বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃরাজধানীর যানজট নিরসনে নির্মাণাধীন মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের একটি অংশ খুলে দেয়া হয় গত বুধবার। তেজগাঁও সাতরাস্তা মোড় থেকে রমনার হলিফ্যামিলির হাসপাতাল পর্যন্ত ফ্লাইওভারের এই অংশটিতে উদ্বোধনের পর থেকেই যান চলাচল শুরু করে। তবে কমছে না বিড়ম্বনা, সমস্যা হচ্ছে ওঠানামা নিয়ে। ২ কিলোমিটারের ফ্লাইওভারের এই অংশটিতে গাড়ি উঠতে বেগ পেতে হচ্ছে। ফ্লাইওভারের ওঠার সময় গাড়ি গতিবেগ সর্বোচ্চ ৩০ কিলোমিটার রাখার নির্দেশনা থাকলেও তা মানতে পারছে না। কারণ ফ্লাইওভারে ওঠার পথ উঁচু হওয়ায় গাড়ি গতিবেগ ৫০-৬০ কিলোমিটার রাখতে হচ্ছে বলে চালকরা জানান। ফ্লাইওভার নির্মাণে নকশা ত্রুটির কারণে এই সমস্যা হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। সাধারণ মানুষ শঙ্কা নিয়েই চলাচল করছে। যদি ফ্লাইওভারে ওঠার র্যাম্পটি আরও একটু লম্বা হলে এই সমস্যা তৈরি হতো না বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। তবে তেমন কোনো ঝুঁকি নেই বলে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের নির্মাণে ত্রুটি খুঁজতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।সরেজমিন মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীর রমনা এলাকার হলিফ্যামিলি হাসপাতালের সামন থেকে ফ্লাইওভারে ওঠার ও নামার দুটি র্যাম্প দেয়া হয়েছে। এই র্যাম্প দুটি দিয়ে সমানভাবে তৈরি করা হয়েছে। এখান দিয়ে গাড়িগুলো ফ্লাইওভারে উঠতে ও নামতে কোন সমস্যা হচ্ছে না বলে জানান চালকারা। তবে তেজগাঁও এলাকার হাতিঝিলের সামনের র্যাম্পটি দিয়ে ফ্লাইওভারে উঠতে অনেক বেগ পেতে হয় বলে জানান চালকরা। এই অংশ দিয়ে ফ্লাইওভারের ওঠার সময় গাড়ির গতি সর্বোচ্চ ৩০ কিলোমিটার রাখান নির্দেশনা দেয়া রয়েছে। কিন্তু ঘণ্টায় ৫০-৬০ কিলোমিটার গতি দিয়ে গাড়ি ফ্লাইওভারে উঠতে হচ্ছে বলে জানান চালকরা। এছাড়া অধিক যাত্রী বহন করা লোকাল বাস ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে চলাচল করতে দেয়া যায়নি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ৬ নম্বর গাড়ি চালক মনির হোসেন সংবাদকে বলেন, ফ্লাইওভারে উঠতে একটু বেগ পেতে হয়। এছাড়া লোকাল যাত্রী বহন করার কারণে ফ্লাইওভার দিয়ে যাতায়াত করা হয় না বলে জানান তিনি।
আল মক্কা ট্রান্সপোর্ট বাসের চালক বলেন, ফ্লাইওভার দিয়ে চলাচলে কোন সমস্যা হয় না। তবে নামার চেয়ে ওঠার র্যাম্পটি আরও লম্বা করা দরকার ছিল বলে জানান তিনি। কাওসার নামের এক প্রাইভেটকার চালক বলেন, ফ্লাইওভারে ওঠার সময় গাড়ির গতি ৫০-৬০ কিলোমিটারে রাখতে হয়েছে। কারণ ওঠার র্যাম্পটি খুব উঁচু মনে হচ্ছে। তাই শঙ্কায় থাকি।
বেলাল হোসেন নামের বলাকা বাসের এক চালক বলেন, ফ্লাইওভারের কারণে মগবাজার এলাকার যানজট অনেক কমে গেছে। আগে যেখানে মগবাজার রেলগেট থেকে মালিবাগ, মৌচাক মোড় পর্যন্ত ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে বসে থাকতে হতো। এখন সেখানে মাত্র ১০-১৫ মিটিটের মধ্যে মগবাজার মোড় পাড় হয়ে মালিবাগ পর্যন্ত চলে আসা যায়। তবে লোকাল বাসগুলো ফ্লাইওভারে উঠে কম। কিন্তু সিটিং সার্ভিস ও গেটকল সার্ভিসগুলো ফ্লাইওভার দিয়ে চলাচল করে বেশি। তবে ফ্লাইওভারে গাড়ি নামার চেয়ে ওঠার সময় বেশি বেগ পেতে হয় বলে জানান তিনি।
এ ব্যাপারে পরিবহন বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল হক সংবাদকে বলেন, ফ্লাইওভারে নামার চেয়ে ওঠার র্যাম্পটি একটু উঁচু হলেও তেমন ঝুঁকি নেই বলে জানান তিনি। তবে ওঠার র্যাম্পটি আরও লম্বা হলে দীর্ঘমেয়াদি সুবিধা পাওয়া যেত।
এদিকে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের নির্মাণে ত্রুটি খুঁজতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ২২তম বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে সংসদ সদস্য মো. তাজুল ইসলামকে। কমিটির অপর দুজন সদস্য হলেন সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরী ও মুহিবুর রহমান মানিক। তদন্ত কমিটি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) প্রকৌশলীদের মতামত নেবে। পাশাপাশি সরেজমিন প্রকল্প পরিদর্শনও করবে।
এ ব্যাপারে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ সাংবাদিকদের বলেন, ঢাকা শহরে ফ্লাইওভারগুলো তৈরি করা হয়েছিল যানজট কমানোর জন্য। কিন্তু এগুলোতে গাড়ি ওঠা ও নামার জায়গাগুলোতে যানজট হয়ে থাকে বলে কমিটির কিছু কিছু সদস্য অভিযোগ করেছেন। এ কারণে এসব ফ্লাইওভারে পরিকল্পনায় কোন ত্রুটি ছিল না এটি খতিয়ে দেখতেই তিন সদস্যর একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এতে বুয়েট, স্থানীয় সরকার ও সড়ক মন্ত্রণালয়সহ যেসব প্রকৌশলী রয়েছেন তাদের সঙ্গে কথা বলে এবং সরেজমিন পরিদর্শন করে পরিকলল্পনায় কোন ত্রুটি ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখবে কমিটি। এক মাসের মধ্যে উক্ত কমিটিকে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য বলা হয়েছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশে সব ধরনের মোটরযান ডান হাতে চালিত। সে বিষয় বিবেচনায় রেখে নির্মাণ করা হয় সড়ক অবকাঠামো। নকশাও প্রণয়ন করা হয় সে আদলেই। তবে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারটি বাম হাতে চালিত গাড়ির কথা মাথায় রেখে নকশা করা। সেভাবেই এটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে ওঠার রাস্তা অনেক বেশি খাড়া হয়ে গেছে। আর নাামার অংশটি অনেক বেশি প্রসারিত। এ অবস্থাতেই সাতরাস্তা থেকে মগবাজার হয়ে হলিফ্যামিলি অংশটি উদ্বোধন করা হয় গত বুধবার। মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাই হয় ২০০৪ সালে। আর নকশা প্রণয়ন করা হয় ২০০৫-এ। তবে স্বাধীন কোনো পরামর্শক দিয়ে যাচাই-বাছাই (ভেটিং) করা হয়নি ফ্লাইওভারটির নকশা। ফলে নকশার ত্রুটি ধরা পড়েনি সে সময়। আবার ২০১১ সালে প্রকল্পটি চূড়ান্ত অনুমোদন ও ২০১৩ সালে নির্মাণ শুরুর আগেও ফ্লাইওভারের নকশা রিভিউ করা হয়নি।
ঢাকার যানজট হ্রাসের কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (এসটিপি) মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নকশা রিভিউয়ের কথা বলা হয়। তবে তা না মেনেই চূড়ান্ত করা হয় ফ্লাইওভারের নকশা। আবার ফ্লাইওভারটি নির্মাণে ছাড়পত্র নেয়া হয়নি ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষেরও (ডিটিসিএ)। ফলে ভুল নকশায় চলে ফ্লাইওভার নির্মাণ। গত বছর ফ্লাইওভারের কাঠামোয় ত্রুটির বিষয়টি চিহ্নিত করে বুয়েট বিশেষজ্ঞরা। বিষয়টি এলজিইডিকে অভিহিতও করা হয়। এক্ষেত্রে ৬০টি পিলারে ত্রুটি চিহ্নিত করা হয়। বলা হয়, ফ্লাইওভারে ওঠার র্যাম্পগুলোয় পিলার রয়েছে ৮টি। আর নামার র্যাম্পগুলোয় পিলার রয়েছে ১১টি করে। এতে ওঠার র্যাম্পের দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০০ মিটার আর নামার ক্ষেত্রে ৩২০ মিটার। ত্রুটি সংশোধন ৬০টি পিলার ভাঙার সুপারিশও করা হয়। তবে পিলার নির্মাণ হয়ে যাওয়ায় তা আর সংশোধন করা সম্ভব নয় বলেই জানায় এলজিইডি।
বাংলাদেশ সময়: ০:৪৩:২০ ৩১৮ বার পঠিত