বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ
নেপাল এবং ভারতের অস্থিতিশীল প্রভাবে চলতি বছরে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে। যার কেন্দ্রস্থল হতে পারে বাংলাদেশের খুব নিকটে। এর মধ্যে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়কে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বলছেন ভূ-তত্ত্ব বিজ্ঞানীরা। ভূ-তত্ত্ববিদরা বলছেন, ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। বার বার কড়া নাড়ছে মাঝারি ও ছোট আকারের ভূমিকম্প। মূলত টেকটনিক প্লেটের সংঘর্ষে ভূমিকম্প হয়। বাংলাদেশ এ ধরনের তিনটি প্লেটের মধ্যে অবস্থিত। এ ছাড়া দেশের মধ্যে থাকা চ্যুতি বা ফল্ট লাইনগুলো যে কোনো সময় ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ ভূমিকম্প। এরই মধ্যে সোমবার ভোরে ভারত ও বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। ভূ-তত্ত্ব বিজ্ঞানীরা বলছেন, রিখটার স্কেলে কম্পনের মাত্রা ছিল ৬.৭ থেকে ৬.৮। প্রাথমিকভাবে নেপালের ভূ-তত্ত্ব বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে মণিপুরের ইম্ফল থেকে প্রায় ৩৩ কিলোমিটার দূরের তামেনলং ছিল ভূমিকম্পের উৎসস্থল। গত বছরের ২৫ এপ্রিল নেপালের কাঠমান্ডু থেকে ৭০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে নির্জন পাহাড়ি এলাকায় ভয়াবহ ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়। এর প্রভাব পড়ে ভারত ও বাংলাদেশে। ভূবিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবী প্লেট ও সাব-প্লেট দিয়ে গঠিত। এ রকম দু’টি প্লেটের মাঝখানে যে ফাঁক থাকে তাকে বলা হয় ফল্ট লাইন। প্লেটগুলো গতিশীল। দু’টি চলন্ত প্লেটের ফল্ট লাইনে পরস্পর সংঘর্ষ হলে অথবা হঠাৎ ফল্ট লাইনে শূন্য অবস্থার সৃষ্টি হলে ভূমিকম্প হয়। বাংলাদেশ অবস্থান করছে ভারতীয়, ইউরেশীয় ও মিয়ানমারের টেকটনিক প্লেটের মধ্যে । ভূ-তত্ত্ব বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ভারতীয় ও ইউরেশীয় প্লেট দু’টি (১৯৩৪ খ্রীষ্টাব্দের পর থেকে) দীর্ঘদিন ধরে হিমালয়ের পাদদেশে আটকা পড়ে আছে। কিন্তু বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি ভূ-তাত্ত্বিক চ্যুতি এলাকা বা ফল্ট জোন সচল অবস্থায় রয়েছে। ২০১৫ সালের অভিজ্ঞতা দেশের জন্য আশঙ্কাজনক: ২০১৫ সালের অভিজ্ঞতা দেশের জন্য আশঙ্কাজনক বলে মন্তব্য করেছেন ভূ-তত্ত্ব বিজ্ঞানীরা। কারণ, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সালে কমবেশি ৩০ বারের মতো ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর মধ্যে বছরের শুরুতে অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দেশে ভূমিকম্প অনুভূত হয় ২০ দফা। এবার বছরের প্রথম সপ্তাহেই ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এপ্রিল পর্যন্ত কি হয়, সেটাই এখন ভূ-তত্ত্ব বিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয়। আশঙ্কাজনক বিষয় হচ্ছে, গত বছরের প্রথম দিকে দুবারের ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল বাংলাদেশের ভেতর। তবে এগুলোর তীব্রতা ছিল কম। এর মধ্যে বছরের শুরুতে ৯ জানুয়ারি ৩ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এর কেন্দ্র ছিল ভৈরব বাজার। এ ছাড়া ৮ এপ্রিল ৪ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এর কেন্দ্র ছিল বাগেরহাটের শরণখোলা। বুয়েটের গবেষকদের ভূমিকম্প ঝুঁকির মানচিত্রে দেখা যায়, বাংলাদেশের ৪৩ শতাংশ এলাকা ভূমিকম্পের উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে (জোন-১), ৪১ শতাংশ এলাকা মধ্যম (জোন-২) ও ১৬ শতাংশ এলাকা নিম্ন ঝুঁকিতে (জোন-৩) রয়েছে। জোন-১-এ রয়েছে- পঞ্চগড়, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার সম্পূর্ণ অংশ এবং ঠাকুরগাঁও, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারের অংশবিশেষ। রাজশাহী, নাটোর, মাগুরা, মেহেরপুর, কুমিল্লা, ফেনী ও ঢাকা রয়েছে জোন-২-এর অধীনে। জোন-৩-এর মধ্যে রয়েছে বরিশাল, পটুয়াখালী এবং সব দ্বীপ ও চর। তিক্ত অতীত অভিজ্ঞতা: পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে ভূমিকম্প হলে এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও। এমনকি ভারতে ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার পর বাংলাদেশেও কিছুদিন পর ভূমিকম্প হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান মতে, ১৮৬৯ সালের ১০ জানুয়ারি ভারতে (কেন্দ্র) ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এরপর ১৮৮৫ সালে বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন ভারতবর্ষে আঘাত হানে ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক’। এটা আজও পৃথিবীর অন্যতম বড় ভূমিকম্প হিসেবে পরিচিত। এই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল ভারতের শিলং শহর। এর প্রভাব বাংলাদেশসহ বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় ঢাকায় অবস্থিত মিশনারীদের বিভিন্ন ভবন ভেঙে পড়েছিল এই ভূমিকম্পের কারণে। এ ছাড়াও অনানুষ্ঠানিকভাবে ঢাকায় প্রায় ৪৫০ জন মানুষ মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছিল। এরপর দেশে ১৯১৮ সালের ৮ জুলাই ৭ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এর কেন্দ্র ছিল বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গল। ১৯৩০ সালের ২ জুলাই ভারতে (কেন্দ্র) ৭ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ১৯৫০ সালের ১৫ আগস্ট আসামে হয় ৮ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প। ১৯৫৪ সালের ২১ মার্চ ভারতের মণিপুরে ৭ দশমিক ৪ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। ভারতের আসামে (কেন্দ্র) ৬ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয় ১৯৭৫ সালের ৮ জুলাই। ২০১১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ভারতের সিকিমে ৬ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এ ভূমিকম্পের কেন্দ্র বাইরে হলেও তীব্র কম্পন অনুভব করে বাংলাদেশ। ১৯৯৭ সালের ২২ নভেম্বর, চট্টগ্রামে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে ৫ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এ ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল বাংলাদেশের কক্সবাজারের মহেশখালী দ্বীপ। আন্তর্জাতিক গবেষণায় বাংলাদেশ সম্পর্কে সতর্কতা: কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশ সর্ম্পকে আশঙ্কাজনক তথ্য উপস্থাপন করা রযেছে। ভূমিকম্প সর্ম্পকে বিশ্বের নামিদামি আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ে পরিচালিত একটি প্রকল্পের ফলাফলের ভিত্তিতে এ ধরনের আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় ২০০৯ সালে। প্রকল্পটির প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে ‘বিনিথ বাংলাদেশ: দ্য নেক্সট গ্রেট আর্থকোয়েক’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ লিখেন বিখ্যাত সিসমোলজিস্ট কেভিন ক্রাজিক। সাথে ১০ মিনিটের একটি ডকুমেন্টারিও যৌথভাবে প্রকাশ করে নিউ ইয়র্কে অবস্থিত কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ ইনস্টিটিউট। তারা দেখিয়েছে, বাংলাদেশের গভীর তলদেশে সক্রিয় হচ্ছে বহুপূর্বে সমাহিত হওয়া ‘ফল্টস’। পৃথিবী অতীতে কিভাবে ঘূর্ণন সম্পন্ন করেছে, অকস্মিকভাবে নদীর গতিপথ বদলে যাওয়ার তথ্যও বিশ্লেষণ করেছেন তারা। আর এসব বিবেচনায় নিয়েই তাদের এই আশঙ্কা ব্যক্ত করা। কেভিন ক্রাজিক তার নিবন্ধে বাংলাদেশ সম্পর্কে লিখেছেন, ১৬ কোটির বেশি মানুষের এ দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এবং তা বাড়ছে দ্রুততার সঙ্গে। দেশটি বিশ্বের বৃহত্তম নদী অববাহিকা এবং তা সমুদ্র উচ্চতার কাছাকাছি। এর ফলে বাংলাদেশ সুনামি হুমকিতে রয়েছে। ভূমিকম্প হলে নদীগুলোর তীর লাফিয়ে লাফিয়ে গতিপথের পরিবর্তন ঘটাবে। বড় বড় ব্রিজ ও বহুতল বিশিষ্ট ভবনগুলো ধসে পড়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে। বিশেষজ্ঞ মতামত: বিজ্ঞানীরা এটা স্বীকার করতে এগিয়ে এসেছেন যে, এ মুহূর্তে বেশ কিছু সক্রিয় ‘টেকটনিক প্লেট বাউন্ডারি’ ঘেঁষে আছে বাংলাদেশ। এর সঙ্গে আছে সুমাত্রায় ২০০৪ সালের সেই প্রলয়ঙ্করী সুনামির লেজ, যে সুনামি কিনা দু’লাখ মানুষের প্রাণহানির কারণ হয়েছে। সুনামির ওই লেজ থেকে বাংলাদেশ মাত্র ১৩০০ কিলোমিটার দক্ষিণে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অবজারভেটরির সিসমোলজিস্ট সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘এক কথায় বলা যায়, ঢাকা একটি টাইম বোমার ওপর রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানীর কাছে ভূমিকম্প হলে তা সাম্প্রতিককালের অন্যসব বিপর্যয়কে ম্লান করে দেবে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘ভারত ও বার্মা (মিয়ানমার) প্লেটের সংযোগস্থলে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পূর্বাংশ বার্মা প্লেটের মধ্যে, পশ্চিমাংশ ইন্ডিয়া (ভারত) প্লেটের মধ্যে। এমন ভূ-তাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্যে ভূমিকম্প হবে এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। ভূমিকম্প আমাদের দরজায় আঘাত হানতে শুরু করেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশের বাইরে কাছাকাছি ও দেশের ভেতরে ভূমিকম্পের উৎস থাকায় যে কোনো সময় বাংলাদেশে ভূমিকম্প হতে পারে। আমাদের ঢাকা একটি অপরিকল্পিত ও জনবহুল নগরী। বড় ধরনের ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে ঢাকার অবস্থান ভূমিকম্পের উৎস থেকে ৫০ থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে হলে ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপক হতে পারে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭:৪৫:৫৮ ৩০৩ বার পঠিত