অহিংস বঙ্গবন্ধু
Home Page » ফিচার » অহিংস বঙ্গবন্ধু
বঙ্গনিউজ ডটকমঃ যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডে জাতীয় মহাফেজখানায় ফাইল ঘাঁটতে গিয়ে মিলল লাল রেখা টানা বিশেষ এক নথি। সেই নথি সাক্ষ্য দিচ্ছে, ১৯৭১ সালের ১-৭ মার্চে কিসিঞ্জার তাঁর পাকিস্তানি নীতি আঁকড়ে ধরে থাকলেও তিনি কখনো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বকে দায়িত্বহীন বলেননি। মার্কিন প্রশাসনের উচ্চ মহল শেখ মুজিবুর রহমানকে সে সময়েই বারবার শ্রদ্ধার সঙ্গে তুলনা করেছেন মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে। মিজানুর রহমান খান লিখেছেন বিস্তারিত
যুক্তরাষ্ট্রের মহাফেজখানায় রক্ষিত ১–৭ মার্চ–বিষয়ক সেই নথি
২০১২ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর, টানা দুই মাস আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডে অবস্থিত মার্কিন জাতীয় মহাফেজখানায় কাটিয়েছিলাম। এর অন্যতম লক্ষ্য ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডসহ বাংলাদেশ-বিষয়ক নথিপত্র পাঠ ও তা কপি করে আনা। একদিন একটা ফাইল দেখতে গিয়ে খুবই অবাক হলাম। শয়ে শয়ে নথি ঘেঁটেছি। কিন্তু কখনো তো এমনটা দেখিনি। এই একটি ফাইলে লাল রেখা টানা। এই ফাইলের ভেতরে ১ থেকে ৭ মার্চ-বিষয়ক মূল নথি রাখা আছে।
এই নথিগুলো এখনো পর্যন্ত মার্কিন সরকারের কোনো ওয়েবসাইটে উন্মুক্ত করা হয়েছে বলে আমার নজরে আসেনি। যদিও মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর সরকারিভাবে তাদের অফিস অব দ্য হিস্টোরিয়ান সাইটে আনুষ্ঠানিকভাবে মার্চের ওপর কিছু গুরুত্বপূর্ণ দলিল প্রকাশ করেছে। এসব নথি থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে একজন অহিংস শেখ মুজিবের উত্থান ঘটেছিল।
মার্কিন প্রশাসনের ভেতরে, বিশেষ করে যাঁরা নিক্সন ও কিসিঞ্জারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাঁরাও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বারবার শ্রদ্ধার সঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তুলনা করেছেন। আমরা সংগতকারণেই ২৬ মার্চকে স্বাধীনতা দিবস গণ্য করি। কিন্তু এটা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল যে কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই একাত্তরের মার্চে বীর বাঙালির স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি দখলদার সরকার থেকে একটি গণমানুষের সরকারে রূপান্তরকরণ নিশ্চিত হয়েছিল। সেই হিসেবে শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই একটি প্রকৃত স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্গাতা ও তার নন্দিত সরকারপ্রধান হিসেবে জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। গ্রিসের নগর রাষ্ট্রের মতো প্রধানত নেতার মুখের কথায় জনগণের সম্মতি ও তাঁদের অংশগ্রহণে জনগণের কার্যকর শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অব দ্য পিপল ফর দ্য পিপল বাই দ্য পিপল-এর ধারণা সত্যিকার অর্থেই রূপকথার মতো এই ভূখণ্ডে নেমে এসেছিল। কোনো সংবিধান, পতাকা বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী বা সংস্থা ছাড়াই যে একটি জনগণের সরকারব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হতে পারে, তার নজির বিশ্বে বেশি নেই। আর বাংলাদেশ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার গভীর অনুভূতি থেকেই দখলদার বাহিনীর সামরিক বাহিনী ২৫ মার্চের কালরাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেই অর্থে ২৬ মার্চের আগেই বাঙালি জাতি শৃঙ্খল ভেঙে ফেলেছিল। মার্কিন কূটনীতিক জোসেফ সিসকো পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্সকে ১৫ মার্চ লিখেছিলেন, প্রাদেশিক পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার যুক্তিতে আওয়ামী লীগ আজ প্রশাসনের ভার তুলে নিয়েছে। প্রশাসন চালাতে শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষিত ৩৫টি নির্দেশনা সুচিন্তিত ও পরিকল্পিত পদক্ষেপ।
বঙ্গবন্ধু ও মহাত্মা গান্ধী
আজ আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে যখন সহিংসতা ভবিতব্য হয়ে উঠেছে, তখন আমাদের সামনে ৪৫ বছর পরে যে মার্চ হাজির হয়েছে, সেই মার্চে এটা স্মরণ করতে হবে যে কী করে আমরা অহিংস পন্থায় একটি সার্থক ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলন করেছিলাম। একটি কণ্ঠই হয়ে উঠেছিল সাড়ে সাত কোটি মানুষের কণ্ঠ। কোনো নিয়মিত বাহিনী বা প্রশাসনের সাহায্য ছাড়াই জনগণ প্রাত্যহিক জীবনের সর্বস্তরে অভূতপূর্ব শৃঙ্খলা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল। নতুন প্রজন্মের কাছে তা রূপকথা মনে হতে পারে। এই ‘আমরাই’ সেদিন তা পেরেছিলাম। মার্চের অহিংস অসহযোগ আন্দোলনটি তাই আমাদের জাতীয় জীবনের আলোকবর্তিকা।
মার্কিন সরকার তার অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে একাত্তরের মার্চের যে চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছে, সেখানে কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তারা গান্ধীজির সঙ্গে তুলনা করার বিষয়টি প্রকাশ করেছে। এমনকি নিক্সন-কিসিঞ্জারের জবানিতেও একাত্তরের মার্চের দলিলগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে যে বাঙালি নেতারা কোনোভাবেই একটি অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির জন্য দায়ী ছিলেন না।
ছয় দফার অধীনে সংবিধান তৈরি করা ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সামনে ইয়াহিয়া বা পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে সমঝোতার আর কোনো বিকল্প ছিল না। আমি বলব, মার্কিন সরকারও এখন আনুষ্ঠানিকভাবে শেখ মুজিবের এই ভাবমূর্তিটাই বহির্বিশ্বে তুলে ধরছে। ৩ মার্চ ১৯৭১ বেলা তিনটায় সিনিয়র রিভিউ গ্রুপের সভার জন্য প্রস্তুত দলিলে (সভাটি ৬ মার্চ হয়েছিল) বলা হলো ‘বিকজ অব হিজ ল্যান্ডস্লাইড ম্যান্ডেট মুজিব হ্যাজ লিটল ফ্লেকজিব্লিটি ইন মোডিফায়িং হিজ প্রোগ্রাম’। অর্থাৎ জনগণের নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত মুজিবের সামনে তাঁর কর্মসূচিতে পরিবর্তন আনার সামান্যই সুযোগ ছিল। পূর্ব পাকিস্তানিরা স্বাধীনতা চাইলে আমরা তা ঠেকাতে পারব না। মুজিব নতুন রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক সরকার চালাতে পারবেন। ১০ মার্চ ঢাকার কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড এক তারবার্তায় ওয়াশিংটনকে জানালেন, আলমগীর রহমান নামের এক লোক আমাদের কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে বার্তা বয়ে এনেছেন। তিনি বলেছেন, রক্তপাত এড়াতে শেখ মুজিব একটা সমঝোতায় আসতে চান। শেখ মুজিবুর রহমান আরও বলেছেন, তিনি রাজনৈতিক সমাধান চান। যুক্তরাষ্ট্র কি একটি সামরিক সংঘাত দেখতে চায়? ব্লাড নিজে মন্তব্য করেছিলেন, আমাদের অধিকতর ইতিবাচক কিছু একটা করা উচিত। ২৮ মার্চের এরপরের তারবার্তাটিই গণহত্যার বিবরণসংবলিত সেই বিখ্যাত ব্লাড টেলিগ্রাম, যা তাঁকে অমরতা দিয়েছে। ২৯ ও ৩০ তারিখের অপর দুটি ব্লাড তারবার্তায় গণহত্যার বিবরণ আছে। ৩১ মার্চে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড লিখেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান কয়েকটি সপ্তাহ সমান্তরাল সরকার চালিয়েছিলেন, যা প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নামান্তর। লক্ষণীয় ফারল্যান্ড, যাঁকে নিক্সন-কিসিঞ্জারের অন্ধ অনুসারী বলা হয়, তিনি তাঁর কথায় ‘পাকিস্তানের পতাকা ধ্বংস করে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানোর’ মতো ঘটনাকেও বলেছেন ইনসারেকশন বা বিপ্লবের পূর্ব লক্ষণ।
লালরঙা বর্ডার
এই নিবন্ধে আমরা দেখব, ১-৭ মার্চে কিসিঞ্জার অন্ধের মতো তাঁর পাকিস্তানি নীতি আঁকড়ে ধরে থাকলেও তিনি কখনো শেখ মুজিবের নেতৃত্বকে দায়িত্বহীন বলেননি। তাঁকে দোষারোপ করেননি। মার্কিন সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও বিভাগের উচ্চপদস্থ বড় কর্তারাও শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর রাজনৈতিক কৌশলের প্রতি সমীহ করেই মন্তব্য করেছেন।
১ মার্চেই এনএসসি স্টাফ হেরল্ড স্যান্ডার্স ও স্যামুয়েল হকিনসন কিসিঞ্জারকে জানিয়েছিলেন, ভবিষ্যৎ প্রধানত শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর নির্ভর করছে। ছয় দফায় আবেগ ও জনপ্রিয়তা গগনচুম্বী, এ থেকে তাঁর ফেরা অসম্ভব। ওই দুজন ৪ মার্চে কিসিঞ্জারকে আরও তথ্য দেন যে শেখ মুজিবুর রহমান রোববার (৭ মার্চ) স্বাধীনতার সমতুল্য ঘোষণা দেবেন। ৬ মার্চের সিনিয়র রিভিউ গ্রুপের সভায় ভ্যান হোলেন বলেছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে দায়ী করে ইয়াহিয়া শক্তি প্রয়োগের হুমকি দিয়েছেন। কিসিঞ্জার তার উত্তরে বলেন, ‘শক্তি কাজ দেবে না।’
উল্লেখ্য, মার্কিন সরকার নিজেই তার ওয়েবসাইটে বলেছে, ২ মার্চে ফোর্টি কমিটির (কিসিঞ্জারের নেতৃত্বে গঠিত এই কমিটি বিদেশি নেতাদের হত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বিতর্কিত) জন্য তৈরি করা একটি নথি (সিসকো লিখেছেন রাজনীতি-বিষয়ক মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি জনসনকে) তারা আজও গোপন রেখেছে।
লাল রঙের বর্ডার। তার নিচে লাল কালিতে লেখা: পূর্ব পাকিস্তান ১-৭ মার্চ ১৯৭১। একেবারে সার্থক অলংকরণই বটে। ফাইলটিতে যেভাবে নথিগুলো রয়েছে, আমি সেভাবেই স্ক্যানার দিয়ে স্ক্যান করেছিলাম।
১ মার্চ ১৯৭১। কিসিঞ্জারের ঘনিষ্ঠ সহকারী জোসেফ সিসকো ইয়াহিয়ার জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখা বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্সের কাছে দেওয়া এক তথ্য স্মারকে মন্তব্য করেছেন, ‘ইয়াহিয়া শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে পশ্চিমা নেতা ভুট্টোকে খুশি করেছেন। এখন শেখ মুজিবের সামনে বিকল্প পথ হলো হয় ছয় দফার ভিত্তিতে সংবিধান তৈরি, নাহলে স্বাধীনতা ঘোষণা।’
এভাবে আমার দেখা মার্চের প্রতিটি দলিলে মুজিবের প্রতি তাদের সহানুভূতির অভিব্যক্তি ঘটেছে। ১ মার্চে সিসকো লেখেন, শেখ মুজিবুর রহমান একটা কঠিন অবস্থায় আছেন। তাঁকে একটা শিথিল ফেডারেশনের মধ্যে থাকার কথা বলতে হবে। অন্যথায় সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা বা তেমন একটা প্রকাশ্য হুমকি হলেও দিতে হবে। আমরা জানি না শেখ মুজিব কোনটা করবেন, তবে নেতৃত্ব ধরে রাখতে তাঁকে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত দিতে হবে।
২ মার্চ ১৯৭১। জোসেফ সিসকো উইলিয়াম রজার্সকে যা লিখেছেন তাতে পরিস্থিতির আরও অবনতির জন্য ইয়াহিয়াকেই অভিযুক্ত করা হয়। তিনি লেখেন, কনসিলিয়েটরি (আপসে আগ্রহী) গভর্নরকে বরখাস্ত করলেন ইয়াহিয়া। প্রেস সেন্সরশিপ দিলেন। অন্যদিকে শেখ মুজিবুর রহমানের অহিংসনীতি সম্পর্কে তিনি লিেখছেন, শেখ মুজিব যদিও বলেছেন যে ‘বাঙালি জানে যে কী করে রক্ত ঝরাতে হয়’ এবং তারা ‘ছেড়ে কথা বলবে না’, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর জনগণের প্রতি অহিংসা ও অসহযোগের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া (বাট হি আর্জড হিজ পিপল টু ফলো ডেমোক্রেটিক প্রসেসেস অব নন-ভায়োলেন্স অ্যান্ড নন-কো-অপারেশন) অনুসরণের আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু এই তথ্যস্মারকটিতে সিসকো ৭ মার্চের ভাষণ প্রসঙ্গে এটাই বলেছেন, যদি শেখ মুজিবুর রহমান বা তাঁর সভাকে দমানো হয়, তাহলে সহিংসতার বিস্তার ঘটতে বাধ্য। আর তিনি যদি বেশি সতর্ক অবস্থান নেন, তাহলে তাঁর নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।’
বাঙালির সামনে পথ যে আর বেশি খোলা ছিল না, সেটাও তাঁরা বিবেচনায় নিয়েছেন। ২ মার্চে সিসকো তাই লিখেছেন, ‘আপাতত বিচ্ছিন্নতা এড়াতে চাইলে আরেকটি বিকল্প হতে পারে, গান্ধীর মতো বেসামরিক অসহযোগ আন্দোলনে নামা। কিন্তু তখন অবশ্যই সামরিক কর্তৃপক্ষের দমনমূলক নীতির কবলে পড়তে হবে। কিন্তু তাতে পরিকল্পনা করার জন্য পূর্ব ও পশ্চিম উভয়ে কিছুটা সময় পাবে।’ কিন্তু এই বার্তাটির উপসংহারে লেখা হয়, উভয় অংশের অখণ্ড থাকার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য, দুইয়ের মধ্যে রিকনসিলিয়েশনের সুযোগ স্পষ্টতই মুছে গেছে।
এবং ৭ মার্চের ভাষণ
৪ মার্চ, ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইয়াহিয়ার আমন্ত্রণকে শক্ত ভাষায় নাকচ করে বলেছেন, ‘এটা নিষ্ঠুর কৌতুক, যা নিরস্ত্র বেসামরিক লোকদের ব্যাপক হত্যা ডেকে আনবে।’ সিসকো লিখেছেন, শেখ মুজিব লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ বন্ধ করতে যে আহ্বান করেছেন, তাতে মানুষ সাড়া দিয়েছে আর তাতে নৈরাজ্যকর অবস্থা অনেকটা হ্রাস পেয়েছে বলেই কনস্যুলেট জেনারেল জানিয়েছেন। শেখ মুজিবুর রহমান এখনো পর্যন্ত একটা আলগা সম্পর্ক হলেও ধরে রাখতে চাইছেন। কিন্তু পরিস্থিতি তাঁকে স্বাধীনতা ঘোষণা করার দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে।
৫ মার্চ ১৯৭১, সিক্রেট লেখা এই নথিটি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম পি রজার্সের কাছে প্রেরণ করেছিলেন জোসেফ সিসকো। এটি একটি তথ্যস্মারক। বিষয়: পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা প্রতিরোধে সম্ভাব্য পাকিস্তানি সামরিক হস্তক্ষেপ। এতে বলা হয়েছে, আমরা ইসলামাবাদের মার্কিন দূতাবাস থেকে সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়ে একটি মূল্যায়ন পেয়েছি। ৪ মার্চেও রজার্সের কাছে একটি তথ্যস্মারক পাঠানো হয়। কিন্তু পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পরিস্থিতি বদলায়। কারণ সিসকো বলছেন, ‘সামরিক পদক্ষেপের আশঙ্কা গতকালের চেয়ে আরও বেড়ে গেছে। দেশের ঐক্য বজায় রাখার পথ যদি আর একটিই অবশিষ্ট থাকে বলে তারা মনে করে, তাহলে তারা শক্তি প্রয়োগের দিকেই যাবে। যদিও তারা ইতিমধ্যেই শক্তি প্রয়োগ করছে। তবে আরও করার মতো সামর্থ্য আর নেই।’ এই সামর্থ্য যে বাড়াতে শুরু করেছিল, সেই ইঙ্গিতও তাঁরা পাচ্ছিলেন।
তবে ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে সিসকো ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে ‘সব ইঙ্গিত স্পষ্ট করেছে যে ৭ মার্চে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবেন। এবং সম্ভবত সেটা হবে স্বাধীনতার সমতুল্য। একটি আলাদা সংবিধান, পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি সরকার, যা শিথিলভাবে পাশ্চাত্যের কোনো একটি ফেডারেল কাঠামোতে লেপ্টে থাকে। কিন্তু দেখার বিষয় হলো এই বাক্যটি—‘শেখ মুজিবের ঘোষণার প্রতি সামরিক আইন প্রশাসন কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, তার ওপর শান্তিপূর্ণভাবে একটি রাজনৈতিক ক্রান্তিকাল অতিক্রম বা একটি বিশৃঙ্খলা বা রক্তপাত ঘটার বিষয় নির্ভর করবে।’ এরপরের বাক্যেই লেখা: ‘যত ভয়ানকই হোক সহিংস পন্থা, হতে পারে তা নিষ্ফল কিন্তু সামরিক বাহিনী দমনের দিকেই যাবে।’ কিন্তু কোথাও দেখা যাচ্ছে না যে শেখ মুজিবুর রহমান কখন কী করে বসেন, সেটা ভেবে তাঁরা কখনো বিচলিত হয়েছেন। বরং তাঁদের নথিতেই যেটা ফুটে উঠেছে তাতে দেখা যায়, ইয়াহিয়ার গোঁ ধরার সঙ্গে কিসিঞ্জারের গোঁ ধরার মধ্যে কোনো ফারাক নেই।
৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে সিসকো ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে ‘সব ইঙ্গিত স্পষ্ট করেছে যে ৭ মার্চে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবেন। এবং সম্ভবত সেটা হবে স্বাধীনতার সমতুল্য।’
একাত্তরের ১৩ মার্চে কিসিঞ্জার নিক্সনকে এক স্মারকে জানিয়েছিলেন, ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণাদান থেকে নিবৃত্ত থাকাটা দৃশ্যত কৌশলগত। আর এই স্মারকেই কিসিঞ্জার বঙ্গবন্ধুর প্রতি একটা গভীর শ্রদ্ধাপূর্ণ মন্তব্য করেন। শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে তাঁর নেতিবাচক মন্তব্যগুলো অনেক বেশি প্রচার পেয়েছে কিন্তু যেটি পায়নি সেটি হলো কিসিঞ্জার নিজেই নিক্সনকে বলেছিলেন, শেখ মুজিব যেভাবে গান্ধীর মতো অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পরিচালনা করছেন, তাতে সেখানে দমন-পীড়ন চালানোর যথার্থতা দেওয়া কঠিন। কিসিঞ্জারের নিজের ভাষায়, …রহমান হ্যাজ এমবার্কড অন এ গান্ধিয়ান টাইপ নন-ভায়োলেন্ট নন-কো-অপারেশন ক্যাম্পেইন হুইচ মেকস ইট হার্ডার টু জাস্টিফাই রিপ্রেশন।
সবটাই যুক্তরাষ্ট্রের নখদর্পণে ছিল। ৫ মার্চে সিসকো তিনটি বিকল্প সম্পর্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রজার্সকে ধারণা দিয়েছিলেন, যার সবটাই পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর শক্তি প্রয়োগসংক্রান্ত। তার কোথাও ইয়াহিয়ার তরফে সংলাপ বা আপসের কোনো কথা ছিল না। তাতে লেখা ছিল, ব্যাপক ভিত্তিক সহিংসতা ও রক্তপাত হলে আমরা মারাত্মকভাবে উদ্বিগ্ন হব। ব্রিটেন, জাপানসহ অন্য বন্ধুদের নিয়ে ইয়াহিয়াকে নিবৃত্ত করতে উদ্যোগী হব। কিন্তু আঘাত যখন সত্যি হলো, তখন তারা সর্বাত্মক মদদ দিয়েছে। এমনকি গোপনে অস্ত্র সরবরাহ করেছে। শেখ মুজিবুর রহমানকে ওরা অহিংস পন্থায় স্বাধীনতা পেতে ব্যর্থ করেছে।
আজ হোক কাল হোক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একাত্তরের গণহত্যার নৈতিক ও রাজনৈতিক দায় নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রজন্ম একদিন নিশ্চয় এর কৈফিয়ত চাইবে। বিচার চাইবে।
“লাল রঙের বর্ডার। তার নিচে লাল কালিতে লেখা: পূর্ব পাকিস্তান ১-৭ মার্চ ১৯৭১। একেবারে সার্থক অলংকরণই বটে। ফাইলটিতে যেভাবে নথিগুলো রয়েছে, আমি সেভাবেই স্ক্যানার দিয়ে স্ক্যান করেছিলাম
৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে সিসকো ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে ‘সব ইঙ্গিত স্পষ্ট করেছে যে ৭ মার্চে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবেন। এবং সম্ভবত সেটা হবে স্বাধীনতার সমতুল্য।’
বাংলাদেশ সময়: ১১:১২:৩৭ ২৬০ বার পঠিত
পাঠকের মন্তব্য
(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)ফিচার’র আরও খবর
অ্যানেন্সেফ্লাই কী? - রুমা আক্তার
শেখ হাসিনা বাংলাদেশে নারী ক্ষমতায়নের অগ্রদূত : স্পিকার ; ১০০০ নারী উদ্যোক্তা’র মধ্যে ৫ কোটি টাকার অনুদান প্রদান
“ম্রো’ আদিবাসীর গো হত্যা’ অনুষ্ঠাণ ” - তানিয়া শারমিন
আলোকিত স্বপ্ন নিয়ে তৃতীয় বর্ষে রবিকর ফাউন্ডেশন
নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন রক্ষায় প্রয়োজন জেন্ডার সংবেদনশীল নীতির পর্যালোচনা
জিনগত ত্রুটির অপর নাম “ডাউন সিনড্রোম”- রুমা আক্তার
মোহাম্মদ শাহ আলমের জীবন ও কর্ম
ইসফাহান নেসফে জাহান
সিলেটে গ্রুপ ফেডারেশনের কর্মশালায় বির্তকিত মুরাদ- আয়োজকদের দুঃখ প্রকাশ
ডলারের দাম যেভাবে বাড়ছে, টাকার দাম কেন কমছে
-
সালাম, আমান, রিজভী, খোকন, শিমুল ও এ্যানিসহ গ্রেফতার শতাধিক
বুধবার ● ৭ ডিসেম্বর ২০২২ -
ভারতকে হারিয়ে টাইগারদের সিরিজ জয় নিশ্চিত
বুধবার ● ৭ ডিসেম্বর ২০২২ -
নয়াপল্টনে বিএনপি নেতাকর্মীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ ,নিহত ১
বুধবার ● ৭ ডিসেম্বর ২০২২ -
জাতীয় শুদ্ধাচার পুরস্কারে ভূষিত ওসমানীনগরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিক
বুধবার ● ৭ ডিসেম্বর ২০২২ -
বিয়েবর্হিভূত যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ: প্রতিবাদে বিক্ষােভ ইন্দোনেশিয়ায়
মঙ্গলবার ● ৬ ডিসেম্বর ২০২২ -
আড়াইহাজারে অর্থনৈতিক অঞ্চল উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
মঙ্গলবার ● ৬ ডিসেম্বর ২০২২
আর্কাইভ
Head of Program: Dr. Bongoshia
News Room: +8801996534724, Email: [email protected] , [email protected]