বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃরাজধানীর মিরহাজিরবাগ ঘুন্টিঘর এলাকায় ভাড়া বাসায় সপরিবারে থাকেন ধোলাইখালের একটি ওয়ার্কশপের মেকানিক আলমগীর হোসেন। কাজের তাগিদে তাকে বের হতে হয় সকাল ১০টার আগেই। কিন্তু পানির সংকটে প্রায়ই ঝামেলা পোহাতে হয় আলমগীরের পরিবারকে। জানালেন, সকাল ৮টার পরপরই লাইনে পানি পাওয়া যায় না। পানি আসে সন্ধ্যা ৬টা অথবা রাত ৮টার পর। তিনি জানান, রিজার্ভ ট্যাঙ্ক তুলনামূলক ছোট তাদের জন্য এ অবস্থা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এখনো পুরোপুরি গরম আসেনি তাতেই পানির সংকট শুরু হয়েছে। সামনের দিন পানির জন্য হাহাকার লেগে যাবে বলে মন্তব্য তার।
আলমগীরের মতো একই অভিযোগ শেখপাড়া এলাকার বাসিন্দা তসলিমের। তিনি জানান পানির সংকটের কারণে রান্নাবান্নার কাজসহ প্রয়োজনীয় কাজে পানি পাওয়া কষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে। লাইনে পানি না থাকায় এ কষ্ট প্রতিনিয়ত পোহাতে হয় এলাকাবাসীর। রিজার্ভ ট্যাঙ্কির মাধ্যমে ঘর গৃহস্থালির কাজ চালালে একসময় তা ফুরিয়ে গেলে পানির জন্য রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। দিনে চাহিদা মতো পানি না পাওয়ার কারণে দুর্ভোগে পড়ছে মানুষ।
সূত্র জানায়, চৈত্র মাস আসতে এখনো ১৫ দিন বাকী। এর মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে পানির তীব্র সংকট। অভিজাত এলাকায় পানি সরবরাহ কিছুটা স্বাভাবিক থাকালেও অন্যান্য আবাসিক এলাকায় এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে পানির সংকট। দিন যতই যাচ্ছে পানি সংকট বাড়ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে যাত্রাবাড়ী, কাজলা, শনিরআখড়া, দোলাইপাড়, জুরাইন মাদরাসা রোড, মিষ্টির দোকান, পার গেন্ডারিয়া, আর্সিন গেট, পোস্তগোলা, ফরিদাবাদ, মিলব্যারাক শ্যামপুর, ধলেশ্বর, পুরান ঢাকার বাংলাবাজার, সূত্রাপুর, শ্যামবাজার আশেপাশের এলাকা, মাতুয়াইল, মান্ডা, মুগদা শেখটেক, খিলগাঁও তিলপাপাড়া, মগবাজার এলাকায় কয়েকটি মহল্লায়, আজিমপুর এলাকার বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে পানির সংকট। এছাড়া রাজধানীর অনেক স্থানে কম-বেশি পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
পানি সংকটের আরেক কারণ হলো বর্তমানে রাজধানী ঢাকায় ওয়াসার পানি সরবরাহ লাইনের সংস্কার ও অধুনিকায়ন কাজ চলছে। এরজন্য চলছে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি। এতে অনেক এলাকায় পানি সরবরাহে বিঘœ ঘটছে। এ কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকাসমূহে পানির সংকট আরও বেড়ে গেছে।
সূত্র বলছে, নাখালপাড়া, ধানমন্ডিসহ অনেক এলাকায় সমস্যা বেশি হচ্ছে পানির সরবরাহ লাইন আধুনিকায়ন কাজের জন্য। ওয়াসার সরবরাহ লাইন অনেক স্থানে পুরনো ও ত্রুটিপূর্ণ থাকায় সরবরাহকৃত বিশুদ্ধ পানিতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দূষণ ঘটছে। এ কারণে রাজধানীবাসীর অনেকে খাবার পানি হিসেবে বিভিন্ন কোম্পানির বোতলজাত পানি গ্রহণ করছেন। দূষণ রোধে পুরনো ত্রুটিপূর্ণ পানির লাইন সরিয়ে নতুন চওড়া পাইপ বসানো হচ্ছে।
ঢাকা ওয়াসা সূত্রে বলা হয়েছে, ঢাকায় বাড়ছে অগণিত অট্টালিকা, প্রতিদিন বাড়ছে অসংখ্য মানুষ। সেইসাথে বাড়ছে বছরে ১০ শতাংশ হারে পানির চাহিদা। আর পানির এ বর্ধিত চাহিদা মেটাতে পারছে না ঢাকা ওয়াসা। বর্তমানে রাজধানীতে দৈনিক পানির চাহিদা ৩০০ কোটি লিটারের বেশি। আর ঢাকা ওয়াসা গড়ে পানি উৎপাদন করেছে ২৫০ কোটি লিটার। এর মধ্যে সিস্টেম লস হচ্ছে ২২ শতাংশ। চাহিদার বিপরীতে কম পানি উৎপাদন ও সরবরাহ এবং সেইসাথে পানির বড় ধরনের সিস্টেম লসের কারণে রাজধানীর পানি সংকট থেকে যাচ্ছে। এ সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিবছর পানির ১০ শতাংশ বর্ধিত চাহিদা।
ঢাকা ওয়াসার পানি সরবরাহ বিষয়ে ওয়াসা বলছে, রাজধানীর পানি সরবরাহ লাইনের সংস্কার ও আধুনিকায়ন চলছে। এ কাজ পুরোপুরি শেষ হলে রাজধানীবাসী এর দীর্ঘমেয়াদি সুফল পাবেন। বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার পানি ব্যবস্থাপনায় অনেক উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে দৈনিক ২৩০ কোটি লিটার পানির চাহিদার বিপরীতে ২৪২ কোটি লিটার পানি উৎপাদন হচ্ছে।
সূত্র বলছে, ২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার সিস্টেম লস ছিল ৪৪ শতাংশ। গত ৬ বছরে ঢাকা ওয়াসার সিস্টেম লস ৪৪ শতাংশ থেকে ২২ শতাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। সিস্টেম লস আরও কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এরই মধ্যে বিল খেলাপি ও অবৈধ সংযোগের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। লোডশেডিং-এর কথা বিবেচনায় রেখে সেসময় পাম্প চালানোর জন্য আড়াই শতাধিক জেনারেটর সংগ্রহ করা হয়েছে। লোডশেডিংয়ের সময় বিদ্যুৎ দ্বারা পাম্প চালানোর জন্য ২৫০টি পাম্পে ২টি ফিডার হতে বিদ্যুৎ সংযোগ অর্থাৎ দ্বৈত সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। ১৭৮ দশমিক ৫০ কিলোমিটার পানির লাইন স্থাপন করা হয়েছে ও ১৫৪ কিলোমিটার লাইন পুনর্বাসন করা হয়েছে।
ওয়াসা সূত্রে বলা হয়েছে, ঢাকার বর্ধিত পানি সমস্যা মেটাতে ঢাকা ওয়াসা ৫২১ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘তেঁতুলঝরা-ভাকুর্তা ওয়েল ফিল্ড কনস্ট্রাকশন প্রজেক্ট’ বাস্তবায়ন করছে। এ প্রজেক্ট হতে চলতি বছরে মিরপুর এলাকায় দৈনিক ১৫০ মিলিয়ন লিটার পানি সরবরাহ করা যাবে। এ প্রজেক্টের ৭০ শতাংশ ব্যয় বহন করছে কোরিয়া সরকার।
ওয়াসা ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর ওপর জোর দিয়েছে। রাজধানীর ভবিষ্যৎ পানি সংকট নিরসনের লক্ষ্যে পদ্মা নদী থেকে পানি এনে দৈনিক ৪৫ কোটি লিটার পানি সরবরাহের লক্ষ্যে পদ্মা (জশলদিয়া) পানি শোধনাগার নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে চীন। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শুরুর সময় থেকে প্রকল্পটি সম্পন্ন হতে প্রায় ৫ বছর সময় প্রয়োজন হবে। এছাড়াও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে মেঘনা নদী থেকে পানি এনে খিলক্ষেতে শোধনাগার স্থাপন করে রাজধানীতে দৈনিক ৫০ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করার অপর একটি প্রকল্প ঢাকা ওয়াসা গ্রহণ করেছে।
এদিকে পানির সংকটের আরেক কারণ হলো পানি অপচয়। ওয়াসার পক্ষ থেকে পানি অপচয় বন্ধে সচেতনা বৃদ্ধির কাজ চালিয়ে গেলেও বন্ধ হচ্ছে না পানি অপচয়। একদিকে সংকট অন্য দিকে পানির অপচয়ও বাড়ছে।
সূত্র বলছে, ঢাকা ওয়াসার দৈনিক উত্তোলিত ২২৫ কোটি লিটার পানির মধ্যে প্রায় ৫৭ কোটি লিটার, অর্থাৎ ২৫ শতাংশই অপচয় হয়। পুরান ঢাকার তুলনায় রাজধানীর ওয়াসার জরিপ অনুযায়ী, পুরান ঢাকায় পানির অপচয় হয় চোখের সামনে। কিন্তু অভিজাত এলাকায় অপচয় হয় আড়ালে এবং তা পরিমাণেও পুরান ঢাকার তুলনায় অনেক বেশি। অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানী-বারিধারা-ধানমন্ডিতে কোনো কোনো বাড়িতে বৈধ সংযোগের পাশাপাশি অবৈধ সংযোগও আছে। অবৈধ সংযোগের পানি দিয়ে গাড়ি ধোয়া, বাগানে পানি দেয়া, কুকুরকে গোসল করানোসহ বিভিন্ন কাজ করা হয়। অবৈধ সংযোগের পানি হওয়ায় এর সবই অপচয়ের খাতে পড়ে।
ওই জরিপ অনুসারে, রাজধানীর অনেক বাড়ির মালিক সময় বেঁধে পানি দেন। ফলে পানি ছাড়লেই এসব বাড়ির ভাড়াটেরা বড় ড্রাম, বালতি, গামলাসহ বিভিন্ন পাত্রে পানি ভরে রাখেন। পরের বার পানি দেয়ার সময় এসব পাত্রের উদ্বৃত্ত পানি ভাড়াটেরা ফেলে দিয়ে নতুন পানি ভরেন। এতে অনেক পানি অপচয় হয়। এ ছাড়া কেউ কেউ পানির আশায় বা ভুলে কল খোলা রেখেও পানির অপচয় করেন।
ওয়াটার এইড বাংলাদেশ-এর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় প্রতিবছর পানির স্তর নামছে তিন মিটার হারে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত এক দশকে রাজধানী ঢাকায় আড়াই মিটার হারে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছে, এই অবস্থা যদি আরো কয়েক দশক চলতে থাকে তবে দেখা দেবে পানির নিদারুণ অভাব, সেই সাথে ভূমিকম্পসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসবে।
বাংলাদেশ সময়: ১১:৩৩:০৪ ৪০৩ বার পঠিত