বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবে যখন বাংলাদেশের বিরাট অংশ সাগরে নিমজ্জিত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে, ঠিক সে সময়েই বঙ্গোপসাগরের বুকে দেখা দিয়েছে আরেক বাংলাদেশের হাতছানি। সেখানে সমুদ্রের অথৈ জলে প্রাকৃতিকভাবেই বিশাল বিশাল চর জেগেছে, গড়ে উঠেছে মাইলের পর মাইল ভূখণ্ড।দীর্ঘদিন ধরে শুধুই ‘ডোবা চর’ হিসেবে পরিচিত বেশ কয়েকটি চরভূমি ইতিমধ্যে স্থায়ী ভূখণ্ডে পরিণত হয়েছে। সেসব স্থানে জনবসতিও গড়ে উঠেছে। একই ধরনের আরও প্রায় ২০টি ‘নতুন ভূখণ্ড’ এখন স্থায়িত্ব পেতে চলেছে। বঙ্গোপসাগরে দুই-তিন বছর ধরে জেগে থাকা এসব দ্বীপখণ্ড ভরা জোয়ারেও আর তলিয়ে যাচ্ছে না, বরং দিন দিনই বেড়ে চলছে এর আয়তন। এর মধ্যে হাতিয়ার ‘দুঃখ’ নদীভাঙন হলেও হাতিয়াকে ঘিরে জেগে ওঠা চরগুলো দ্বীপবাসীকে আশার আলো দেখাচ্ছে।
বয়ারচর, নঙ্গলিয়া, নলেরচর, কেরিংচর এবং পুবদিকে উড়িরচর পর্যন্ত যে বিশাল এলাকা ইতাধ্যে জেগে উঠেছে তা ক্রমাগত দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে হাতিয়াকে ছুঁই ছুঁই করছে। এ চরাঞ্চল মূল হাতিয়ার চেয়ে বড়, দীর্ঘতম ভূখণ্ডের ইশারা দিচ্ছে বাংলাদেশকে। হাতিয়া দ্বীপের দক্ষিণাংশে জেগে উঠছে অনেক চর। নিঝুমদ্বীপের আশপাশের চরগুলো যেভাবে পলিবাহিত হয়ে জেগে উঠছে তা অব্যাহত থাকলে নোয়াখালী জেলার চেয়েও বড় আয়তনের ভূখণ্ডের আত্মপ্রকাশ ঘটবে নিঃসন্দেহে।
হাতিয়াকে ঘিরে বিশাল বিশাল আয়তনের চরগুলো জেগে ওঠার বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে এবং নদী ও ভূ-বিশেষজ্ঞ দ্বারা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে হাতিয়ার ভাঙনের মাত্রা কমানো গেলে অদূর ভবিষ্যতে গোটা বাংলাদেশের চেয়েও বড় এক ভূখণ্ড সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। নিঝুমদ্বীপ, নলেরচর, কেয়ারিংচর, জাহাজেরচরসহ বেশ কয়েকটি নতুন দ্বীপ যেন আরেক বাংলাদেশের জানান দিচ্ছে। এর মধ্যে নিঝুমদ্বীপে গড়ে উঠেছে ৫০ হাজার লোকের নতুন বসতি ও বনায়ন।
এ ছাড়া দ্বীপ হাতিয়ার পশ্চিমে ঢালচর, মৌলভীরচর, তমরুদ্দিরচর, জাগলারচর, ইসলামচর, নঙ্গলিয়ারচর, সাহেব আলীরচর; দক্ষিণে কালামচর, রাস্তারচরসহ অন্তত ১৫টি দ্বীপ ১৫-২০ বছর আগ থেকে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে উঠেছে। যে মুহূর্তে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের সিংহভাগ ভূখণ্ড সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় বিশ্বজুড়ে তোলপাড় চলছে, ঠিক সে মুহূর্তেই দেশের এই অভাবনীয় সম্ভাবনা সীমাহীন আশা জাগিয়েছে জনমনে।
এ ছাড়া ঢালচর, নলেরচর, কেয়ারিংচর, মৌলভীরচরসহ কয়েকটি দ্বীপে জনবসতি গড়ে উঠেছে। এসব দ্বীপে বন বিভাগ সবুজ বনায়ন করেছে। তবে জলদস্যু-বনদস্যুদের ভয়ে বাকি দ্বীপগুলোতে এখনো বসবাস শুরু হয়নি। এখনো অন্তত ৪০-৫০টি ডুবোদ্বীপ রয়েছে, যা আগামী
পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে জেগে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, সাগর বুকের অসংখ্য ডুবোচরকে স্থায়ীভূমিতে পরিণত করতে সেখানে প্রাণপণ লড়াই চালাচ্ছে বন কর্মীরা। তাদের নীরবে নিভৃতে পরিচালিত সে বিপ্লবে আরও ২০ হাজার বর্গমাইল ভূখণ্ড মানচিত্রে সংযুক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। ম্যানগ্রোভ বন সৃজনের মাধ্যমে পলিমাটি আটকে তৈরি করা হচ্ছে নিঝুমদ্বীপের মতো দৃষ্টিনন্দন বনাঞ্চল। ফলে কয়েক বছরের চেষ্টাতেই জেগে থাকছে চরভূমি, গড়ে উঠছে দ্বীপখণ্ড।
বঙ্গোপসাগরের নোনাজল হটিয়ে তার বুকে গড়ে তোলা হচ্ছে একেকটি দ্বীপখণ্ড-সৃজন হচ্ছে বনভূমি, গড়ে উঠছে বসতি। এরই মধ্যে বঙ্গোপসাগরের বুকজুড়ে প্রায় ২২০০ বর্গমাইল আয়তনের ভূখণ্ড গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে, তৈরি হয়েছে নিঝুমদ্বীপের মতো দৃষ্টিনন্দন বনাঞ্চল। এ কাজ থেমে নেই, তবে চলছে বড়ই ঢিমেতালে। আছে অর্থ সমস্যা, জনবল সংকট-সর্বোপরি সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে অগ্রাধিকারভিত্তিক গুরুত্বও পাচ্ছে না।
উপকূলীয় এলাকায় গবেষণাভিত্তিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম), অ্যাকচুয়ারি ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (ইডিপি) ও সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিস (সিইজিআইএস) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ শেষে জানিয়েছেন, শিগগিরই আরও বিপুল আয়তনের ভূখণ্ড বাংলাদেশের মানচিত্রে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এ মুহূর্তে পানি ও পলির ক্ষেত্রে কিছু প্রযুক্তিগত ব্যবস্থার পরিকল্পিত উদ্যোগ নেওয়া খুব জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, সাগর বুকের ভূমি উদ্ধার ও ব্যবস্থাপনার জন্য যেসব প্রযুক্তির প্রয়োজন, সেগুলো বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে উদ্ভাবনও করেছেন।
বিশেষজ্ঞরা জানান, সমুদ্র বুকে জেগে ওঠা ৪০ হাজার হেক্টর ভূমিকে এখনই স্থায়িত্ব দেওয়া সম্ভব। পর্যায়ক্রমে এর পরিমাণ দুই লক্ষাধিক হেক্টরে বিস্তৃত হতে পারে। সেখানে বসবাস, চাষাবাদ ও বনায়নের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হবে বলেও আশা প্রকাশ করছেন তারা। নিঝুমদ্বীপের কাছাকাছি এলাকাতেও কয়েকশ বর্গকিলোমিটারের নতুন চর জেগে উঠেছে। সেখানে এখনই বসবাস উপযোগী ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলাও সম্ভব।
নেদারল্যান্ডস সরকারের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত অ্যাকচুয়ারি ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের (ইডিপি) এক জরিপ সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সাল পর্যন্ত শুধু নোয়াখালী উপকূলেই সাড়ে ৯০০ বর্গকিলোমিটার ভূমি জেগে ওঠে। আবার ভাঙনসহ নানা দুর্যোগে একই সময়ে ২ শতাধিক বর্গকিলোমিটার ভূমি নদীগর্ভে বিলীনও হয়ে যায়। যোগ-বিয়োগ করে প্রায় সাড়ে ৭০০ বর্গকিলোমিটার ভূখণ্ড টিকে আছে।
উপকূলীয় জেলে-মাঝিরা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের জানিয়েছেন, সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে প্রায়ই তাদের নৌকাগুলো নতুন নতুন চরে আটকে যাচ্ছে। নিঝুমদ্বীপ থেকে ৩৫-৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে ভাটার সময় বড় বড় চরভূমির অস্তিত্ব থাকার তথ্যও জানতে পেরেছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু নতুন জেগে ওঠা চরগুলোকে পরিকল্পিতভাবে স্থায়িত্ব দিতে সরকারি উদ্যোগ-আয়োজন চলছে ঢিমেতালে। সমুদ্রের বুকে সম্ভাবনার বিশাল আশীর্বাদ এসব নতুন ভূখণ্ড পরিকল্পিত ব্যবহার, বনায়ন ও সংরক্ষণে সমন্বিত কার্যক্রম নেওয়া হয়নি এখনো।
ফলে প্রাকৃতিকভাবে ভূখণ্ড জেগে ওঠার পাশাপাশি আবার ভাঙনের সূত্রপাত ঘটছে, তলিয়েও যাচ্ছে কিছু কিছু অংশ। কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছর বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন পয়েন্টে অন্তত ২০ বর্গকিলোমিটার নতুন চর জেগে ওঠে। তবে নদী-চ্যানেলের গতিপথ পরিবর্তন ও সমুদ্র উপকূলীয় ভাঙনের কবলে পড়ে ৭-৮ বর্গকিলোমিটার ভূখণ্ড হারিয়ে যায়।
এমন ভাঙাগড়ার মধ্যেই প্রতি বছর গড়ে ১২-১৩ বর্গকিলোমিটার ভূমি টিকে থাকে এবং তা দেশের মানচিত্রে মূল ভূখণ্ড হিসেবে যুক্ত হয়। আশির দশকের শেষ ভাগ থেকে জেগে ওঠা চরভূমির পরিমাণ পর্যায়ক্রমে বেড়ে উঠতে দেখা যায়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মেঘনা মোহনা সমীক্ষায়ও এ তথ্যের সত্যতা স্বীকার করা হয়। পাউবো সমীক্ষায় বলা হয়, নদীর ভাঙাগড়ার খেলায় ভূমি প্রাপ্তির হারই বেশি।
আশির দশক পর্যন্ত ভূমি হারানোর মাত্রা বেশি থাকলেও ১৯৯০-৯৬ এবং ২০০৬ সালের পরবর্তী সময়ে আবার ভূমি প্রাপ্তির হার অনেক বেশি ছিল বলেও অপর একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে। ওই সময়ে প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর নতুন ভূমি দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের ২৯ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে সফরের সময় মুহুরি প্রজেক্ট এলাকায় জেগে ওঠা বিশালকায় চরভূমির বিস্তারিত জেনে রীতিমতো আপ্লুত হন। সাগর বুকে জেগে ওঠা ১৭ হাজার একর ভূমিতে তিনি শিল্পপার্ক নির্মাণের নির্দেশ দেন।
ইতিমধ্যে সেখানে বৃহত্তম শিল্পপার্ক স্থাপনের কর্মকাণ্ড চলছে জোরেশোরে। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সমপরিমাণ ভূখণ্ড জেগে উঠছে বলেও দাবি করেছেন বন ও পরিবেশ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। জেগে ওঠা এই ভূখণ্ডের আয়তন প্রায় ৪৫ হাজার বর্গমাইল বলে জানান তিনি। বনমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, এই বিশাল ভূখণ্ডকে যত দ্রুত ব্যবহার উপযোগী করার জন্য সরকার চেষ্টা চালাচ্ছে। এ জন্য প্রয়োজনে বিদেশি সহায়তা গ্রহণ করা হবে। মন্ত্রী বলেন, সুন্দরবন উপকূলে জেগে ওঠা চরে অচিরেই বনায়ন করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। -বিডি প্রতিদিন
বাংলাদেশ সময়: ০:২৪:১৬ ৬৩১ বার পঠিত