বঙ্গনিউজ ডটকমঃ আমেরিকার জাতীয় স্থাপত্যশৈলী কিংবা তার ধরন নিয়ে যদি প্রশ্ন রাখা হয়, তবে উত্তরটা হচ্ছে ‘আকাশচুম্বী অট্টালিকা’। স্থাপত্য রীতির আদি লগ্ন থেকেই আকাশমুখী উঁচু মিনার নির্মাণ ধারণার প্রচলন; তবে এ স্থাপত্য নকশাটা ব্যাপক আকার নেয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে যখন, আমেরিকানরা বহুতল ভবন নির্মাণের কাল্পনিক সব ধারণাকে বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়াস নেয়। এ চিন্তার পেছনে তাদের অবশ্য অন্যতম একটি উদ্দেশ্যও ছিল, আর তা হলো ভবনগুলোকে অত্যন্ত লাভজনক করে তোলা।
যদিও দেশটির প্রাচীন বহুতল অনেক ভবনের নির্মাণ নকশায় ছাপ রয়েছে ইতালির মেটলাইফ টাওয়ার কিংবা ১১৪০ শতকে আবির্ভূত ফরাসি ‘গথিক’ স্থাপত্যরীতির। দ্বাদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দী অবধি পশ্চিম ইউরোপে এ স্থাপত্য রীতির প্রচলন গম্বুজ ও খিলানসংবলিত রোমান স্থাপত্যের হাত ধরে।
তবে কয়েক দশক ধরে এককভাবে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজটি করে গেছে আটলান্টিক পাড়ের এ দেশটি। এমনকি ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদী স্থপতিদের অনেকে যখন ফিডরিখস্ট্রাসে কিংবা রাশিয়ার বিমানবন্দর বুলেভার্ড দে সিবাস্তপলের মতো নান্দনিক সব নির্মাণ নকশার আর্জি নিয়ে আটলান্টিক পাড়ি দেয়ার কথা ভাবছেন, তখন আকাশচুম্বী অট্টালিকার নির্মাণ ধারণা থেকে সরে আসেননি দেশটির নীতিনির্ধারকরা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন বিশ্বব্যাপী মোট ১৫০টি বহুতল ভবনের মধ্যে ১৪৭টির ঠিকানাই ছিল আমেরিকা। শ্রমশিল্পকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য এর চেয়ে ভালো উপায় আর কী হতে পারত! এক্ষেত্রে স্থাপত্যশৈলীকেও আমলে নেয়া হয়নি। মূলত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এ বৈশিষ্ট্যগুলোর জন্যই আকাশছোঁয়া ভবন নির্মাণের দিকে ঝুঁকে পড়ে দেশটি। আর ঠিক এমন একটি সময়ে আমেরিকানরা খুঁজে নেন ফজলুর রহমান খানকে; আকাশচুম্বী ভবন নির্মাণ ধারণার প্রবর্তক: বাংলাদেশে জন্ম নেয়া এক স্থপতি।
শুধু নতুন ধরনের নকশাকে আর নির্মাণরীতিকে পরিচিত করিয়ে দেয়া নয়, বিংশ শতকের নির্মাণ নকশাকেও ভীষণ রকম প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন এ ব্যক্তিত্ব। এফআর খানকে তাই বলা হয় টিউবুলার ডিজাইনের জনক। আমেরিকার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভবন উইলস টাওয়ার আর ১ হাজার ১২৭ ফুট উঁচু জন হ্যানকক সেন্টারের নকশাকার তিনি।
১৯২৯ সালের ৩ এপ্রিল ঢাকায় জন্ম নেন ফজলুর রহমান খান। বাবা গণিতের শিক্ষক ছিলেন, পাঠ্যবই লিখেছেন, কাজ করেছেন এ অঞ্চলের জনশিক্ষা পরিচালক হিসেবে। অবসর-পরবর্তী সময়ে জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাবাই মূলত ফজলুর রহমান খানের মনে প্রযুক্তিগত বিষয়গুলোকে ঘিরে আগ্রহের বীজটি বুনে দেন, সন্তানকে উৎসাহিত করেন কলকাতায় অবস্থিত বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমানে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি) থেকে ডিগ্রি নিতে। বাধ্য ছেলেটি তা করেছিলেন। এ প্রতিষ্ঠান থেকে স্নাতক পাঠক্রম সম্পন্ন করে আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমানে বুয়েট) থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর স্নাতক ডিগ্রি নেন।
মেধাবী ছাত্রটিকে এর পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৫২ সালে পাকিস্তান সরকারের বৃত্তির পাশাপাশি ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে তিনি আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। মাত্র তিন বছরে এ প্রতিষ্ঠান থেকে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও ইঞ্জিনিয়ারিং মেকানিক্স; দুটি বিষয়ের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রির পাশাপাশি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের বিরল কাজটি সম্পন্ন করেন ফজলুর রহমান খান। পিএইচডিতে তার থিসিসের বিষয় ছিল ‘অ্যানালিটিক্যাল স্ট্যাডি অব রিলেশনস অ্যামং ভেরিয়াস ডিজাইন ক্রাইটেরিয়া ফর রেকট্যাঙ্গুলার প্রেসট্রেসড কংক্রিট বিমস।’
পড়াশোনার পাঠ শেষ করে কিছুদিনের জন্য ঢাকায় এলেও আবার আমেরিকায় ফিরে যান, তবে এবার সেখানে গমনের উদ্দেশ্যটি ভিন্ন, পৃথিবীতে হাতেগোনা যে কয়টি স্থাপত্য ও প্রযুক্তি ফার্ম রয়েছে স্কিডমোর ওয়িংস অ্যান্ড মেরিলের (এসওএম) মধ্যে অন্যতম, ১৯৫৫ সালে এ প্রতিষ্ঠানটির আমেরিকা অফিসে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগদানের আহ্বান জানানো হয় তাকে।
আমেরিকান লেখক অ্যালেক্স উয়েনবার্গ তার একটি আর্টিকেলে এ প্রকৌশলী সম্পর্কে বলেছেন: ফজলুর রহমান খান এমন একটি দেশ থেকে এসেছেন, যেখানে সে সময় বহুতল ভবন নির্মাণের তেমন কোনো ইতিহাস ছিল না। তিনি কেবল নিজের পথে হেঁটেছেন আর এভাবেই তিনি স্থাপত্য ধারণার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হন। স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তনের পাশাপাশি তিনি আমেরিকানদের জন্য এমন সব স্থাপনা নির্মাণ করেছেন, যা নিয়ে তারা গর্ব করতে পারে।
টিউব স্ট্রাকচারাল সিস্টেম
আকাশচুম্বী ভবন নির্মাণ নকশার অন্যতম অন্তরায় কেবল এর কাঠামোগত ওজন নয়, এর পারিপার্শ্বিক ভার, যেমন: বাতাস, ভূমিকম্প— যা কিনা ভবনটির কাঠামোর ওপর বাড়তি চাপ প্রয়োগের সামর্থ্য রাখে। তীব্র বাতাস যখন উঁচু কোনো ভবনের বিপরীতে প্রবাহিত হয়, নিয়মমাফিক ভবনে তা আঘাত হানে। আর নির্মাণ ও নকশা দিয়ে এমন সংকট উত্তরণের জন্য ফজলুর রহমান খান প্রবর্তন করেন টিউব স্ট্রাকচারিয়াল পদ্ধতি; এর মধ্যে রয়েছে ফ্রেমড টিউব, ট্রাসড টিউব, বানডেল টিউব।
টিউব স্ট্রাকচার পদ্ধতিতে কংক্রিট আর ইস্পাত ব্যবহার করে উঁচু ভবন নির্মাণের সীমাবদ্ধতা জয় করার সঙ্গে কাজকে সহজ করেন তিনি। তার উদ্ভাবিত এ পদ্ধতিটি অনায়াসে প্রয়োগ করা যায় অফিস, অ্যাপার্টমেন্ট আর বহুমাত্রিক কাজে ব্যবহারিত ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে। ষাটের দশকে ফজলুর রহমান খানের নতুন এ নির্মাণ পদ্ধতিটি গোড়াপত্তন করে ৪০ তলা উচ্চতাসম্পন্ন ভবন নির্মাণ ধারাকে।
শিকাগোর হ্যানকক সেন্টারের নকশা করা হয় ১৯৬৫ সালে, ১০০ তলাবিশিষ্ট এ ভবনের নির্মাণে কালক্ষেপণ হয় মাত্র তিন বছর। ট্রাসড টিউব ব্যবহার করে স্ট্রাকচারাল ডিজাইন করাতে ১৯৬৯ সালেই নির্মাণকাজের ইতি টানতে সমর্থ হন ফজলুর রহমান খান ও তার সঙ্গীরা। আরো একটি উদাহরণ টেনে উইলস (সাবেক সিয়ার্স) টাওয়ারের কথা বলা যেতে পারে। ব্রুস গ্রাহামের নকশায় এ ভবনের নির্মাণ ইঞ্জিনিয়ার এফআর খান। ১৯৭০ সালে শিকাগো শহরে শুরু হয় ১০৮ তলাবিশিষ্ট এ ভবনটির নির্মাণকাজ। একে পরিপূর্ণ রূপ দিতে তিন বছরের বেশি সময় নেননি তিনি। নির্মাণ-পরবর্তী দুই দশক ধরে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবনের তকমাটি নিজের দখলে রেখেছিল ‘বান্ডেলড টিউব স্ট্রাকচারাল’ পদ্ধতি ব্যবহার করে তৈরি এ ভবনটি। পাশাপাশি ভবন নির্মাণে ইতিহাসে নতুন একটি শব্দ যোগ হয়েছিল তখন: টিউব স্ট্রাকচারাল সিস্টেম।
আটপৌড়ে নির্মাণ পদ্ধতিকে সরিয়ে নতুন ধারণার প্রবর্তনের পাশাপাশি ভবনের ভেতরের ইন্টেরিয়র ধারণাকে ভেঙেচুরে দিয়েছিলেন এ প্রকৌশলী। তার উদ্ভাবিত ‘টিউবুলার’ পদ্ধতি ঘরের ভেতরে অতিরিক্ত পরিসরের জোগান দেয়ার পাশাপাশি স্থাপত্য নকশাকে বাড়তি স্বাধীনতা উপভোগে পথ দেখিয়েছিল সেদিন। এতটুকু নয়, ভবন নির্মাণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত ঠিকাদার, প্রকৌশলী, স্থপতি আর বিনিয়োগকারীদের জন্য নতুন অর্থ আয়ের উন্মুক্ত পথের দিকনির্দেশনাও দিয়েছিল এটি।
আবাসন শিল্পের অর্থনৈতিক জোয়ার শুরু হয় এভাবে, ফজলুর রহমান খানের হাত ধরেই। ছোট ছোট প্লটে উঁচু ইমারত আর হাজারো লোকের আবাসনের বন্দোবস্ত— রিয়েল স্ট্রেট কোম্পানিগুলোর জন্য অর্থ উপার্জনের নতুন দ্বার খুলে দিয়েছিল নিশ্চয়ই। গোটা ষাটের দশক নিজের এ প্রকৌশলশৈলী দিয়ে নির্মাণশিল্পকে শাসন করেছেন এ বাঙালি।
১৯৬৩ সাল থেকে খানের উদ্ভাবিত ফ্রেমড টিউবস প্রভাবিত করে আকাশচুশ্বী অট্টালিকার নকশা ও নির্মাণকে। শিকাগোর চেস্টনাট-ডিউইট অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণে প্রথম ফ্রেমড টিউবস ব্যবহার করেন খান। কল্পনাকে বস্তবে রূপদান আর উদ্ভাবনীশক্তির অধিকারী অন্যন্য এ মানুষটি এভাবেই একের পর এক ভবন নির্মাণের কাজকে গতি দিয়েছেন তার সময়ে। ভবন নির্মাণে ফ্রেমড টিউবের কার্যকারিতার পাশাপাশি সুবিধাগুলোও মুহূর্তেই বুঝে গিয়েছিলেন অন্য প্রকৌশলীরাও, তারই ফলাফল শিকাগো অ্যামোকো বিল্ডিং, নাম পরিবর্তন হয়েছে বলে বর্তমানে এ ভবনটিকে ডাকা হয় এয়ন সেন্টার বলে। নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার নির্মাণেও জড়িত ছিলেন খান। তবে মজার বিষয়টি হলো, সে সময় সর্বত্র ফ্রেমড টিউবের জয়জয়কার হলেও খানের চোখে এ নকশার অসঙ্গতি ধরা পড়ে। আর তা হলো কংক্রিট বিম ও কলামের ক্রমবর্ধমান নমনীয়তার অসঙ্গতি।
জন হ্যানকক সেন্টার এবং ট্রাসড টিউব
জন হ্যানকক সেন্টার নির্মাণের প্রাথমিক ধারণাটা আসে ঠিকাদার জেরি ওলম্যানের মাধ্যমে। একটি প্লটে ছোট দুটি আলাদা বিল্ডিং— এমন ছিল শর্ত। একই ভবনের বড় পরিসরে অফিস আর অল্প পরিসরে অ্যাপার্টমেন্ট— এসওএম ফার্মের স্থাপত্য নকশাকারদের এমন কথা শুনে প্রায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হওয়ার জোগাড়। তবে শেষে, স্থপতিদের দলটি নকশায় দৈর্ঘ্য-প্রস্থ আর উচ্চতার মধ্যে সমন্বয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রকৌশলী ফজলুর রহমান খান দেখলেন এ ভবনের নির্মাণ প্রক্রিয়াটি তাকে ট্রাসডি টিউব ব্যবহারের সুযোগ করে দেবে। এ পদ্ধতিটি তিনি যৌথভাবে উদ্ভাবন করেছিলেন মিকিও সাসাকির সহযোগিতায়, যিনি ছিলেন ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির শিক্ষার্থী।
অন্যান্য কাজ
কেবল আকাশচুম্বী নয়, ভিন্ন ধরনের নকশার নির্মাণ প্রকৌশলী হয়েও কাজ করেছে খান। যার মধ্যে রয়েছে সৌদি আরবের কিং আবদুলআজিজ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, কিং আবদুলআজিজ ইউনিভার্সিটি, আমেরিকার এয়ার ফোর্স একাডেমি। কিং আবদুলআজিজ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের প্রকৌশলী হিসেবে তাকে সম্মানিত করা হয় আগা খান পুরস্কারে।
কম্পিউটার এইডেড ডিজাইন
সত্তরের দশকের কথা, প্রকৌশলীরা সবে কম্পিউটার ব্যবহার করে ভবনের স্ট্রাকচার বিশ্লেষণের কাজ শুরু করেছেন। এসওএম ছিল নির্মাণ নকশায় দারুণ সব নতুন পদ্ধতি আর প্রযুক্তির উন্নয়ন কেন্দ্র, যার নেপথ্যের মানুষটিও ছিলেন ফজলুর রহমান খান। কম্পিউটারের মাধ্যমে নকশা করা ও তা পরিমার্জন ও বিশ্লেষণের জন্য তিনি প্রবর্তন করেন ‘কম্পিউটার এইডেড ডিজাইন’ (ক্যাড)। এ সফটওয়্যারের সাহায্যে স্থপতিদের নকশা করার প্রক্রিয়াটি সহজ হওয়ার পাশাপাশি স্থাপত্য নকশার মান উন্নয়নে যোগ করেছে নতুন মাত্রা।
এই মহান প্রকৌশলী-স্থপতি উনিশ-বিশ শতকে জাহাজ থেকে লাফিয়ে নামা সেসব বাঙালি মুসলমানের একজন নন ঠিক, কিন্তু এফআর খানের আগে যারা শূন্য হাতে আমেরিকার মাটিতে পা রেখেছিলেন, অন্য অনেক অভিবাসীর সঙ্গে মিলে আজকের উন্নত আমেরিকা গড়ে তুলতে সাহায্য করেছেন, এফআর খান তাদেরই পরবর্তী প্রজন্ম। আমেরিকা আবিষ্কারে-নির্মাণে ভূমিকা রাখা সেসব অজানা অনেকে মহৎ প্রাণের সঙ্গে তাই এই ক্ষণজন্মা পুরুষকেও সশ্রদ্ধ স্মরণ।
বাংলাদেশ সময়: ১৫:৪৪:৪৪ ৪৭৯ বার পঠিত