৌয়ের মেজোমামা-মামী আর মামাতো ভাইয়েরা, আমার ছোটকাকা ও আর আরও কয়েকজন আত্মীয়স্বজন মিলে এক বিরাট দল গেলাম হাজারিবাগে। Kismet নামে এক বাংলো ভাড়া করে ছিলাম আমরা। খাবার-দাবার টাট্কা ও সস্তা, চমৎকার স্বাস্থ্যকর আবহাওয়া। ক্যানরি হিলের চূড়ো ওঠা, রাজরাপ্পায় পিকনিক, বোখারো জলপ্রপাত দেখতে যাওয়া-সব মিলিয়ে যেন সোনায় মোড়া দিনগুলো। সন্ধ্যাবেলা পেট্রোম্যাক্সের আলোয় দল করে নানান রেশারেশির খেলা। সবচেয়ে আমাদের খেলা ছিল Charade। এ খেলার বাংলা নাম আছে কিনা জানি না, তবে এটা জানি যে রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলায় ঠাকুরবাড়িতে এ খেলার চল ছিল। দু’ দলে ভাগ করে খেলতে হয়-পালা করে এক দল অভিনেতা, এক দল দর্শক। যারা অভিনয় করবে তারা এমন একটা কথা বেছে নেবে যেটা দুটো বা তারও বেশি বেশি কথার সমষ্টি। যেমন করতাল (কর+তাল), সন্দেশ (সন+দেশ), সংযমশীল (সং+যম+শিল): সংযমশীল কথাটা যদি বেছে থাকে অভিনয়ের দল, তাহলে তাদের পরপর চারটে ছোট ছোট দৃশ্য অভিনয় করে দেখাতে হবে দর্শকের দলকে। প্রথম দৃশ্য ‘সং, দ্বিতীয় দৃশ্যে ‘যম’ আর তৃতীয় দৃশ্যে ‘শিল’ কথাটা বুঝিয়ে সব শেষে পুরো কথাটা অভিনয় করে বোঝাতে হবে। দুরকম Charade হয়- Dumb Charade আর Talking Charade। যদি Dumb Charade খেলা হয়, তাহলে শুধু মূকাভিনয় করে কথাগুলো বোঝাতে হবে। আর যদি Talking Charade হয় তাহলে অভিনেতাদের কথাবার্তার মধ্যে এক আধবার বাছাই করা কথাগুলো ঢুকিয়ে দিতে হবে। দর্শকের দলকে চারটে দৃশ্যের অভিনয় দেখে পুরো কথাটা বার করতে হবে। বড় দল হলেই খেলাটা জমে ভালো। আমরা ছিলাম প্রায় দশ-বারো জন। সন্ধেটা যে কোথা দিয়ে কেটে যেত তা টেরই পেতাম না।
আরেকটা স্মরণীয় ছুটি কেটেছিল স্টিম লঞ্চে করে সুন্দরবন সফরে। আমার এক মেসোমশাই ছিলেন একসাইজ কমিশনার। তাঁকে সুন্দরবনে কাজে যেতে হত মাঝে মাঝে। একবার তিনি বেশ কয়েকজন আত্মীয়স্বজনকে সঙ্গে নিলেন, তার মধ্যে আমি আর মা ও ছিলাম। মাসি আর মেসো ছাড়া ছিলেন চার মাসুতো দিদি আর রণজিত্দা। রণজিত্দা বা ‘রণদা’ ছিলেন শিকারী। সঙ্গে নিয়েছিলেন বন্দুক আর অজস্র টোটা। মাতলা নদী ধরে যেতে হবে আমাদের একেবারে মোহনা পর্যন্ত, আর তারই ফাঁকে সুন্দরবনের খাল বিলের মধ্যে দিয়ে ঘুরবে আমাদের লঞ্চ। সবশুদ্ধ পনেরো দিনের ব্যাপার।
সফরের বেশির ভাগটা সময়ই ডেকে বসে দৃশ্য দেখে কেটেছে। মাতলা বিশাল চওড়া নদী, প্রায় এপার ওপার দেখা যায় না। সারেঙরা মাঝে মাঝে জলে বালতি নামিয়ে দেয়, আর তুললে পরে দেখা যায় জলের মধ্যে উঠে এসেছে প্রায়-স্বচ্ছ জেলিফিশ। যখন খালের ভিতরে ঢোকে লঞ্চ তখন দৃশ্য যায় একেবারে বদলে। দূর থেকে দেখছি খালের পারে সার সার কুমীর রোদ পোহাচ্ছে, তার পিঠে বক বসে আছে দিব্যি, আর কাছে এলেই কুমীরগুলো সড়াত্ সড়াত্ করে নেমে যায় জলে। যেদিকে কুমীর সেদিকে জঙ্গল পাতলা, বেশির ভাগ গাছই বেঁটে, আর অপর পারে বিশাল বিশাল গাছের গভীর জঙ্গল, তার মধ্যে হরিণের পাল চোখে পড়ে। তারাও লঞ্চের শব্দ শুনলেই ছুট লাগায়।
একদিন আমরা লঞ্চ থেকে নেমে নৌকা করে ডাঙ্গায় গিয়ে গভীর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চললাম এক আদ্যিকালের পোড়ো কালী মন্দির দেখতে। মাটি ফুঁড়ে বল্লমের মতো মাথা উঁচিয়ে রয়েছে এক রকম শেকড়, হাতে লাঠিতে ভর করে তার ফাঁকে ফাঁকে পা ফেলে এগোতে হয়। সঙ্গে বন্দুকধারী আছেন দুজন, কারণ এ তল্লাটেই বাঘের আস্তানা, বাবাজী কখন দেখা দেন তা বলা যায় না।
বাঘ আমরা দেখিনি এ যাত্রায়, কিন্তু শিকারী রণদা একটা কুমীর মেরেছিলেন। এক জায়গায় খালের ধারে ডাঙায় কুমীরের প্রাচুর্য দেখে লঞ্চ থামানো হল। রণদা নৌকা করে চলে গেলেন সঙ্গে তিনজন লোক নিয়ে। প্রায় আধ ঘণ্টা দম বন্ধ করে বসে থাকার পর একটা বন্দুকের আওয়াজ শোনা গেল। লঞ্চ থেকে বেশ দূরে চলে যেতে হয়েছিল শিকারীর দলকে।
আরো আধা ঘণ্টা পরে নৌকা ফিরল এক কুমীরের লাশ সঙ্গে নিয়ে। সে কুমীরের ছাল ছাড়ানো হলো লঞ্চের নিচের ডেকে। সে ছাল দিয়ে রণদা সুটকেস বানিয়েছিলেন।
সাত দিনের মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম টাইগার পয়েন্ট। সামনে অগাধ সমুদ্র, বাঁয়ে ছোট একটা দ্বীপ, আর তার উপর বালির পাহাড়। আমরা ঢেউবিহীন সমুদ্রের জলে স্নান করে বালির পাহাড়ে অনেকটা সময় কাটিয়ে ফিরে এলাম আমাদের লঞ্চে। লোকালয় থেকে যে বহু দূরে চলে এসেছি সেটা আর বলে দিতে হয় না। নির্ভেজাল আনন্দের কথা বলতে পঁয়তাল্লিশ বছর আগে সুন্দরবন সফরের এই ক’টা দিনের স্মৃতি আমার মনে অনেকটা জায়গা দখল করে রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪:৪৮:০২ ৩২২ বার পঠিত