সাতসকালে শরীরের একটু কসরত—হতে পারে সেটি ব্যায়াম, হাঁটাহাঁটি কিংবা অন্য কিছু। এ অভ্যাস বদলে দিতে পারে যে কারও প্রতিদিনের বেঁচে থাকা। ভোরবেলায় ঢাকার বিভিন্ন পার্কে কয়েক দিন ঘুরে তেমনই কিছু চিত্র তুলে ধরা হলো
বঙ্গনিউজ ডটকমঃদিনে কিছুটা গরম পড়লেও সকালটা এখনো ঠান্ডা, কুয়াশাচ্ছন্ন। ঘাসের ডগায় লেগে আছে শিশিরবিন্দু। কয়েকজন মিলে এই ঘাসের ওপর একটি নির্দিষ্ট জায়গাজুড়ে বিছিয়ে দিলেন পাটি। সেখানে জড়ো হয়েছেন জনা ত্রিশেক লোক। হঠাৎ একজনের ডাক। বোঝা গেল সবাইকে প্রস্তুত হওয়ার ইঙ্গিত দিলেন, তিনিই নির্দেশক। ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল পৌনে সাতটা বাজে। এরপর শুরু হলো তাঁদের ব্যায়াম—শুরুটা করলেন দুই পা ফাঁক করে লাফ দিয়ে মাথার ওপর দুই হাতের তালু লাগানোর চেষ্টা করে। তাঁদের কাছে এটি ‘ওয়ার্ম আপ’ বলে পরিচিত। ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রমনা পার্কের শতায়ু অঙ্গনের কাছে খোলা মাঠে গিয়ে দেখা গেল এই চিত্র।
কথা বলে জানা গেল, সেখানে শারীরিক কসরত করা সবাই ‘রমনা উষা সংঘ’-এর সদস্য। বেশির ভাগেরই বয়স পঞ্চাশের ওপারে। কেউ চাকরি করেন, কেউ আবার অবসর নিয়েছেন। আছেন ব্যবসায়ীও। কথা হয় সংঘটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘১৯৮৫ সাল থেকেই প্রতিদিন সকালে একই নিয়মে শরীরচর্চা করে যাচ্ছেন এই সংগঠনটির সদস্যরা।’ গত ৩১ বছর ধরে একই নিয়মে চলা শারীরিক কসরত দেখা তখনো বাকি। সবাই আবার মনোযোগ দিলেন ব্যায়ামে। কখনো দাঁড়িয়ে, কখনো বসে কিংবা মাথা নুইয়ে শরীরচর্চা করছেন তাঁরা। উষা সদস্যরা সেদিন তিন ধাপে মোট ৩৪টি ব্যায়াম করেছিলেন। ওঠা-বসা, উচ্চ লম্ফ, সাইড বেন্ড, ঘাড়ের ব্যায়াম, বক্ষ প্রসারণ, হ্যান্ড লক, আপ ডাউনের মতো নানা ব্যায়াম রয়েছে সে সবের মধ্যে। শারীরিক ব্যায়াম সেরে বিরতি এক মিনিটের। তারপর আবার শুরু হয় যোগব্যায়াম। তখনো আসল চমকটা দেখার বাকি রয়েছে। যোগব্যায়াম শেষ হলে সবার মুখে হো, হা, হি, হি অট্টহাসি। মাঠজুড়েই শোনা যাচ্ছে হাসির শব্দ। উষা সংঘের এক কোচ জিয়াউর রহমান বললেন, ‘শরীর সুস্থ রাখতেই ব্যায়াম করি। একদিন ব্যায়াম না করলে দিনের কোনো কাজেই মনোযোগ দিতে পারি না।’ আর হাসির কারণ সম্পর্কে তিনি জানালেন, হাসি হচ্ছে মনের ব্যায়াম। এতে মন ভালো হয়। হৃৎস্পন্দনও ঠিক থাকে।
সকালবেলায় এই ব্যায়াম, এই হাস্যোজ্জ্বল সমাবেশ নিয়ে বারডেম জেনারেল হাসপাতালের ল্যাবরেটরি সার্ভিসেসের পরিচালক অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী বলেন, ‘একটু ভারী খাবার খেয়ে সকালের ব্যায়াম সারাটা ভালো। ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ডের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এই ব্যায়ামের ফলে। রক্ত সঞ্চালনও বৃদ্ধি পায়।’ আর হাসাহাসি করলে ‘এন্ডোরফিনস’ নামক একটি রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত হয়; যেটি মেজাজ শান্ত রাখতে সহায়তা করে বলে জানিয়েছেন এ চিকিৎসক।
শুধু রমনা উষা সংঘ নয়; রমনা পার্কে ব্যায়াম, হাঁটাহাঁটি, হাসাহাসি করেন এ ধরনের সংগঠন আরও রয়েছে। কিছু নিয়ম মেনে আগ্রহী ব্যক্তিরা যোগ দিতে পারবেন রমনা উষা সংঘ, শতায়ু অঙ্গন, প্রভাতি, কিছুক্ষণ, উজ্জীবনের মতো প্রায় ১৫টি সংগঠনের যেকোনো একটিতে।
ঢাকায় আরও বেশ কয়েকটি জায়গা রয়েছে, যেখানে কাকডাকা ভোরে মানুষজন আসে ব্যায়াম, হাঁটাহাঁটি করতে। সে রকমই একটি জায়গা রাজধানীর উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টর পার্ক। ৩০ জানুয়ারি সকালে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে বয়স্ক ব্যক্তিরা হাঁটাহাঁটি করছেন। সেখানে হাঁটতে আসা মানুষের হাঁটাহাঁটি কিছুক্ষণ ঘুরে দেখার পর দৃষ্টি যায় পার্কের এক কোনায় আটজনের একটি দলের দিকে। তখন তাঁরা হাঁটা শেষ করে বিভিন্ন ব্যায়াম সেরে নিচ্ছেন। এর একটু পরই শুরু করে দিলেন শাওলিন কুংফু। ব্যায়ামরত অবস্থা থেকে বিরতি নিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি পেশাজীবী শাহ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ জানান, ‘বন্ধুরা মিলে সাত বছরের বেশি সময় ধরে সকালবেলায় হাঁটাহাঁটি, ব্যায়াম ও শাওলিন কুংফু অনুশীলন করি।’ এঁদের সবার বয়স ৩০ পেরিয়েছে, একেকজন জড়িত আছেন নানা পেশায়। একেবারে প্রথম দিক থেকে তাঁদের সকালবেলার এ কাজে নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন শামসুৎ তাবরীজ। রোজ সকালে তাঁদের হাঁটাহাঁটি, ব্যায়াম ও শাওলিন কুংফু বেছে নেওয়া কেন? প্রশ্নটির উত্তরে শামসুৎ তাবরীজ বলেন, ‘প্রতিদিন এটা করলে শরীর সতেজ থাকে। ফলে সারা দিনের কাজে মনোনিবেশ করা যায়। এ ছাড়া শরীর সুস্থ রাখা আমাদের উদ্দেশ্য।’
রমনা, উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টর পার্কে গিয়ে যা জেনেছিলাম, তার চেয়ে একটু ভিন্ন কথা শোনা গেল ধানমন্ডি লেকপাড়ে সম্প্রতি হাঁটতে আসা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আলভি রহমানের মুখে। তিনি বলেন, ‘ক্যালরি নিয়ন্ত্রণে রেখে শরীরের ফিটনেস ধরে রাখার জন্য নিয়মিত হাঁটি।’ এই লেকের ৩২ নম্বর সেতু-সংলগ্ন ও রবীন্দ্রসরোবরের কাছে রয়েছে ব্যায়ামের বিভিন্ন সরঞ্জাম। অনেক তরুণকে হাঁটা শেষ করে সেসব সরঞ্জাম ব্যবহার করে শারীরিক ব্যায়াম করতেও দেখা যায়। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাঁটাহাঁটি ও ব্যায়ামের মাধ্যমে ক্যালরি কমানো তাঁদের উদ্দেশ্য। কিন্তু হাঁটলেই কি ক্যালরি কমে? যাঁরা ক্যালরি কমানোর জন্য হাঁটাহাঁটি করেন, তাঁদের জন্য শুভাগত চৌধুরীর পরামর্শ—হাঁটাহাঁটি ও ব্যায়ামের পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাস মেনে চলার।
হাঁটার উপকারিতা প্রসঙ্গে ডা. শুভাগত চৌধুরী বলেন, হাঁটা হলো সব ধরনের ব্যায়ামের মধ্যে সবচেয়ে উপকারী। স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য সবারই হাঁটা প্রয়োজন। নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস রক্ত সঞ্চালন, ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ডের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে। হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায়। হাঁটার নিয়ম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একজন মানুষের ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন হাঁটা উচিত। আর যাঁদের হাঁটতে কষ্ট হয়, তাঁরা বিরতি নিয়ে হাঁটতে পারেন।
বাংলাদেশ সময়: ১২:০৪:৩৫ ২৯৫ বার পঠিত