তৃণমূল থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীরা ঢাকায় এসেছিলেন কাউন্সিলে চমক পেতে। নতুন নির্বাহী কমিটির আংশিক ঘোষণা হবে, এটাই ছিল প্রত্যাশা। চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে তারেক রহমানের নাম আবারও ঘোষণা হবে, এটা সবারই জানা। তবে আকর্ষণ ছিল মহাসচিব নিয়ে। এ পদে নাম ঘোষণার অপেক্ষায় দিনভর অপেক্ষা করেছিলেন নেতা-কর্মীরা। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টিও ছিল সেদিকে। দিন পেরিয়ে রাত গড়ায়। কাউন্সিলের দ্বিতীয় অধিবেশনও শেষ হয়। কিন্তু মহাসচিব কিংবা স্থায়ী কমিটি, কোনোটিতেই নাম ঘোষণা হলো না। সমাপনী বক্তব্য দিয়ে কাউন্সিলরদের বিদায় জানালেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। হতাশা আর আক্ষেপ নিয়ে ঢাকা ছাড়লেন নেতা-কর্মীরা। কাউন্সিলে নির্বাহী কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে চেয়ারপারসনকে। কবে নাগাদ তিনি কমিটি দেবেন, তাও খোলাসা করা হয়নি কাউন্সিলে। বিএনপির সিনিয়র এক নেতা বলেন, ‘চলতি মাসেই মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটি ঘোষণা করতে পারেন বিএনপি চেয়ারপারসন। এরও অন্তত এক মাস পর নির্বাহী কমিটি ও বিষয়ভিত্তিক উপ-কমিটি ঘোষণা করা হবে।’ তবে আরেক নেতা জানান, নির্বাহী কমিটির পুরোটাই একসঙ্গে ঘোষণা করা হবে। এতে দেড় থেকে দুই মাস সময় লাগতে পারে।জানা যায়, উৎসবের কাউন্সিল শেষ হলেও এবার পদের টেনশনে বিএনপি নেতারা। পদ পাওয়ার প্রত্যাশার সঙ্গে হারানোর শঙ্কাও রয়েছে। নতুন করে তদ্বিরে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন অপেক্ষাকৃত নিষ্ক্রিয় নেতারা। ঢাকার পাশাপাশি অনেকেরই দৃষ্টি লন্ডনে। নানাভাবে সেখানেও যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করছেন নেতাদের একটি অংশ। শুরু হয়েছে চাওয়া-পাওয়ার লড়াই। শীর্ষ পর্যায়ের পদেও চলছে ঠাণ্ডা লড়াই। মহাসচিব, স্থায়ী কমিটি ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিবের আকর্ষণীয় পদে প্রকাশ্যে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকলেও প্রত্যাশীদের ঘুম নেই। নির্বাহী কমিটির সদস্য হতে কিংবা প্রমোশন পেতে যার যার মতো করে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন নেতারা। এখন এতে নতুন মাত্রা যোগ হলো। বিএনপির নির্বাহী কমিটির সব পদ নির্বাচনে একক ক্ষমতা ও সর্বময় কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে খালেদা জিয়াকে। শনিবার কাউন্সিলের দ্বিতীয় অধিবেশনে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন। পরে কাউন্সিলররা এ প্রস্তাব অনুমোদন করেন। এখন খালেদা জিয়া মহাসচিব থেকে শুরু করে সব কমিটি নিয়োগ দেবেন। এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন গতকাল সন্ধ্যায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কাউন্সিল অনুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। নেতা-কর্মীদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে। এখন বিএনপির নতুন নির্বাহী কমিটি গঠন হবে। এর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ম্যাডামকে (খালেদা জিয়া)। তিনি নতুন কমিটি ঘোষণা করবেন। চেয়ারপারসন নির্বাচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কীভাবে নতুন কমিটি ঘোষণা করবেন, এটা বেমানান। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপির মহাসচিব হবেন, এটা কাউন্সিলের আগেই সিদ্ধান্ত। কিন্তু কাউন্সিলেই ঘোষণা করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। অতীতেও বিএনপিতে এমন নজির নেই। সুবিধাজনক সময়ে কমিটি ঘোষণা করবেন চেয়ারপারসন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিএনপির মতো এত বড় দলে একজন মহাসচিবকে ভারপ্রাপ্ত করে রাখা হয়েছে, কাউন্সিলেও নির্বাচিত করতে পারেনি। এটা খুবই বিস্ময়কর ও হতাশাব্যঞ্জক। যে কারও চোখে পড়বে। এটা কাউন্সিলের দুর্বল দিকগুলোর একটি। এত বছর একজনকে ভারপ্রাপ্ত করে রাখবেন, তাকে ভালো না লাগলে বিদায় করে দেন, নতুন মহাসচিব আনেন। এক্ষেত্রে বিএনপিকে খুব দ্রুত ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলে আমি মনে করি।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘যতক্ষণ না চেয়ারপারসন নতুন কমিটি ঘোষণা করবেন, ততক্ষণ বর্তমান নির্বাহী কমিটি সচল থাকবে। যেদিন নতুন নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করবেন, সেদিন স্বাভাবিকভাবেই এই কমিটি বাতিল হয়ে যাবে। চেয়ারপারসনকে নির্বাহী কমিটি সাজাতে কাউন্সিলররা দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি যথাসময়ে নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করবেন।’ বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা বলছেন, সদ্য অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে প্রাপ্তি অনেক। দীর্ঘদিন পর নেতা-কর্মীরা একটি মিলনমেলায় জড়ো হয়েছিলেন। প্রাণ খুলে কথা বলতে পেরেছেন। নির্বিঘ্নে কাউন্সিল অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে। চেয়ারপারসনের ভিশন-২০৩০ ছাড়াও দিকনির্দেশনামূলক বার্তা পেয়ে মাঠের নেতা-কর্মীরা স্বাভাবিকভাবেই উজ্জীবিত হবেন। পদ প্রত্যাশী সবার কাজে গতি আসবে। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের বার্তায়ও খুশি নেতা-কর্মীরা। বিশেষ করে মামলা-হামলা ও গুম, খুন হওয়া নেতাদের পরিবারের স্বজনরা তার বক্তব্যে অনুপ্রেরণা পাবে। তাদের মধ্যে সাহস-শক্তি ফিরে আসবে।
নেতা-কর্মীরা বলছেন, কাউন্সিলে চেয়ারপারসন ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের নাম ঘোষণা হবে, এটা সবারই জানা। তা নিয়ে কোনো আকর্ষণ ছিল না। কিন্তু অনেকেই প্রত্যাশা করেছিলেন, মহাসচিবের নাম ঘোষণা হবে। তবে আশা করা হচ্ছে, খুব শিগগিরই মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটি ঘোষণা দিতে পারেন চেয়ারপারসন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান, অধ্যাপক নূরুল আমিন বেপারি বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কাউন্সিল হয়, সেখানে কমিটি হয় না। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। সবারই প্রত্যাশা ছিল, কাউন্সিলে বিএনপির অন্তত মহাসচিবের নাম ঘোষণা করা হবে। কিন্তু তা হয়নি। কাউন্সিলরদের সামনে গণতান্ত্রিকভাবে কমিটি দেওয়াটা জরুরি ছিল। কিন্তু বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলে তা হয় না। এবার সব কাউন্সিলর বিএনপি চেয়ারপারসনকে দায়িত্ব দিয়ে দিলেন। এটাকে গণতন্ত্র বলা হলেও প্রকৃত গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় পড়ে না। এ বিষয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের ভাবা উচিত বলে আমি মনে করি।’ অধ্যাপক আসিফ নজরুলের মতে, কাউন্সিল যে কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য ভালো ব্যাপার। সাংগঠনিক গতিশীলতা বৃদ্ধি করে, চাঙ্গাভাব তৈরি করে। বিএনপি অত্যন্ত বাধাবিপত্তির মধ্যে কাউন্সিলটি করেছে। নেতিবাচক প্রচারণার মধ্যেও নেতা-কর্মীদের অংশগ্রহণ ও উচ্ছ্বাস খুবই উল্লেখযোগ্য দিক। বিএনপি চেয়ারপারসন যে বক্তৃতা দিয়েছেন সেখানেও ইতিবাচক বেশ কিছু কথা ছিল। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ, সামাজিক সমঝোতার কথা বলেছেন। এগুলো খুবই পজেটিভ। তবে অনেকেরই প্রশ্ন থাকবে, বিএনপির এই কাউন্সিল ‘মিন’ করে কিনা। চেয়ারপারসন যে শাসনতান্ত্রিক ও সামাজিক সংস্কারের কথা বলেছেন, এগুলো বাস্তব অর্থেই তারা মিন করেন কিনা। তার ভাষায়, ‘অতীতে যখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল, তখন প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার কথা বলেনি। সমঝোতার রাজনীতি করার চেষ্টা করেনি। এই প্রশ্নটা থাকবে। এ ছাড়াও এ কাউন্সিল দলকে সাংগঠনিকভাবে কতটুকু এগিয়ে নিয়ে গেল, সেটা বিবেচ্য বিষয়। বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান নির্বাচিত হবেন, এটা আগেরই জানা কথা। অন্যান্য ক্ষেত্রে মানুষের গণতন্ত্র চর্চা ও তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মতামতের প্রতিফলন কতটুকু হবে, দলকে সেই অর্থে ঢেলে সাজানো হবে কিনা- এ প্রশ্ন রয়েছে। এক্ষেত্রে আমি বলব, বিএনপি ব্যর্থ হয়েছে। তবে এটা অস্বাভাবিক নয়।’ আসিফ নজরুল মনে করেন, ‘বাংলাদেশের ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দলেই এ ধরনের ব্যর্থতা থাকে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি হয়, দলের ভিতর গণতন্ত্র বলে কিছু থাকে না। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিএনপিতে যা হয়েছে, তা হতাশাব্যঞ্জক হতে পারে, কিন্তু অস্বাভাবিক বা নজিরবিহীন কিছু না। এটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক একটি সংস্কৃতি। আমি মনে করি, বিএনপির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ- এত বড় জনপ্রিয় দল, তাদের সাংগঠনিক কাঠামো দুর্বল হওয়ার কারণে, নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে বাধ্য করা সম্ভব হচ্ছে না। এই যে দুর্বলতা, তা কাটাতে কাউন্সিল আদৌ কোনো ভূমিকা রাখবে কিনা, সেই প্রশ্ন আমার থাকবে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে না পারলে বিএনপির কাউন্সিল কোনো সুফল বয়ে আনবে বলে আমি মনে করি না।’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, ‘কাউন্সিলে বিএনপি চেয়ারপারসনকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে কমিটি গঠনে। এ নিয়ে বিস্ময়ের কিছু নেই। আমাদের দেশে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিতে এমনটাই হয়। কাউন্সিল হয়, কমিটি হয় না। এটা নতুন কিছু না। হয়তো কাউন্সিলে কমিটি ঘোষণা হলে এ নিয়ে উপদল সৃষ্টি হয়ে তা পণ্ড করে দিতে পারে। তবে আমি আশা করব, খুব শিগগিরই মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করবেন বিএনপি চেয়ারপারসন। তারুণ্যনির্ভর নির্বাহী কমিটি আসবে। সক্রিয়রা স্থান পাবেন।’ তারেক শামসুর রহমানের মতে, কাউন্সিলে খালেদা জিয়ার ঘোষিত ভিশন-২০৩০ টেকনিক্যালি ভালোই হয়েছে। তবে এর পূর্ণাঙ্গতা কী, তা এখনো স্পষ্ট নয়। যখন তিনি তার ভিশনের পুরোটা জাতির সামনে তুলে ধরবেন, তখনই এ সম্পর্কে ভালোভাবে বলা যাবে। তবে বিএনপির মতো একটি বড় দলের পক্ষ থেকে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের ঘোষণা নতুন বিষয়। যে যুক্তিতে বিএনপি প্রধান বলেছেন, তা আমি ঠিক মনে করি না। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে শুধু দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট করলেই হবে না, এ জন্য আইনগত আরও কিছু উদ্যোগ নিতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ২২:৪২:৪০ ৩৮৩ বার পঠিত