বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ শিল্প উৎপাদনে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত বিভিন্ন গ্যাস ও চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত অক্সিজেন গ্যাস উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠান লিন্ডে। জার্মান প্রকৌশলী কার্ল ভন লিন্ডের নামে প্রতিষ্ঠিত এ কোম্পানি বর্তমানে বাংলাদেশসহ ১০০টির বেশি দেশে ব্যবসা করছে। প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রতি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ তরলীকৃত বায়ু পৃথক্করণ ইউনিট চালু করেছে। এটি উদ্বোধন করতে বাংলাদেশে এসেছিলেন লিন্ডে এজির নির্বাহী পর্ষদের সদস্য ও এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা সঞ্জীব লাম্বা। লিন্ডে বাংলাদেশের ব্যবসা, বিনিয়োগ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন সঞ্জীব লাম্বা।
বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ লিন্ডে বাংলাদেশের ব্যবসা ও আপনার সফরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু বলুন।
সঞ্জীব লাম্বা : সারা বিশ্বে লিন্ডে গ্রুপ ১৩৫ বছর ধরে ব্যবসা করে আসছে। আর বাংলাদেশে ব্যবসা করে আসছে ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে, ১৯৫০ সাল থেকে। শিল্পকারখানার কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত গ্যাস ও চিকিৎসায় ব্যবহৃত মেডিকেল গ্যাস উৎপাদনে সারা বিশ্বে ১ নম্বর প্রতিষ্ঠান লিন্ডে। বাংলাদেশেও সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহের ক্ষেত্রে শীর্ষ স্থানে আছে লিন্ডে। মেডিকেল গ্যাস, ওয়েল্ডিং শিল্পের গ্যাসসহ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ইতিমধ্যেই লিন্ডে বাংলাদেশের চারটি আলাদা উৎপাদন লাইন রয়েছে। রূপগঞ্জেই তরলীকৃত বায়ু পৃথক করার (লিকুফাইড এয়ার সেপারেশন) নতুন একটি ইউনিট চালু করতেই এবার আমার বাংলাদেশ সফর। এ ছাড়া আগামী বছর সিলিন্ডার ফিলিং ইউনিট, ওয়েল্ডিং ও কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসলাইনের উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধির জন্যও বিনিয়োগ পরিকল্পনা রয়েছে।
বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ বাংলাদেশে লিন্ডের বিনিয়োগ কেমন?.
সঞ্জীব লাম্বা : গত পাঁচ বছরে লিন্ডে বাংলাদেশে ১১০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। বায়ু পৃথক্করণের নতুন যে ইউনিটটি করা হয়েছে সেখানে আরও ১২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। আগামী বছর সিলিন্ডার ফিলিং ইউনিট স্থাপনে আরও ৪০ কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে। সব মিলিয়ে গত সাত বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। লিন্ডে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গাটি হচ্ছে দক্ষ মানবসম্পদ। এখানে প্রত্যেকেই কঠোর পরিশ্রম করেন, নিজের কাজটিও খুব ভালো বোঝেন। বাংলাদেশে ব্যবসা এগিয়ে নিতে নতুন বিনিয়োগের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত যেসব সহায়তা দরকার বৈশ্বিক লিন্ডের পক্ষ থেকে তা নিশ্চিত
বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে শিল্প গ্যাসের বাজারে শীর্ষ অবস্থানে থাকার পরও লিন্ডে সম্পর্কে মানুষ খুব কম জানে। এটার কারণ কী?
সঞ্জীব লাম্বা : আমাদের ব্যবসার যে ধরন তার কারণেই আমরা খুব বেশি প্রচার-প্রচারণা করি না। তবে এখন আমরা লিন্ডে ব্র্যান্ডের প্রতি জনসচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছি। চিকিৎসার কাজে আমাদের তৈরি অক্সিজেন অনেক মানুষের জীবন বাঁচায়, প্রতিটি শিল্পে কোনো না-কোনোভাবে আমাদের গ্যাস ব্যবহার হয়, এই বিষয়গুলো মানুষ যাতে জানে সেদিকে আমরা নজর দিচ্ছি। এ ছাড়া বাংলাদেশে লিন্ডেকে খুব বেশি না চেনার একটি বড় কারণ হলো, ২০০৭ সাল পর্যন্ত এটি পরিচিত ছিল বাংলাদেশ অক্সিজেন কোম্পানি বা বিওসি নামে। এখনো অক্সিজেন কোম্পানির নাম বললেই মানুষ খুব প্রশংসা করে, কিন্তু লিন্ডে নামটি এ দেশের মানুষের কাছে খুব বেশি পরিচিত নয়। এ ক্ষেত্রে ব্র্যান্ড নামের পরিবর্তনটি আমাদের ক্ষেত্রে খুব সফল হয়নি।
বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ বাংলাদেশে বর্তমানে লিন্ডের ব্যবসা কেমন চলছে?
সঞ্জীব লাম্বা: বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশে লিন্ডের ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি বেশ ভালো। বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশে আমরা ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধিতে এগিয়ে আছি। তবে এ দেশে ব্যবসার আরও অনেক ক্ষেত্র আছে, যেগুলো এখনো কাজে লাগাতে পারিনি। তাই এখানকার বাজারে আমাদের আরও অনেক ভালো করার সুযোগ রয়েছে।
বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ বাংলাদেশে আপনারা ইতিমধ্যেই নতুন নতুন অনেক বিনিয়োগ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশের সার্বিক বিনিয়োগ পরিস্থিতি কেমন মনে করেন?
সঞ্জীব লাম্বা : বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা যথেষ্ট আগ্রহী ও আস্থাশীল। বিনিয়োগের জন্য আগ্রহের পাশাপাশি আস্থাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। লিন্ডের এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রধান হিসেবে ২০টি দেশের ব্যবসা আমি দেখভাল করি। এই ২০টি দেশের প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করলে, লিল্ডের জন্য বাংলাদেশ এই অঞ্চলের প্রধান তিনটি বাজারের একটি। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন একটা স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে, যেটা বিনিয়োগকারীদের জন্য খুব ভালো একটি সংকেত বা সিগন্যাল। তবে বিনিয়োগকারীদের সমস্যা সমাধানে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সরকার আরেকটু মনোযোগী হলে তাতে এ দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) পথ আরও সুগম হবে।
প্রথম আলো: আপনার দৃষ্টিতে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান বাধাগুলো কী?
সঞ্জীব লাম্বা: বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী ব্যক্তিরা মূলত তিনটি কারণে পিছিয়ে যান। তার মধ্যে প্রথম হলো বিদ্যুৎ সরবরাহ। আমাদের ব্যবসা ও উৎপাদনপ্রক্রিয়া সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ নির্ভর। রূপগঞ্জের কারখানা চালানোর জন্য প্রতিদিন আমাদের প্রায় সাড়ে ৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন। প্রতিদিন এই বিদ্যুৎ যদি কারখানায় সরবরাহ করা না যায় তাহলে আমার বিনিয়োগ শেষ। তাই বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও এ বিষয়ে পুরোপুরি শঙ্কামুক্ত নই। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নীতি সহায়তা। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই একটি নির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা থাকে, একটি জায়গা থেকেই সব সুবিধা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা থাকে। সিঙ্গাপুরের ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট বোর্ড, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার বিনিয়োগ বোর্ড সব সময় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখে। আর বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শিল্প খাতের আইন ও নীতিমালাগুলোর সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করা।
প্রথম আলো: বাংলাদেশে কেউ যদি বিদেশি বিনিয়োগ করতে চায় তাহলে আপনার কী পরামর্শ থাকবে?
সঞ্জীব লাম্বা: বাংলাদেশে আরও বড় বড় বিদেশি কোম্পানি যাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসে সেই লক্ষ্য থেকেই আমরা সবচেয়ে বড় তরলীকৃত বায়ু পৃথক্করণ ইউনিটটি চালু করেছি। এ ছাড়া বাংলাদেশে যাতে জার্মানির অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগে এগিয়ে আসে, সে জন্য রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কাজ করছি। ঢাকার জার্মান দূতাবাসের নেতৃত্বে একটি পরামর্শক বোর্ড রয়েছে, যেখানে লিন্ডে বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালকও আছেন। জার্মানিতে মধ্যম সারির অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে, আমি মনে করি যাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের ভালো সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ০:৩৭:৫৬ ৪১৬ বার পঠিত