বঙ্গনিউজ ডটকমঃ বিদেশি উন্নয়ন সহায়তা আরও কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে প্রথমবারের মতো একটি জাতীয় নীতিমালা তৈরি করছে সরকার। ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এ বিষয়ে একটি প্রাথমিক খসড়াও তৈরি করেছে।
ওই খসড়ায় পাঁচটি উদ্দেশ্যে নীতিমালাটি তৈরি করার কথা বলা হয়েছে। উদ্দেশ্যগুলো হলো—উন্নয়ন সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি সুসংহত ও কৌশলগত পদ্ধতি উপস্থাপন; বৈদেশিক সহায়তার কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিতকরণ; জাতীয় উন্নয়ন অগ্রাধিকার ও জাতীয় পদ্ধতির সঙ্গে উন্নয়ন সহযোগীদের নীতি-পদ্ধতির সামঞ্জস্য বিধান; অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশীদারত্ব সৃষ্টিতে সহযোগিতা প্রদান এবং বৈদেশিক সহায়তা আহরণে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি।
খসড়াটির ওপর ইআরডি ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মত নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গেও পরামর্শক সভা হবে। আগামী বছরের মার্চ মাসের মধ্যে এসব পরামর্শক সভা শেষ করে খসড়াটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে। এরপর জুন মাসের মধ্যে নীতিমালা চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে।
১৯৭২-৭৩ অর্থবছর থেকে এ পর্যন্ত উন্নয়ন সহযোগী তথা দাতারা বাংলাদেশকে মোট ৬ হাজার ৫২৩ কোটি ডলার দিয়েছে। আর পাইপলাইনে রয়েছে ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকার বেশি। প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষতার অভাব এবং উন্নয়ন সহযোগীদের কঠিন শর্তের কারণে পাইপলাইনে থাকা অর্থ ছাড় করা যাচ্ছে না।
নতুন জাতীয় নীতিমালাটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকবে ইআরডি। সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোর অনুকূলে বিদেশি অর্থায়ন বা সহায়তা গ্রহণের জন্য ইআরডি উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয় করবে।
বর্তমানে বিদেশি সহায়তা ব্যবহারে যে সমস্যা রয়েছে, সেটি তুলে ধরা হয়েছে নীতিমালার খসড়ায়। এতে বলা হয়েছে, বৈদেশিক সহায়তার নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বাংলাদেশকে যে সহায়তা প্রদান করা হয়, তা ব্যাপকভাবে খণ্ডিত। আর জাতীয় অগ্রাধিকারের সঙ্গে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পেরও সমন্বয় হচ্ছে না। সমন্বয়ের অভাবে ছোট ছোট প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, আবার একই ধরনের প্রকল্পও থাকছে। এ কারণে বৈদেশিক সহায়তার মান ও কার্যকারিতা ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়। এতে বৈদেশিক সহায়তা সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে যায়। অহেতুক দ্বৈততা তৈরি হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইআরডির এইড ইফেকটিভনেস প্রকল্পের নীতি ও সমন্বয় বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের বিদেশি সহায়তা ব্যবহারে সক্ষমতার অভাব রয়েছে। বিপুল পরিমাণ অর্থ অপচয় হচ্ছে। সভায় খাওয়া-দাওয়া বাবদ প্রতিজনে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকাও খরচ হয়। আবার ছোটখাটো প্রকল্পেও পরামর্শক নিয়োগ করে উচ্চ সম্মানী দিতে হয়। এ ধরনের অপচয় বন্ধ করা উচিত।’
মিজানুর রহমান মনে করেন, পাইপলাইনে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ পড়ে আছে, তা ছাড় করার বিষয়টি নির্ভর করছে দর-কষাকষির দক্ষতার ওপর। আর এত বছরে এ দক্ষতা অর্জন না করতে পারা দুঃখজনক।
খসড়ায় যা আছে: ইআরডির তৈরি খসড়ায় বলা হয়েছে, প্রতি অর্থবছরের শুরুতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দেওয়া প্রকল্প তালিকা থেকে একটি ‘অগ্রাধিকার তালিকা’ তৈরি করবে ইআরডি। এরপর সেই তালিকা ধরে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। এ ছাড়া দ্বিপক্ষীয়, বহুপক্ষীয় ও বিশেষায়িত অন্য যেকোনো উৎস থেকে ঋণ এবং অনুদান আনার আলাপ-আলোচনার দায়িত্বও পুরোপুরি ইআরডির ওপর থাকবে। তবে কঠিন শর্তের যেকোনো ঋণই ‘স্ট্যান্ডিং কমিটি অন নন-কনসেশনাল লোন’ কর্তৃক অবশ্যই অনুমোদন নিতে হবে। এ কমিটির নেতৃত্বে আছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
খসড়া অনুযায়ী, বিদেশি সহায়তাপুষ্ট কোনো প্রকল্পের ব্যয় ৩০ কোটি টাকার বেশি হলেই সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করতে হবে। আর সম্ভাব্যতা সমীক্ষাটি করতে হবে স্থানীয় বিশেষজ্ঞ দিয়ে। অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সমীক্ষার কাজে বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ করা যাবে না। এ ছাড়া সমীক্ষার জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের কারিগরি সহায়তা যথাসম্ভব নিরুৎসাহিত করা হবে।
আশঙ্কা: নীতিমালার খসড়ায় বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে সরকারি উন্নয়ন সহায়তা (ওডিএ) কমার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। তবে দক্ষিণের দেশগুলোর মধ্যে যেমন দক্ষিণ-দক্ষিণ সহায়তা, ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা এবং বিশেষ উদ্দেশ্যে গঠিত বৈশ্বিক তহবিল, যেমন—জলবায়ু উন্নয়ন তহবিল থেকে সহায়তার পরিমাণ অবশ্য বাড়তে পারে। এ ছাড়া এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের (এআইআবি) মতো নতুন বহুপক্ষীয় ও আঞ্চলিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি হওয়ায় বিদেশি সহায়তার পদ্ধতিতেও বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে বলেও খসড়ায় বলা হয়েছে।
সংজ্ঞা: বৈদেশিক সহায়তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে সরকারি উন্নয়ন সহায়তা বা ওডিএ (অনুদান ও রেয়াতি ঋণ), বিশেষায়িত বা ভার্টিক্যাল তহবিল এবং আন্তর্জাতিক ফাউন্ডেশন, জলবায়ু তহবিল, বাণিজ্যের জন্য সহায়তা, অ-রেয়াতি ঋণ, বাণিজ্যিক ঋণ এবং দক্ষিণ-দক্ষিণ ও যেকোনো ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে পাওয়া ঋণের পাশাপাশি খাদ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি), বাংলাদেশ বিমান, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) কর্তৃক গৃহীত বিশেষ ঋণ, প্রতিরক্ষা সহায়তা এবং দুর্যোগ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় পাওয়া বিশেষ সহায়তা এ নীতিমালার আওতায় থাকবে না।
বাংলাদেশ সময়: ১৫:০৯:০৭ ৪২৯ বার পঠিত