বঙ্গনিউজ ডটকমঃ খারাপ ইতিহাস থেকে ভালো কিছু তৈরি হতে পারে’—পদ্মা সেতু নিয়ে টানাপোড়েনের পর বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংক সম্পর্ককে এভাবে দেখছেন কৌশিক বসু। সফররত বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধান অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘এটা আমরা সবাই জানি, ইট ইজ নট আ গুড হিস্ট্রি। এখন যেটা হচ্ছে তাকে আমরা স্বাগত জানাই। একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, অনেক সময় ব্যাড হিস্ট্রি থেকে গুড নিউজ সৃষ্টি হয়।’
গতকাল মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে কৌশিক বসু এ মন্তব্য করেন। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয় যৌথভাবে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।
কৌশিক বসু এ সময় বলেন, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে করা হলে একভাবে পদ্মা সেতু করা হতো। এখন বাংলাদেশ নিজেরাই এত বড় প্রকল্প করছে। তাঁর মতে, এটাকে দেখতে হবে, বাংলাদেশ এখন অনেক পরিপক্ব। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের নতুন মাত্রার অংশীদারি সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে।
কৌশিক বসু আরও বলেন, ‘নিজের ওপর ভরসা করে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিয়ে সক্ষমতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। ১০ বছর আগে হলে এটা ভাবা যেত না। তখন ভাবা হতো, এত বিদেশি মুদ্রা কোথায় পাব? এখন একটি স্বাস্থ্যবান বৈদেশিক মুদ্রার মজুত আছে। আমি ঢাকায় আসার দিনই প্রধানমন্ত্রী এ সেতুর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেছেন।’
সংবাদ সম্মেলনে কৌশিক বসু জানান, বাংলাদেশে আসার আগে তিনি ছয়-সাত দিন এ দেশের বিভিন্ন পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখেছেন। তা থেকে বাংলাদেশের সাফল্যে আস্থা অনুভব করেছেন। গত চার দিনে বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখে তাঁর সেই আস্থা আরও বেড়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষের এখন উচ্চাভিলাষী হওয়ার অধিকার এসে গেছে। এ দেশটি ‘তরতর’ করে এগিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষকে অনুভব করতে হবে, পুরো
দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
কৌশিক বসুর মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন উড়ন্ত সূচনার পর্যায়ে রয়েছে। বিনিয়োগের পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২৯ শতাংশের সমপরিমাণ। আগামী কয়েক বছরে এ বিনিয়োগ আরও ৩-৪ শতাংশ বৃদ্ধি করতে পারলে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন খুবই সম্ভব। তাহলে বাংলাদেশ ‘এশিয়ান টাইগার’ দেশগুলোর একটিতে পরিণত হবে।
কৌশিক বসু বলেন, ২০০৮ সাল থেকে বিশ্বমন্দা চলছে। এর মধ্যেও এ বছর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৬ শতাংশ হবে। পৃথিবীর মাত্র ৫-১০টি দেশের এমন প্রবৃদ্ধি হবে। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের সামনে দুটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো হলো দুর্বল অবকাঠামো এবং ব্যবসায় প্রশাসনিক জটিলতা। অবকাঠামো খাতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ দরকার। আর ব্যবসায়ের প্রক্রিয়া আরও দ্রুত করতে হবে।
নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ায় বিশ্বব্যাংকের সুদের হার বাড়বে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে কৌশিক বসু বলেন, ‘এখনই বাড়বে না। এ জন্য বাংলাদেশকে অনেকটা উন্নতি করতে হবে। সমৃদ্ধি বেড়ে গেলে বিশ্বব্যাংকের অনমনীয় শর্তের ঋণ নেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হবে। কেউ নিতে না চাইলে জোর করে দেওয়া হবে না। বাংলাদেশে যদি এমন সমৃদ্ধি আসে, তাহলে তো “সেলিব্রেট” করা উচিত। জনগণ মনে করবে, আমরা একটা পর্যায়ের উন্নতি করে ফেলেছি।’
অর্থ পাচার সম্পর্কে আরেক প্রশ্নের জবাবে এ অর্থনীতিবিদ মনে করেন, সব দেশ থেকেই অর্থ পাচার হয়। এ জন্য জনগণের পক্ষ থেকে সরকারকে চাপে রাখা উচিত। তবে সব ধরনের অর্থ আটকিয়ে রাখা ঠিক হবে না। আজকের বিশ্বে অনেক বৈধ টাকাও বিদেশে যাচ্ছে। তাই আইনকানুন খুবই সতর্কতার সঙ্গে তৈরি করতে হবে। তিনি উদাহরণ দেন, যখন জার্মানি থেকে সুইজারল্যান্ডে অনেক অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছিল, তখন জার্মান সরকারকে আইন করতে পাঁচ বছর সময় লেগেছিল।
বিখ্যাত এই বাঙালি অর্থনীতিবিদ বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নে আঞ্চলিক যোগাযোগ বাড়াতেই হবে। দক্ষিণ এশিয়ায় সেভাবে তা গড়ে ওঠেনি। তবে সাম্প্রতিক কালে এই অঞ্চলের রাজনীতিবিদদের দেখে মনে হচ্ছে, পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের মাধ্যমে আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধিতে তাঁরা উঠেপড়ে লেগেছেন।
মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আর্থিক খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগের প্রশংসা করেন কৌশিক বসু। এ ধরনের উদ্যোগে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম দু-তিনটি দেশের মধ্যে হবে বলে মনে করেন তিনি। এ ছাড়া সবুজ অর্থায়নের মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব শিল্পকারখানা তৈরির প্রশংসাও করেন কৌশিক বসু। যদিও তিনি বলেন, শ্রমিকদের কর্মপরিবেশে বাংলাদেশকে আরও উন্নতি করতে হবে।
কৌশিক বসু মনে করেন, বাংলাদেশের আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা বেশ ভালো। তবু আরও সতর্ক হতে হবে। কেননা ব্রাজিলের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশেও নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান বলেন, বাজার থেকে ডলার কিনে পদ্মা সেতু নির্মাণের ব্যয় মেটানো হচ্ছে। কোনো সময় যদি বাজারে ডলার নাও পাওয়া যায়, তবে সেই ডলারের চাহিদা মেটানোর মতো ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রয়েছে। বিশাল বৈদেশিক মুদ্রার মজুত রাজনৈতিক নেতৃত্বকে স্বস্তি দিচ্ছে। তা না হলে তাঁরা নির্ঘুম রাত কাটাতেন।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পাল, বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান অর্থনীতিবিদ মার্টিন রামা।
বাংলাদেশ সময়: ১২:২০:১৩ ৩০৭ বার পঠিত