বঙ্গনিউজ ডটকমঃ তখন সকাল সাড়ে ১০টা। এর মধ্যেই রাজধানীর মিরপুরের সবাই জেনে গেছে, এলাকায় জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চলছে। বিপুলসংখ্যক পুলিশ, ডিবি ও র্যাবের সদস্য পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছেন। বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে সরাসরি দেখানো হচ্ছে। মিরপুর ১ নম্বরের এ ব্লক ততক্ষণে লোকে লোকারণ্য। সবাই ৯ নম্বর সড়কের ৩ নম্বর বাড়িটির কাছে যেতে চান। ঠেলাঠেলি, হইচই। কিছুক্ষণ পরপর ভিড় সামলাতে পুলিশের বাঁশি ও লাঠিপেটার হুমকি; হুটোপুটি-দৌড়াদৌড়ি। রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ।
গত বুধবার রাত দুইটা থেকে গতকাল বিকেল চারটা পর্যন্ত ১৪ ঘণ্টার দীর্ঘ অভিযানে মিরপুরের (শাহ আলী থানাধীন) ওই বাড়ির ছয়তলা থেকে মোট ছয়জনকে আটক করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে হাতে তৈরি ১৬টি গ্রেনেড (আইইডি—ইম্প্রোভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস), দুটি ককটেল, বোমা বা গ্রেনেড রাখার একটি বিশেষ জ্যাকেট ও গ্রেনেড তৈরির প্রচুর উপকরণ। এর আগে বুধবার রাতে ডিবি জেএমবির এক সদস্যকে আটক করে। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী রাত দুইটার দিকে মিরপুরের ওই জঙ্গি আস্তানায় অভিযান শুরু করা হয়।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কর্মকর্তারা বলছেন, আগের রাতের একজনসহ মোট আটক সাতজনের মধ্যে তিনজন নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। বাকি চারজনকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয়েছে। এই চারজন পাশের ফ্ল্যাটে থাকত।
গত রাত পর্যন্ত আটক জেএমবির তিন সদস্যের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করেনি পুলিশ। ডিবির কর্মকর্তারা কেবল বলেছেন, তিনজনই বয়সে তরুণ। এঁদের মধ্যে একজন গ্রেনেড তৈরির মূল কারিগর। তাঁর বাড়ি উত্তরবঙ্গে। তাঁরা ওই বাসাটি গ্রেনেড ও বোমা তৈরির কারখানা হিসেবে ব্যবহার করছিলেন। সেখানে লেদ মেশিনের যন্ত্র থেকে শুরু করে গ্রেনেড তৈরির প্রচুর সরঞ্জাম ও বিস্ফোরক পাওয়া গেছে, যা দিয়ে অন্তত ২০০ গ্রেনেড তৈরি করা সম্ভব।
ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম বলেন, বুধবার রাতে আটক জেএমবির সদস্যের দেওয়া তথ্যানুযায়ী মিরপুরের ওই জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালানো হয়। তার আগে ওই বাড়ির বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের লাইন বিচ্ছিন্ন করা এবং অন্যান্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়া হয়। তিনি বলেন, এই জঙ্গি আস্তানা থেকে উদ্ধার করা গ্রেনেড গত ২৩ অক্টোবর পুরান ঢাকায় হোসেনি দালান ইমাম বাড়ায় হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেড এবং ২২ অক্টোবর কামরাঙ্গীরচর থেকে উদ্ধার করা গ্রেনেডগুলো একই ধরনের।
যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, ঢাকার দারুস সালাম এলাকায় পুলিশের এএসআই ইব্রাহিম হত্যা ও হোসেনি দালানে হামলার পর থেকেই জেএমবির বোমা-গ্রেনেড তৈরির এই কারখানাটি খুঁজছিল ডিবি। ইব্রাহিম হত্যার পর ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার হওয়া তরুণের তথ্যের ভিত্তিতে দুই মাস আগে যে অনুসন্ধান শুরু হয়েছিল, গতকাল তার একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় উন্মোচিত হলো।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, গত অক্টোবরে চট্টগ্রামে ধরা পড়া জঙ্গিরা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছিল, তারা ঢাকার মিরপুর ১ নম্বরের একটি ছয়তলা ভবনে হাতে-কলমে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। ওই কর্মকর্তার ধারণা, এটিই সেই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
মিরপুরে এই অভিযানে নেতৃত্ব দেন ডিবির বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) ছানোয়ার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অভিযানে ডিবির বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের সদস্যদের সঙ্গে ছিলেন বিশেষায়িত দল সোয়াটের (স্পেশাল উইপনস অ্যান্ড ট্যাকটিস) সদস্যরাও। মোট পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয়ে ৩৫ জনের যৌথ দলটি বাড়িটি শনাক্তের পর রাত দুইটার দিকে তা ঘিরে ফেলে।
ছানোয়ার হোসেন আরও জানান, যেহেতু আগে থেকেই খবর ছিল যে ভেতরে প্রচুর গ্রেনেড, বোমা ও বিস্ফোরক মজুত আছে, তাই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিরাপত্তার স্বার্থে একটু সময় নিয়ে অভিযান চালাতে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ভবনটি দীর্ঘ সময় ঘিরে রাখার পর সকাল সাতটার দিকে সেই ভবনে ঢুকে ছয়তলা ভবনটির ১২টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ১০টির বাসিন্দাদের বাইরে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর ভবনটির নিচতলায়, চারপাশে ও ছাদে অবস্থান নেন অভিযানকারী দলের সদস্যরা। ছয়তলার নির্দিষ্ট ওই ফ্ল্যাটের আশপাশে গিয়ে অভিযানকারী দলটি দরজা খোলার জন্য আহ্বান জানায়। কিন্তু ভেতর থেকে কেউ সাড়া দিচ্ছিল না। এরপর সিঁড়ি থেকে, নিচ থেকে হাত মাইক ব্যবহার করে বারবার জঙ্গিদের বের হয়ে আসতে বলা হচ্ছিল। প্রায় দুই ঘণ্টা এভাবে চেষ্টা চলে। সকাল নয়টার দিকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় দরজা ভেঙে ওই ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকে পড়েন ডিবির সদস্যরা। এর কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে দুজনকে আটক করে দ্রুত ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা ১১টার দিকে জঙ্গিদের পাশের ফ্ল্যাটের চার ভাড়াটেকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করেন ডিবির সদস্যরা। এর আগ পর্যন্ত ওই চারজন অন্যদের সঙ্গে ভবনটির নিচেই অবস্থান করছিলেন। তাঁদের দুজন মিরপুরে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, একজন ব্যবসায়ী, আরেকজন তাঁর আত্মীয়ের কাছে বেড়াতে এসেছিলেন বলে জানা গেছে।
স্থানীয় লোকজন জানান, অভিযানের সময় তাঁরা বেশ কিছু গুলি-বোমার শব্দ শুনতে পেয়েছেন। যে ভবনটিতে অভিযান চলছিল, তার পেছন দিকের একটি টিনশেড বাসার ছাদে ছয়তলার জানালা ভেঙে কাচের গুঁড়া পড়েছে।
টিনশেড বাসাটির ভাড়াটে মাহফুজা বেগম বলেন, সকাল নয়টার দিকে তিনি তাঁর সাত ও দুই বছর বয়সী দুই ছেলেকে খাওয়াচ্ছিলেন। এমন সময় একটা বিস্ফোরণের শব্দ পান। এর পরপরই আরেকটা বিস্ফোরণের শব্দ হয়, ছয়তলা থেকে জানালার কাচ ভেঙে তাঁদের টিনের চালে পড়ে। ভয় পেয়ে সন্তানদের নিয়ে তিনি ঘর থেকে বের হয়ে যান। বের হওয়ার সময় দেখেন, ছয়তলার জানালা থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। এরপর বেশ কয়েকটি গুলির শব্দ পেয়েছেন তাঁরা।
পাশের একটি বাসার নিরাপত্তাকর্মী আবদুল আজিজ বলেন, ফজরের আজানের পরেই তিনি কিছু শব্দ পেয়েছেন। এরপরে তিনি বের হতে গেলে তাঁকে একজন লোক বাসার ভেতরে ঢুকে যেতে নির্দেশ দেন। এরপর তিনি আর বের হননি। কিছু পরে সকালে তিনি পরপর দুটো বিস্ফোরণ ও কিছু গুলির শব্দ শুনতে পান। সকাল থেকেই পুলিশ ওই এলাকার দোকানপাট খুলতে দেয়নি। পুলিশের নিয়ন্ত্রণের কারণে ওই সড়কের অনেকগুলো বাড়িতেই সকালে গৃহকর্মীরা কাজ করতে আসতে পারেননি।
এই গুলি ও বোমার শব্দ সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিবির এডিসি ছানোয়ার হোসেন বলেন, অভিযানে অংশ নেওয়া পুলিশ সদস্যরাও গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করেছেন। অভিযানে কেউ হতাহত হননি।
অভিযানে থাকা একাধিক কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গিদের ফ্ল্যাটে ঢোকার পর তল্লাশি করতে হয়েছে খুব সাবধানে। দুটি শয়নকক্ষ, একটি খাবার ও বসার জায়গা, দুটি বাথরুম ও একটি রান্নাঘর নিয়ে ছোট ফ্ল্যাটটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ছিল গ্রেনেড ও বিস্ফোরক। এ ছাড়া একটি ট্রাঙ্ক থেকে কয়েকটি গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়। ফ্ল্যাটে তল্লাশি চালিয়ে পাওয়া গেছে প্রচুর গ্রেনেড তৈরির খোল, পাইপ, বিস্ফোরক, বিস্ফোরক জেল, গ্রেনেড তৈরির সার্কিট, টাইমার সুইচসহ বিভিন্ন উপকরণ। রান্নাঘরে রাখা কয়েকটি বাটিতে মিলেছে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক। এগুলো আসলে কী, তা পরীক্ষার জন্য গবেষণাগারে নেওয়া হয়েছে। ফ্ল্যাটটি থেকে গ্রেনেড ও বোমা তৈরির নির্দেশিকাও (ম্যানুয়াল) উদ্ধার করা হয়েছে। ফ্ল্যাটের ভেতরে কর্মকর্তাদের মুঠোফোনে ছবি তোলার বিষয়েও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিষেধাজ্ঞা ছিল।
একজন কর্মকর্তা জানান, অভিযানের সময় জঙ্গিরা ভবনের পেছন দিয়ে তাঁদের ব্যবহৃত মুঠোফোন, সিমকার্ডসহ বেশ কিছু জিনিসপত্র ফেলে দেন। পরে তল্লাশি চালিয়ে সেগুলো উদ্ধার করা হয়।
গতকাল বেলা একটার পরে শুরু হয় উদ্ধার করা গ্রেনেডগুলো নিষ্ক্রিয়করণের কাজ। গ্রেনেডগুলো ছয়তলা ফ্ল্যাট থেকে নামিয়ে পাশের সারেং বাড়ির মসজিদ-সংলগ্ন মাঠে নেওয়া হয়। সেখানে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সেগুলো নিষ্ক্রিয় করেন ডিবির বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ও অপসারণ দলের সদস্যরা।
বিকেল চারটার দিকে গ্রেনেড ও বোমাগুলো নিষ্ক্রিয় করা শেষে অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম। তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, অভিযান শেষ। তবে এখন শুধু ফ্ল্যাট থেকে জব্দ করা জিনিসপত্র ও যন্ত্রপাতির তালিকা তৈরিসহ আনুষঙ্গিক আইনি কাজ করা হচ্ছে।
বিকেল চারটার পরে ভবনের বাসিন্দাদের ঢুকতে দেওয়া হয়। তবে ভবনের ফটকে পুলিশি পাহারা ছিল। গণমাধ্যমকর্মী বা বাইরের কাউকে ঢুকতে দেয়নি পুলিশ।
এলাকাবাসী জানিয়েছেন, ওই বাড়িটির মালিক আবুল হোসেন ভূঁইয়া। তিনি মিরপুরে ফোমের ব্যবসা করেন। গ্রেপ্তার হওয়া জেএমবির সদস্যরা চার মাস আগে ছয়তলার একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। তার আগে দুই মাস তাঁরা পাশের আরেকটি বাসায় ভাড়া ছিলেন।
পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার কাইয়ুমুজ্জামান খান বলেন, ঢাকা শহরে ভাড়াটেদের তথ্য সংগ্রহের অংশ হিসেবে ওই ভবনেও ফরম দিয়েছিল পুলিশ। তবে ওই ভাড়াটেদের ফরম পূরণ করে পুলিশকে ফেরত দেননি বাড়ির মালিক।
আটক
তিন জেএমবি সদস্যসহ সাতজন আটক, তাদের নাম–ঠিকানা বলেনি পুলিশ। কর্মকর্তারা বলেছেন, তিনজনই বয়সে তরুণ
উদ্ধার
হাতে তৈরি ১৬টি গ্রেনেড, দুটি ককটেল, বোমা বা গ্রেনেড রাখার একটি বিশেষ জ্যাকেট ও গ্রেনেড তৈরির প্রচুর উপকরণ
বাংলাদেশ সময়: ১৫:০৬:৫৬ ৪৭৬ বার পঠিত