গোবিন্দপুরের রাশেদুল ইসলামের পরিবারের দিন কাটে অভাব–অনটনে। সংসার চালাতে রাশেদুলের স্ত্রী সুমি আকতার (বঁায়ে) করেন সেলাইয়ের কাজ আর মা সালমা খাতুন অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ নিয়েছেন l প্রথম আলোবঙ্গনিউজ ডটকমঃঘর-ভিটে বন্ধক রেখেছেন। উপার্জনের কোনো মানুষ নেই। এক বেলা খাবার জুটলে আরেক বেলা জোটে না। অবর্ণনীয় কষ্টে দিন পার করছেন তাঁরা। খবর নেন না কেউ। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত ১০ লাখ টাকাও পাননি। গত বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি ভোরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার জগমোহনপুর এলাকায় দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া চকরিয়া উপজেলার তিন ব্যক্তির পরিবার এখন এমনই দুর্দশায় দিন কাটাচ্ছে।
পেট্রলবোমায় নিহত হারবাং ইউনিয়নের গাইনাকাটা গ্রামের বাসিন্দা মো. আবু তাহের, বরইতলী ইউনিয়নের গোবিন্দপুর এলাকার মো. ইউছুফ ও রাশেদুল ইসলাম চাকরি নিয়ে বিদেশে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়েছিলেন। ৪ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টায় ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কাতার পাড়ি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কাতার যাওয়ার স্বপ্ন ঢাকাপথেই বিলীন হয়ে যায় তাঁদের। তিনজনই নিজেদের বসতভিটা বন্ধক রেখে ভিসার টাকা জোগাড় করেছিলেন। এখন ভিসার টাকা তো গেছেই, পরিবারের জন্য রেখে গেছেন গলাসমান ঋণ।
৩ ফেব্রুয়ারি ছিল তাঁদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। এর আগের দিন ২ ফেব্রুয়ারি নিহত তিন ব্যক্তির বাড়িতে গেলে পরিবারের সদস্যরা নিজেদের দুর্দশার কথা তুলে ধরেন।
বোমা হামলায় নিহত ইউছুফের সংসারে স্ত্রী, তিন ছেলে ও দুই মেয়ে আছে। বড় ছেলে জাহেদুল ইসলাম শারীরিক প্রতিবন্ধী। ভালোভাবে হাঁটাচলা করতে পারেন না। তবু তিনি চার হাজার টাকা বেতনে একটি দোকানে চাকরি করেন। রাশেদুলের সংসারে তিন ও দেড় বছর বয়সী দুই ছেলে, স্ত্রী এবং মা রয়েছেন। তাঁর কোনো ভাই নেই। বাবাও মারা গেছেন তাঁর কিশোর বয়সে। আর নিহত আবু তাহের দুই সন্তানের জনক। ছেলে ইমনের বয়স ১৫ আর মেয়ে নাইমা জান্নাতের বয়স আট। সংসার চালাতে ইমন পড়ালেখা ছেড়ে লোহাগাড়ার আমিরাবাদে একটি ফার্নিচারের দোকানে দেড় হাজার টাকা বেতনে কাজ নিয়েছে।
ইউসুফের স্ত্রী ফরিদা বেগম বলেন, ‘মেয়ের বিয়ের স্বর্ণ বিক্রি করেছি, বসতভিটা বন্ধক রেখেছি, ঋণ নিয়েছি স্বামী বিদেশ গেলে সব দুঃখ-কষ্ট মুছে যাবে এ আশায়। কিন্তু কী থেকে যে কী হয়ে গেল? এখন ঋণের টাকার জন্য প্রতিদিন পাওনাদারেরা চাপ প্রয়োগ করছে। কেমনে শোধ করব এ টাকা?’
রাশেদুল ইসলাম ওরফে বাদশার (৩০) স্ত্রী সুমি কাপড় সেলাই করেন। মা সালমা খাতুন সংসার চালাতে কাজ করেন অন্যের বাড়িতে। সুমি আকতার বলেন, ‘বড় ছেলে রাহাতের বয়স তিন বছর। সে সব বোঝে। এখনো রাতে ঘুম ভাঙলে বাবাকে খোঁজে, কান্না করে।’
আবু তাহেরের স্ত্রী নুরজাহান বেগম তাঁর স্বামীর মৃত্যুর জন্য নষ্ট রাজনীতি ও ক্ষমতালোভী নেতা-নেত্রীদের দায়ী করেন। তিনি বলেন, ‘কী দোষ ছিল তার, কেন তাকে মরতে হলো। সে তো রাজনীতি করত না, তারা কেন আমার স্বামীকে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছে? তাদের কি বিচার হয়েছে?’
নুরজাহান বলেন, এ পর্যন্ত কোনো দলের নেতা তাঁদের খবর নেয়নি। প্রধানমন্ত্রী ১০ লাখ টাকা দেবেন বলেছিলেন, কিন্তু সে টাকাও পাননি। অন্য এলাকার যাঁরা বোমা হামলায় নিহত হয়েছিলেন, তাঁরা সবাই টাকা পেয়েছেন। কিন্তু কেন টাকা পাচ্ছেন না জানেন না তিনি।
এ প্রসঙ্গে ১ জানুয়ারি রাতে মুঠোফোনে কথা হয় চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাহেদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নিহত ব্যক্তিদের পরিবার যাতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত টাকা পায়, সে জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কুমিল্লা ও কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এ পর্যন্ত দুবার চিঠি পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘টাকা পেতে কেন এত দেরি হচ্ছে, সেটি বুঝতে পারছি না। এ ব্যাপারে আবারও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করব।’
বাংলাদেশ সময়: ১০:০৬:০৭ ১১৬১ বার পঠিত