বঙ্গনিউজ ডটকমঃঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের আবাসিক হলগুলোর এক শয্যাবিশিষ্ট কক্ষের প্রায় ৬১ শতাংশই অছাত্রদের দখলে। এই অছাত্ররা হলেন মূলত ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতা-কর্মী, তাঁদের বন্ধু-স্বজন, চাকরিজীবী, চাকরিপ্রত্যাশী ও সাংবাদিক।
এর বাইরে দুই শয্যা ও চার শয্যার কক্ষগুলোতেও রয়েছে অনেক অছাত্র ও বহিরাগত। অথচ জায়গা না পেয়ে ‘গণরুম’, বারান্দা, ছাদ ও হলের ক্যানটিনের পাশে গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে সাধারণ ছাত্রদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের ১৩টি হলের ১১টিতে ৬ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুসন্ধান চালিয়ে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। হলগুলো হলো সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হল, শহীদুল্লাহ্ হল, জগন্নাথ হল, অমর একুশে হল, ফজলুল হক হল, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল, জহুরুল হক হল, সূর্য সেন হল, জসীমউদ্দীন হল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ও স্যার এ এফ রহমান হল।
এই ১১টি হলের মোট ধারণক্ষমতা ৭ হাজার ৪৩৭ জন। কিন্তু বাস্তবে কতজন থাকেন, তার কোনো হিসাব হল প্রশাসনের কাছে পাওয়া যায়নি। তবে প্রতিটি হল শাখা ছাত্রলীগের বিভিন্ন পক্ষের কাছে কক্ষভিত্তিক শিক্ষার্থীর নামধামসহ তালিকা রয়েছে। সে তালিকাগুলো সংগ্রহ করে এবং সরেজমিন সাধারণ শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে যে হিসাব পাওয়া গেছে তাতে দেখা যায়, ১১টি হলে ৭ হাজার ১৬৭ আসনের বিপরীতে থাকছেন প্রায় ১৩ হাজার ৮০০ জন।
হল কার্যালয়গুলোর হিসাব অনুযায়ী, উক্ত ১১টি হলে মোট ২ হাজার ৭৭৭টি কক্ষ আছে। এর মধ্যে এক শয্যার বা একক কক্ষ রয়েছে ৮০৭টি। দুই, তিন, চার ও পাঁচ শয্যার কক্ষ রয়েছে ১ হাজার ৯৭০টি।
হল ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করে দেখা যায়, এক শয্যাবিশিষ্ট ৮০৭টি কক্ষের মধ্যে ৪৮৯টি কক্ষ অর্থাৎ ৬১ শতাংশই অছাত্রদের দখলে। বাকি কক্ষগুলোর (একের অধিক শয্যার) মধ্যে ৯৭৮টি কক্ষে (জগন্নাথ হল ছাড়া) সাধারণ ছাত্রদের পাশাপাশি ১ হাজার ৯৮০ জন অছাত্র থাকছেন।
অথচ ‘আসন-সংকটের’ কারণে ৯৩টি ‘গণরুমে’ (চার ও পাঁচ শয্যার কক্ষ) গাদাগাদি করে থাকছেন ২ হাজার ৪৭৫ জন সাধারণ ছাত্র। কেউ কেউ পড়ালেখার জন্য সিঁড়িতে টেবিল বসিয়েছেন। সবার সেই সুযোগও নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা নিয়ম অনুযায়ী হলে উঠতে পারেন না। হলের নিয়ন্ত্রণ যখন যে ছাত্রসংগঠনের কাছে থাকে, তখন তারাই হলের কিছু কক্ষে প্রথম বর্ষের কিছু ছাত্রকে তোলার ব্যবস্থা করে। প্রথম বর্ষের ছাত্ররা চার বা পাঁচ শয্যার একেকটি কক্ষে অন্তত ৩০ জন থাকেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, ছাত্রদের আবাসনের বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে তদারক করার কথা হল কর্তৃপক্ষের। আসন খালি হওয়া সাপেক্ষে কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া এবং ভালো ফলধারী শিক্ষার্থীরা প্রাধান্য পাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে হলগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সে দলের ছাত্রসংগঠনের নেতারা। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের হলে তোলা, কে কোন কক্ষে থাকবেন—এসব নির্ধারণ করছেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। বেশির ভাগ হলের প্রাধ্যক্ষ এ ক্ষেত্রে নিজেদের অসহায়ত্বের কথা বলেছেন প্রথম আলোর কাছে।
অবশ্য ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আবিদ আল হাসান প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, হল প্রশাসনের মাধ্যমেই ছাত্ররা হলে ওঠেন। এতে ছাত্রলীগের কোনো ভূমিকা থাকে না। ছাত্রলীগ কিছু শিক্ষার্থীকে যাঁরা গরিব, ঢাকায় থাকার জায়গা নেই, তাঁদের হলে উঠতে সহযোগিতা করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের অধিকাংশ বিভাগের শিক্ষার্থী স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দিয়ে ফলের অপেক্ষায় রয়েছেন। এ হিসাবে ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরাই হলগুলোর সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ বৈধ বাসিন্দা হওয়া কথা। কিন্তু এর ছয়-সাত বছর আগের শিক্ষাবর্ষের অনেকেই এখনো হলের বাসিন্দা। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে চাকরি করছেন—এমন অনেকেসহ কিছু বহিরাগতও বিভিন্ন হলে দীর্ঘদিন বসবাস করছেন। অভিযোগ আছে, তাঁরা থাকছেন ছাত্রলীগের কোনো না কোনো নেতার ছত্রচ্ছায়ায়।
এই অভিযোগ সম্পর্কে ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি বলেন, ‘আমি এটা শুনেছি, তবে প্রত্যক্ষভাবে দেখিনি। যদি এমন থেকে থাকে, তবে অবশ্যই হল প্রশাসনের উচিত তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।’
আবাসিক হলগুলোতে এ দুর্দশার জন্য সাধারণ ছাত্র ও হল কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের অনেকে দায়ী করেছেন শিক্ষকদের। তাঁরা বলছেন, হল প্রাধ্যক্ষ ও আবাসিক শিক্ষকদের দেখা মেলে না। হল চালান ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
বঙ্গবন্ধু হলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোজাফফর আলী ফকির প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে আবাসিক শিক্ষকেরা প্রায় প্রতিদিনই হলে নিজেদের দায়িত্বাধীন কক্ষগুলোতে টহল দিতেন। ঘুরে ঘুরে দেখতেন কোন কক্ষের কী অবস্থা। কিন্তু এখন কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না।’
হলগুলোর পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এ বিষয়ে প্রাধ্যক্ষদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে তিনি আরও আবাসিক হলের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে বলেন, একটি থালা দিয়ে যেমন ১০ জনকে সুশৃঙ্খলভাবে খাবার দেওয়া সম্ভব নয়, তেমনি অল্পসংখ্যক আসন দিয়ে অধিক ছাত্রকে ভালো আবাসনসুবিধা দেওয়া সম্ভব নয়।
অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে এই নৈরাজ্যের জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী হচ্ছে হল প্রশাসন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি নিজেও একসময় অ্যাসিস্ট্যান্ট হাউস টিউটরের দায়িত্ব পালন করেছি। সে সময় হলের প্রভোস্ট (প্রাধ্যক্ষ) ছিলেন সর্বময় কর্তা। আমরা হাউস টিউটররা প্রতিদিন হলের বেয়ারাকে নিয়ে নিজ নিজ ব্লকে গিয়ে রোল কল করতাম। কে কোন কক্ষে আছে, কোনো বহিরাগত আছে কি না, সে বিষয়ে সকালে প্রভোস্টের কাছে রিপোর্ট দিতাম। এ ছাড়া তখন হলে হলে ছাত্র সংসদ ছিল, সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের সমস্যার কথা সেখানে বলতে পারত। যেহেতু প্রতিবছর নির্বাচন হতো, তাই ছাত্র সংসদের নেতারা আন্তরিকতার সঙ্গে হল প্রশাসনকে নিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতেন। কিন্তু এখন সেই জায়গাটিও আর নেই।’
বাংলাদেশ সময়: ১০:৪৩:০৬ ৪২৩ বার পঠিত