বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ লাতিন আমেরিকান সাহিত্যিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের কল্পনার গ্রাম ‘মাকোন্দো’। সে গ্রামে কত বিচিত্র মানুষ, কত-শত গল্প সেখানে। আমারও একটি গ্রাম আছে। এই গ্রাম বাস্তবের। চাঁদের মতো ফুটফুটে সে গ্রামের নাম ‘চাঁদপুর’। বগুড়ার মহাস্থান গড়ের কোলে ছোট্ট একটা পৌরাণিক গ্রাম। গ্রামের তিন দিকে লালমাটির উঁচু উঁচু গড়, বন। তার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট খাল ‘সুবিল’। খরায়, বর্ষায় বিচিত্র রূপ সুবিলের। একদিন ভুলুয়া ধরা দুপুরে, এই সুবিলেই উঁপুড় হয়ে থাকে মাহফুজার মৃতদেহ। তার মৃত্যু রহস্যই থেকে যায়। এই গ্রামের উত্তরের বিশাল জায়গা জুড়ে কবরস্থান। সেটি পার হলে ‘তিন টেউড়ি’। তিন পাশে তিনটি গড় থাকায় এটিকে ‘তিন টেউড়ি’ বলা হয়। কথিত আছে, মহাভারতের কুন্তির ছেলে ভীম থাকতেন এই গ্রামে। লোককথা অনুযায়ী এটাই ‘ভীমের জঙ্গল’। আর ঐ যে তিন টেউড়ি, তিন মাথার ঐ গড় তিনটি হলো ভীমের চুলা। যেখানে দৈত্যকায় ভীমের খাবার রান্না হতো। আমার গল্পগুলো এই গ্রামের। গল্পের চরিত্রগুলো এখানেই বাস করে। সেখানে এনজিও ব্যবসা খুব ভয়ানক। গ্রামের প্রত্যেক মানুষ ঋণগ্রস্থ। ভিটে-মাটি, চাল-চুলা, গবাদী পশু- সব যায় ঋণ শোধে। তবু শেষ হয় না। ভাটার মালিকদের প্ররোচনায় বিক্রি হয়ে যায় ঐতিহ্যবাহী গড়গুলো। মানুষের মুখে মুখে ফেরা গল্প হয়ে যায় রূপকথা। আমার আশঙ্কা, একদিন গ্রামের সব মাটি বিক্রি হয়ে যাবে। সব গড় সমান হয়ে যাবে। পরবর্তী প্রজন্মের কেউ এসে আর খুঁজে পাবে না ‘ভীমের জঙ্গল’। আমার গল্পে যতটুকু ধরে রাখা যায়, চেষ্টা করেছি তা ধরে রাখতে। এছাড়া ব্যক্তি জীবনের টুকরো টুকরো মৃত্যু লেখা আছে গল্পের পাতায়। কখনো বন্ধুর মুখের বোবা কাহিনি ধরতে চেয়েছি। পেরেছি কতটুকু, জানি না। একদিন কতদিন বুবুর আঁচলে মুখ ঘষে ঘষে নির্দোষ দুপুর হত্যা করার গল্প আছে। গল্পগুলো ‘ছোট’ বলতে যতটুকু বোঝায়, তার চেয়েও ছোট। চল্লিশ পৃষ্ঠার ৯টি গল্পে সাজানো বই ‘তিন টেউড়ি’। প্রকাশ করেছে আমার বন্ধু শাহ্ আনোয়ার সাদাত, তার ‘গদ্যপদ্য’ প্রকাশনী থেকে। প্রচ্ছদ করেছেন, প্রিয় শিল্পী আমজাদ আকাশ। দাম ৭৫ টাকা।ভুলুয়া
জীবনে ওই প্রথমবার আমাকে ভুলুয়া ধরেছিল। সে এক ভয়ঙ্কর গোলকধাঁধা। তো সেদিন দুপুরটা ছিল ফাল্গুনের অন্যান্য দুপুরের মতোই, উষ্ণ আর শান্ত। চাউর হলো, গ্রামে হাজাম ঢুকেছে। তখন ‘হাজাম’ শব্দটা আমার মতো বয়সীদের কাছে রীতিমত আতঙ্কের। তখন পর্যন্ত আমাদের গ্রামের ছেলেদের ৬/৭ বছরের আগে সুন্নত করাতো না। ধানকাটা শেষ হলেই গ্রামে হাজামরা আসতেন। চাল অথবা নগদ টাকায় তারা খৎনা করাতেন। বড়রা ভয় দেখাতেন, হাজামরা নুনু কেটে নিয়ে যাবে! তো, সেদিন দুপুরে খসরু পাগলার বাগানে মার্বেল খেলছিলাম। হঠাৎ ফেদু হাঁপাতে হাঁপাতে এসে জানালো, হাজাম আসছে। গ্রামের শুরুর মুখে, সদ্য ইট-সুরকি বিছানো পথ ঠেলে, মাফুর বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে আসছেন, হাজাম। ফেদু জানালো। কাঁধে তার ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগ। ব্যাগে নিশ্চয়ই নুনু কাটার ছুরি আছে! আর সে ছুরি যে ভীষণ ধারালো, তা বলার কী আর অপেক্ষা রাখে। তো, ফেদুর মুখে হাজামের কথা শুনেই যে যেদিক পারি, দে দৌড়। আমি বাড়ির দিকেই যাচ্ছিলাম। হঠাৎ কী হলো, পায়ে পায়ে চেনা পথ অচেনা হয়ে গেল। চোখ বন্ধ করেও অনায়াসে যে পথে বাড়ি ফিরতে পারি, সে পথ আর চিনে উঠতে পারছি না। ফাল্গুনের ওই দুপুরে, ভুলুয়া আমাকে কত পথ যে হাঁটিয়েছে, হিসেব নাই। হাঁটতে হাঁটতে, আমাদের বাড়ি ছেড়ে, গ্রামের শেষ মাথায় যে তিন টেউড়ি, সেটাও ছাড়িয়ে, ভীমের জঙ্গলে ঢুকে গেছি। মহাভারতের কুন্তির পাঁচ ছেলের মেঝটা, দৈত্যকায় ‘ভীম’ এখানেই নাকি থাকত। এই লোককথা শুনেছি ছোটবেলা থেকেই। বিশেষ করে দাদির মুখে এ গল্প অনেকবার শুনেছি। রাতে ঘুমোতে দেরী হলে কিংবা খাওয়া নিয়ে তালবাহানা করলে, দাদী ভীমের গল্প করতেন। কিভাবে পেটুক ভীম, বকাসুর রাক্ষসকে মেরে, তাদের আশ্রয়দাতা ব্রাহ্মণের পরিবার ও একচক্র নগর রক্ষা করেছিল, দাদি সে গল্প প্রায়ই শোনাতেন। তো ভর দুপুরে, নির্জন বনে ঘুরছি। ভীমের জঙ্গলের উঁচু ওই টিলায় কী করে উঠেছি-তাও জানি না। সম্বিত ফেরে, হঠাৎ এই বনের ভেতর থেকে, ঝরা পাতার শব্দ তুলে কাউকে যেতে দেখে। লোকটির মুখ দেখতে পারিনি। বয়স্ক, খালি গা, সাদা লুঙ্গি পড়া। ঝড়ের মতো সরসর করে টিলা থেকে নেমে যেতে দেখলাম। আমাকে তিনি খেয়াল করেননি। আর নিজেকে এই গভীর বনে আবিষ্কার করে আমার তখন গা ছমছমে অবস্থা। অথচ ফেরার কথা ছিল বাড়িতে! মা নিশ্চয় আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। আর একটু সামনের দিকে এগোলেই ক্রমশ নিচের দিকে গড়িয়ে যাওয়ার ভয় ছিল। বনের ঢালুতেই সুবিল খাল। গড়িয়ে হয়তো ওখানে গিয়ে পড়তাম। অথবা কোনো গাছের সাথে, বন্য ঝোঁপে আটকে থাকতাম। সারাদিন, সারারাত আমাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হতো মা, দাদি। তারা কি জঙ্গলের এত গভীরে আমাকে খুঁজতে আসতেন? আমার চিৎকার কি পৌঁছোতো তাদের কানে? শিয়াল, বন্য শুকর কি আমার গন্ধ পেত না! আজ এতদিন পর ভাবতে গিয়েও গা শিরশির করছে। কতক্ষণ ওখানে ছিলাম জানি না। ততক্ষণে ভুলুয়া ছুটে গেছে। পথ চিনে চিনে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরি।
বাড়ি ফেরার পথেই দেখি দলে দলে মানুষ সুবিলের দিক ছুটছে। আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে, গোটা গ্রাম ছুটে যাচ্ছে ঘাটের দিকে। মা আমাকে টেনে নিয়েই ছুট দেন। কিছু বুঝে ওঠারও সুযোগ নেই। কিছু বিস্ময় কানে এলো, ‘বুড়িডা কোমড় পানিত ডুব্যা মরলো!’
ফাল্গুনের ওই সময়টাতে সুবিলে ততোটা পানি নাই। আমরা ৬/৭ বছরের ছেলেরা হেঁটে হেঁটে এপার-ওপার করি। এইটুকু পানির মধ্যে এক বয়স্ক মহিলার মুখ আর মাথা ডোবানো। উপুড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। চুলগুলো পানিতে ছড়ানো। পাশে একটি মাটির কলসও উপুড় হয়ে আছে। আমার দেখা সুবিলের পানিতে, এটাই প্রথম ও শেষ মৃত্যু।
বৃদ্ধার লাশ পারে নিয়ে এলে গ্রামের প্রায় সবাই চিনতে পারে। তার নাম মাহফুজা। মোকাম্মেল বড় আব্বার বোন। আমাদের পাড়াতো ফুফু। বৃদ্ধার মৃত্যুকে কেউ কেউ স্বাভাবিক ভেবেই মেনে নিলেন। কেউ কেউ বললেন, এটা জ্বীন-ভূতের কাজ। সুবিলের ওপরেই যে লাল মাটির গড়, সেখানে অসংখ্য ঘোড়ার কবর আছে। এসব ঘোড়া প্রাচীন যোদ্ধাদের। অসংখ্য অশ্বারোহী যোদ্ধারও কবর আছে এখানে। এই গ্রামেরই কেউ কেউ এই বন থেকে, ঠা ঠা দুপুরে, নির্জন সন্ধ্যায় ঘোড়ার কান্না শুনেছে। এখনো নাকি শোনা যায়। কোনো অশরীরী কি তবে হত্যা করলো বৃদ্ধাকে? এমন প্রশ্নও তুললেন কেউ কেউ। আর শিক্ষিত দু’একজন বললেন, হার্ট অ্যাটাকেই মারা গেছেন তিনি। আজ এতদিন পর, সেই মৃত্যু নিয়ে আর কারো প্রশ্ন নাই, সন্দেহ নাই।
নুনগোলা স্কুলের মাঠটা পেরোলে একখণ্ড জমি। তারপাশে একটি ঘরে থাকতেন মাহফুজা। স্বামী মারা গেছেন বহু আগে। এক ছেলে ছিল, বেঁচে নেই সেও। একমাত্র ভাই মোকাম্মেল। ভাইয়ের সাথে জমি-জমা নিয়ে বহুদিন থেকেই বিরোধ ছিল তার। নুনগোলার জমি আর কুঁড়েঘর বেচে ভাইয়ের সাথে থাকার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন মোকাম্মেল। মাহফুজা শোনেন নাই। একখণ্ড জমি আর একলা ঘর আকড়েই বেঁচে ছিলেন।
ভুলুয়া ছেড়ে যাওয়া সেই দুপুরে, গভীর বন থেকে সরসর শব্দে নেমে যাওয়া লোকটা কে ছিল? বয়স্ক, খালি গা, সাদা লুঙ্গি পড়া! সে কি ভীম? তবে কোন বকাসুরকে বধ করতে এসেছিল সে? কার সম্পদ রক্ষায়, কিংবা গ্রাসে? আমি তার মুখ দেখিনি। লোকটি কি মোকাম্মেল, মাহফুজার একমাত্র ভাই? না কি সে ভুলুয়া? জীবনে ওই একবারই আমাকে ভুলুয়া ধরেছিল।
বাংলাদেশ সময়: ১৪:০৭:২১ ৬৪৪ বার পঠিত