বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১০ স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন রাকিবুল ইসলাম। ৫ বছর ধরে বিভিন্ন চাকরির লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হচ্ছেন। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে আটকে যাচ্ছেন। তার দাবি ঘুষের টাকা না থাকার কারণে আজও তিনি বেকার। তিন বছর ধরে পরীক্ষা আর ভাইভা দিয়ে চোখে-মুখে হতাশা নিয়ে ঘুরছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকে স্নাতকোত্তর মফিজুলও। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশে কর্মক্ষম ২৬ লাখ ৩০ হাজার মানুষ বেকার। এর মধ্যে পুরুষ ১৪ লাখ, নারী ১২ লাখ ৩০ হাজার। যা মোট শ্রমশক্তির সাড়ে ৪ শতাংশ। তিন বছর আগে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ ৯০ হাজার। এক দশক আগে ছিল ২০ লাখ। এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বিবিএস যে পরিসংখ্যান দিয়েছে, প্রকৃত বেকার আরও বেশি। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে ৫ শতাংশের বেশি বেকার, সেখানে বাংলাদেশে সাড়ে ৪ শতাংশ বলা হচ্ছে। এটি গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, বর্তমান চাকরির বাজারে যোগ্যতা ও দক্ষতা খুবই কম। সনদ অনুযায়ী চাকরি মিলছে না। বাজারের চাহিদার সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থা সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়ায় শিক্ষিত বেকার বেড়েই চলছে। এদিকে বিশ্বব্যাংক মনে করে, সরকার কম দেখালেও প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। এর ওপর প্রতিবছর নতুন করে ১৩ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছে। সুতরাং নতুন কর্মসংস্থান তৈরির চাপ রয়েছে অর্থনীতির ওপর। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের হার ২ শতাংশ বাড়ানো গেলে প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশে উন্নীত হবে। আবার আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের (আইএলও)-এর ‘বিশ্ব কর্মসংস্থান ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি-২০১৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানা গেছে, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে বেকারত্ব বৃদ্ধির হার ৪.৩৩ শতাংশ। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০১৬ সাল শেষে মোট বেকার দ্বিগুণ হবে। সংস্থাটির মতে, বেকারত্ব বাড়ছে এমন ২০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান ১২তম। আবার লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) তথ্যমতে, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। ভারত ও পাকিস্তানে প্রতি ১০ জন শিক্ষিত তরুণের তিনজন বেকার। বিবিএসের হিসাবে, এক দশকে ১১ লাখ ৩০ হাজার মানুষের নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে। ফলে দেশে কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ কোটি ৮৭ লাখে। এর মধ্যে পুরুষ কর্মজীবী চার কোটি ১৮ লাখ এবং নারী এক কোটি ৭০ লাখ। বিশ্বব্যাংকের কারিগরি সহযোগিতায় ২০১৫ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জরিপ করেছে বিবিএস। এটিই ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে প্রথম শ্রমশক্তি জরিপ। এর আগে বিবিএস তিন থেকে পাঁচ বছর পর পর শ্রমশক্তি জরিপ করতো। এতে মৌসুমভিত্তিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কোনও ধারণা পাওয়া যায় না। এ জন্য ত্রৈমাসিক জরিপ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিবিএস। ৩০ হাজারেরও বেশি নমুনা নিয়ে প্রথমবারের মতো জরিপটি পরিচালনা করা হয় গত বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, শ্রমশক্তির বাইরে থাকা মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। বর্তমানে সাড়ে চার কোটি মানুষ শ্রমশক্তির বাইরে আছে। এর অধিকাংশই নারী। প্রায় তিন কোটি ৫২ লাখ নারী শ্রমশক্তির বাইরে। ২০১৩ সালে এ সংখ্যা ছিল তিন কোটি ৬১ লাখ। পরিসংখান অনুযায়ী, বেকারত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার দিক দিয়ে এগিয়ে আছে শহরের মানুষ। ২০০৫ সালে শহরে কর্মজীবী ছিল এক কোটি ১৩ লাখ। ২০১৫ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক কোটি ৬৪ লাখে। এ সময়ে গ্রামে কর্মজীবী বেড়েছে মাত্র চার লাখ। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) তথ্যমতে, ১৯৯০ থেকে ১৯৯৫ সালে ১৫-২৪ বছর বয়সী বেকার যুবকের সংখ্যা ছিল ২৯ লাখ। কিন্তু ২০০৫ থেকে ১০ সালের মধ্যে তা প্রায় পাঁচ গুণ বেড়ে দাঁড়ায় এক কোটি ৩২ লাখে। এখন এটি আরও কয়েক গুণ বেড়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে ২২ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। কিন্তু কাজ পায় মাত্র সাত লাখ। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ইউজিসির সর্বশেষ প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে (২০১৩) বলা হয়, ২০১৩ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৩৭টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৪ লাখ ১২ হাজার ৯০৪ জন শিক্ষার্থী স্নাতক শেষ করেছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করেছেন ৫৪ হাজার ১৬০ জন। সেই হিসেবে এক বছরে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ স্নাতক বের হচ্ছেন। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন প্রথম শ্রেণির চাকরিতে নিয়োগ দিয়েছে ১২ হাজারের কম। এক বছরে ব্যাংক, দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরি ও বেসরকারি চাকরিতে দেড় লাখের বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। ফলে প্রায় অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থীকেই চাকরির জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক, অর্থনীতিবিদ ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে চাকরির সমন্বয় না থাকার কারণেই এমনটা হচ্ছে। অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির আলোকে শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করা জরুরি। বিবিএসের হিসাবে, এক দশক আগে অর্ধেকের বেশি মানুষ কৃষিভিত্তিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত ছিল। এখন ৫৬ শতাংশ মানুষ কৃষিবহির্ভুত খাতে নিয়োজিত। কর্মজীবীদের মাসিক আয়ের একটি হিসাবও করেছে বিবিএস। এতে দেখা গেছে, অর্ধেক কর্মজীবী মানুষ মাসিক ভিত্তিতে বেতন পেয়ে থাকে। এসব মানুষের গড় আয় ১১ হাজার ৬৮২ টাকা। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সিনিয়র সদস্য ড. শামসুল আলম বলেন, পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হলে আড়াই লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। গত কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি হয়েছে। এর বাইরে বাণিজ্য বড় হয়েছে এবং অর্থনীতির বহুমুখিতার কারণে বেকারের সংখ্যা বাড়ার কথা নয়।
বাংলাদেশ সময়: ১:৫৩:০০ ৫১৭ বার পঠিত