আওয়ামী লীগ
বঙ্গনিউজ ডটকমঃজাতীয় সম্মেলনকে ঘিরে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক জেলাগুলোর সম্মেলন অনুষ্ঠানে তোড়জোড় চলছে। এক যুগ বা এর বেশি সময় ধরে সম্মেলন হয় না এমন জেলাগুলোতে এবার সম্মেলন হচ্ছে। তবে দলের নেতারা বলছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেতৃত্ব নির্বাচন হচ্ছে গতানুগতিক, নিয়মরক্ষার। ভোটে নয়, কেন্দ্রীয় নেতারা সমঝোতার মাধ্যমে কমিটি করে দিচ্ছেন। তা-ও দুজনের, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একজন নেতা বলেন, কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোটে জেলা কমিটি করতে গেলে কোন্দল-সংঘাত বাড়বে।
এ ছাড়া অনেক স্থানে স্থানীয় সাংসদেরা পছন্দের নেতাদের দিয়ে বিভিন্ন ইউনিটের ‘পকেট কমিটি’ গঠন করে রেখেছেন। ফলে কাউন্সিলরদের ভোটে প্রকৃত নেতৃত্ব বাছাই করা কঠিন। এ জন্যই সমঝোতার ভিত্তিতে বেশির ভাগ কমিটি হচ্ছে। জাতীয় সম্মেলনে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও এভাবেই নির্বাচিত হয়ে আসছে।
আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে আগামী ২৮ মার্চ দলের জাতীয় সম্মেলনের তারিখ ঠিক করা হয়। ওই বৈঠকে ৮ থেকে ১৯ বছর ধরে সম্মেলন না হওয়া নয়টি জেলার সম্মেলনের সিদ্ধান্ত হয়। এগুলো হচ্ছে কুমিল্লা উত্তর ও দক্ষিণ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, চাঁদপুর, কক্সবাজার, ভোলা, শরীয়তপুর ও সুনামগঞ্জ। এর মধ্যে চাঁদপুর, কক্সবাজার ও কুমিল্লা উত্তর জেলার নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। বাকিগুলো চলতি মাসে হবে। এর বাইরে এক দশক ধরে ফরিদপুর, ময়মনসিংহ ও গাইবান্ধায় সম্মেলন হয় না। নারায়ণগঞ্জে সম্মেলন হয়েছিল ১৯ বছর আগে। এগুলোর তারিখ ঠিক করা হয়নি। তবে জাতীয় সম্মেলনের আগে করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে। আর আওয়ামী লীগের ৭৭টি সাংগঠনিক জেলা ও জেলা সমমর্যাদার মহানগর রয়েছে। ৬৫টির সম্মেলন হয়েছে, পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি সবগুলোর। প্রতিটি সম্মেলনেই কেন্দ্রীয় নেতারা যাচ্ছেন। সম্মেলনকে ঘিরে তোরণ নির্মাণ, ব্যানার-ফেস্টুনে ছেয়ে ফেলা হয়।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুসারে ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা বা পৌরসভায় সম্মেলনের মাধ্যমে তিন বছরের জন্য নতুন কমিটি হবে। এরপর হবে জেলা বা মহানগর কমিটি। জেলা ও মহানগরের নির্বাচিত নেতৃত্ব থেকে একটা অংশ (প্রতি ২৫ হাজার মানুষের জন্য একজন) কাউন্সিলর হিসেবে জাতীয় সম্মেলনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্বাচন করবেন। কিন্তু দলীয় কোন্দলের কারণে অনেক জেলায় তিন বছর থেকে দুই দশক পর্যন্ত সম্মেলন হয়নি। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সম্মেলন অধিকাংশেরই হয়নি। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সব স্তরে নির্বাচিত কমিটির মেয়াদ তিন বছর। তবে নতুন কমিটি নির্বাচনের আগ পর্যন্ত দায়িত্ব চালিয়ে যাওয়ার কথাও বলা আছে। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, জেলা সম্মেলনগুলো খুবই উৎসাহ-উদ্দীপনার মাধ্যমে হচ্ছে। সম্মেলনকে ঘিরে জেলাগুলোর রাজনীতি খুব চাঙা। সমঝোতার কমিটি সম্পর্কে তিনি বলেন, যেখানে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচন করা যায়, সেখানে ভোটাভুটির দরকার কী? আর যেখানে সমস্যা, সেখানে তো ভোট হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ দলীয় সূত্র জানায়, গত শনিবার কুমিল্লা দক্ষিণ জেলার দুই সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এখানে সম্মেলন নয়, ডাকা হয়েছিল কর্মিসভা। এতে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমসহ অন্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন। ওই সভায় আ হ ম মোস্তফা কামালকে সভাপতি ও মুজিবুল হককে সাধারণ সম্পাদক করলে কারও আপত্তি আছে কি না, জানতে চাওয়া হয়। তখন কেউ আপত্তি করেননি। এরপরই দুজনের কমিটি ঘোষণা করা হয়। ১৫ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করারও নির্দেশনা দেন কেন্দ্রীয় নেতারা। কুমিল্লা দক্ষিণ জেলার সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিল ১৯৯৫ সালে। ওই কমিটির সভাপতি খোরশেদ আলম মারা গেছেন এবং সাধারণ সম্পাদক আফজল খান দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। ২০০৬ সালে ওই কমিটি ভেঙে দেওয়ার পর আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে চলেছে এত দিন। কুমিল্লা দক্ষিণ জেলারও কমিটি গঠনের তারিখ ঠিক করা হয়েছে ১৩ ফেব্রুয়ারি। স্থানীয় একজন নেতা বলেন, এখানেও হাত তুলেই কমিটি গঠন হয়ে যাবে।
গত ৩১ জানুয়ারি কক্সবাজারে সম্মেলন হয় ১২ বছর পর। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামসহ কেন্দ্রীয় নেতারা সভাপতি হিসেবে নাম ঘোষণা করেন আগের কমিটির যুগ্ম সম্পাদক সিরাজুল মোস্তফাকে আর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পৌর সভাপতি মুজিবুর রহমানকে। এখানেও দুই সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয় সমঝোতার ভিত্তিতে। নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব গঠন করা হবে বলে কাউন্সিলরদের ডাকা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর হয়নি। আগের কমিটির সভাপতি মারা যাওয়ার পর নয় বছর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি দায়িত্ব পালন করেন।
চাঁদপুরে সম্মেলন হয় ২৭ জানুয়ারি। এ উপলক্ষে চাঁদপুর শহরে সম্ভাব্য পদপ্রত্যাশীরা ব্যানার-ফেস্টুনে ভরে ফেলেন। জাতীয় নির্বাচনের মতো প্রচার চালান। কিন্তু শেষমেশ দুজনের কমিটি ঘোষণা করে ঢাকায় চলে আসেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলামসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। এখন পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের প্রস্তুতি চলছে।
সাধারণ সম্পাদক পদ প্রত্যাশী ছিলেন এমন একজন নেতা বলেন, সভাপতি পদে তিনজন ও সাধারণ সম্পাদক পদে ১২ জন আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতারা জানিয়ে দেন যে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব দুজনকে ঠিক করে রেখেছেন। এরপর হতাশ হওয়া ছাড়া আর কী করার আছে?
চাঁদপুর জেলায় সভাপতি হয়েছেন সদরের পৌর মেয়র ও ১৭ বছর ধরে পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করা নাসির উদ্দিন আহমেদ আর আগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম পাটোয়ারী স্বপদে রয়ে গেছেন। এ জেলায় এর আগের সম্মেলন হয়েছিল ২০০৫ সালে।
আওয়ামী লীগের দপ্তর সূত্র জানায়, ২০০৭ সালের পর ১৮ ফেব্রুয়ারি ভোলা জেলা সম্মেলন হবে। আর ১৯ বছর পর ১৯ ফেব্রুয়ারি সম্মেলন হতে যাচ্ছে কিশোরগঞ্জে। ২৩, ২৫ ও ২৭ ফেব্রুয়ারি যথাক্রমে নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ও শরীয়তপুর জেলার সম্মেলনের তারিখ ঠিক করা আছে। এর মধ্যে সুনামগঞ্জে সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিল ১৯ বছর আগে। সভাপতি মারা গেছেন আর সাধারণ সম্পাদককে ২০০১ সালে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই চলছে দল। নেত্রকোনা ও শরীয়তপুরে সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিল এক যুগেরও আগে।
নেত্রকোনা আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেন, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ঠিক করে কেন্দ্র। এতে সাংসদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। আর পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঠিক করেন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। পদ পাওয়া না-পাওয়া শুধু দলীয় কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভর করে না, পছন্দ-অপছন্দই মূল।
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, বাংলাদেশে কোনো দলই তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত নিয়ম মেনে নেতৃত্ব নির্বাচন করে না। এরপরও আওয়ামী লীগ সময়মতো কাউন্সিল করে। আরেকজন সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, সমঝোতার মাধ্যমে হয় বলে অনেকেই নিজেকে বঞ্চিত মনে করেন। আবার ভোট করতে গেলে সংঘাতের আশঙ্কা থেকে যায়। ক্ষমতাসীন দলের পদ তো এখন ‘সোনার হরিণ’।
বাংলাদেশ সময়: ১১:০৫:০২ ২২৪ বার পঠিত