বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ
সকল নাটকীয়তার অবসান ঘটিয়ে ফাঁসি কার্যকর করা হলো যুদ্ধাপরাধী বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী এবং জামায়ত নেতা আলী আহসান মুজাহিদের। এরফলে দীর্ঘ ৪৪ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটলো।
শনিবার রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে সাকা এবং মুজাহিদের ফাঁসিও কার্যকর করা হয়। এসময় কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) ব্রি. জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন ও জেলা প্রশাসক আবু ইউসুফসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।
রিভিউ আবেদন বাতিল করার পর থেকেই সবার মুখে মুখে ছিল সাকা ও মুজাহিদের ফাঁসির বিষয়টি। গত ২-৩ দিন যাবত ‘টক অব দ্যা কান্ট্রি’-তে পরিণত হয় তাদের ফাঁসি কার্যকরের ঘটনাটি।
তবে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার বিষয়টি কালক্ষেপণ করতে থাকেন সাকা ও মুজাহিদ। শেষ পর্যন্ত শনিবার রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করে তাঁরা। তবে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ তাদের আবেদন নাকচ করেন ফলে দ্রুততার সাথে তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
এরআগে, গত বুধবার বেলা সাড়ে তাদের রিভিউ খারিজ করে আদালত। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ পৃথক পৃথক রায় দু’টি দেন। অন্য বিচারপতিরা হচ্ছেন, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
গত ১৪ অক্টোবর আপিল বিভাগে পৃথকভাবে রিভিউ আবেদন করেন মুজাহিদ ও সাকা চৌধুরী। পরদিন আবেদন দু’টির দ্রুত শুনানির দিন ধার্যের আবেদন জানান রাষ্ট্রপক্ষ। ২০ অক্টোবর রিভিউ শুনানির দিন ০২ নভেম্বর ধার্য করেন আপিল বিভাগের অবকাশকালীন চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। এরপর রিভিউ শুনানি পেছাতে সময়ের আবেদন জানান মুজাহিদ। অন্যদিকে নিজের পক্ষে কয়েকজন সাফাই সাক্ষীকে সমন জারি করার আবেদন জানান সাকা চৌধুরী।
গত ০২ নভেম্বর কার্যতালিকায় এলেও ১৭ নভেম্বর রিভিউ দু’টির শুনানির দিন ধার্য করেন সর্বোচ্চ আদালত। শুনানি পেছাতে মুজাহিদের আবেদনটি গ্রহণ করে এ দিন ধার্য করা হয়। তবে নিজের পক্ষে কয়েকজন সাফাই সাক্ষীকে সমন জারি করতে সাকা চৌধুরীর আবেদন খারিজ করে দেন।
সালাউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরী
২০১৩ সালের ১ অক্টোবর সাকা চৌধুরীকে ফাঁসির রায় দেন ট্রাইব্যুনাল-১। চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হকের সমন্বয়ে গঠিত তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ রায় দেন।
এ রায়ের বিরুদ্ধে ওই বছরের ২৯ অক্টোবর আপিল করেন বিএনপির এই নেতা। তবে সর্বোচ্চ সাজার প্রেক্ষিতে আপিল করেননি রাষ্ট্রপক্ষ।
২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর অন্য একটি মামলায় গ্রেফতার হন সাকা চৌধুরী। পরে একই বছরের ১৯ ডিসেম্বর তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।
গত ১৬ জুন শুরু হয়ে ১৩ কার্যদিবসে আপিল শুনানি শেষ হয় গত ৭ জুলাই। ২৯ জুলাই সাকা চৌধুরীর ফাঁসির চূড়ান্ত রায় দেন সর্বোচ্চ আদালত।
এ রায়ে ট্রাইব্যুনাল সাকা চৌধুরীকে অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যাসহ যে চার হত্যা-গণহত্যার দায়ে সর্বোচ্চ সাজা দিয়েছিলেন সেগুলোর সাজাই বহাল রাখেন সর্বোচ্চ আদালত। ফলে চূড়ান্ত রায়েও অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা (৩ নম্বর অভিযোগ), রাউজানের সুলতানপুর গ্রামে তিনজনকে গণহত্যা (৫ নম্বর অভিযোগ), রাউজানের ঊনসত্তরপাড়ায় ৫০-৫৫ জনকে গণহত্যা (৬ নম্বর অভিযোগ) এবং চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মোজাফফর আহম্মদ ও তার ছেলে শেখ আলমগীরকে হত্যার(৮ নম্বর অভিযোগ) দায়ে ফাঁসির আদেশ হয়েছে তার।
অন্যদিকে ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত নয়টি অভিযোগের মধ্যে অন্য তিনটি অভিযোগের প্রত্যেকটিতে ২০ বছর এবং আরো দু’টি অভিযোগের প্রতিটিতে পাঁচ বছর করে কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছিল তাকে। সব মিলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি মোট ৭০ বছরের কারাদণ্ড পান তিনি। এর মধ্যে শুধু রাউজানের সতীশ চন্দ্র পালিতকে হত্যার (৭ নম্বর অভিযোগ) দায় থেকে আপিল বিভাগের রায়ে খালাস পেয়েছেন তিনি, যে অভিযোগে তাকে ২০ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। এর ফলে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি মোট ৫০ বছরের কারাদণ্ড বহাল রয়েছে।
বহাল থাকা অন্য চার অভিযোগের দণ্ডাদেশের মধ্যে রাউজানের গহিরা গ্রামের হিন্দুপাড়ায় গণহত্যা(২ নম্বর অভিযোগ) ও জগৎমল্লপাড়ায় ৩২ জনকে গণহত্যার(৪ নম্বর অভিযোগ) দায়ে ২০ বছর করে ৪০ বছর এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ, সিরাজ ও ওয়াহেদ ওরফে ঝুনু পাগলাকে অপহরণ করে নির্যাতন(১৭ নম্বর অভিযোগ) এবং চান্দগাঁওয়ের সালেহউদ্দিনকে অপহরণ করে সাকা চৌধুরীর পারিবারিক বাসভবন গুডসহিলে নিয়ে নির্যাতনের (১৮ নম্বর অভিযোগ) দায়ে ৫ বছর করে আরো ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে সাকাকে।
ট্রাইব্যুনালে সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনা মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট ২৩টি অভিযোগের মধ্যে ১৭টির পক্ষে সাক্ষী হাজির করেন রাষ্ট্রপক্ষ। সেগুলোর মধ্যে দোষী সাব্যস্ত করা নয়টি বাদে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়া বাকি আটটি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেওয়া হয়। এছাড়া রাষ্ট্রপক্ষ যে ছয়টি অভিযোগের পক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করেননি সেগুলো থেকেও সাকা চৌধুরীকে খালাস দেওয়া হয়। এ ১৪টি অভিযোগের বিষয়েও ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।
আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই মুজাহিদকে ফাঁসির রায় দেন ট্রাইব্যুনাল-২। চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীন, বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম ও বিচারপতি মুজিবুর রহমান মিয়ার সমন্বয়ে গঠিত ট্রাইব্যুনাল এ রায় দেন।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে একই বছরের ১১ আগস্ট আপিল করেন মুজাহিদ। তবে সর্বোচ্চ সাজার প্রেক্ষিতে আপিল করেননি রাষ্ট্রপক্ষ।
গত ২৯ এপ্রিল থেকে আপিল মামলার শুনানি শুরু হয়ে ২৭ মে মোট নয় কার্যদিবসে শেষ হয়। গত ১৬ জুন মুজাহিদের আপিল খারিজ করে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে চূড়ান্ত রায় দেন আপিল বিভাগ।
চূড়ান্ত পূর্ণাঙ্গ রায়ে ৬ নম্বর অভিযোগে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পেয়েছেন মুজাহিদ। এ অভিযোগে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটিতে (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্ব) থাকা নেতা হিসেবে গণহত্যা সংঘটিত করা, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করা, হত্যা, নির্যাতন, বিতাড়ন ইত্যাদির ঘটনার দায়ও প্রমাণিত হয়েছে তার বিরুদ্ধে।
তবে ১ নম্বর অভিযোগে শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেনকে হত্যার দায়ে থেকে আপিল মামলার রায়ে খালাস পেয়েছেন মুজাহিদ। ট্রাইব্যুনাল এ অভিযোগে তাকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন। এ অভিযোগেও মুজাহিদের সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির দায় প্রমাণিত হয়েছিলো ট্রাইব্যুনালের রায়ে।
অন্যদিকে ৭ নম্বর অভিযোগে ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ ও গণহত্যার দায়ে মুজাহিদকে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে।
প্রমাণিত ১ নম্বর অভিযোগকে ৬ এর সঙ্গে সংযুক্ত করে এ দু’টি অভিযোগে সমন্বিতভাবে ও ৭ নম্বর অভিযোগে মুজাহিদকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল। আপিল বিভাগ ১ ও ৬ নম্বর অভিযোগকে আলাদা করেই চূড়ান্ত রায় দেন।
৫ নম্বর অভিযোগে ঢাকার নাখালপাড়ায় পুরনো এমপি হোস্টেলে শহীদ সুরকার আলতাফ মাহমুদসহ কয়েকজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার দায়ে যাবজ্জীবন এবং ৩ নম্বর অভিযোগে ফরিদপুর জেলার কোতোয়ালি থানার গোয়ালচামট এলাকার (রথখোলা) মৃত রমেশ চন্দ্র নাথের পুত্র রণজিৎ নাথ ওরফে বাবু নাথকে আটক ও নির্যাতনের দায়ে ৫ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয় ট্রাইব্যুনাল থেকে। প্রমাণিত না হওয়া ২ ও ৪ নম্বর অভিযোগে খালাস পান মুজাহিদ। ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে একমত হয়ে এ চার অভিযোগের দণ্ড বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।
প্রমাণিত না হওয়া ২ নম্বর অভিযোগে ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসন থানায় বিভিন্ন গ্রামে হিন্দুদের বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও গণহত্যার অভিযোগ এবং ৪ নম্বর অভিযোগে কোতোয়ালি থানার গোয়ালচামট এলাকার মো. আবু ইউসুফ পাখিকে আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছিল।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেফতার হন মুজাহিদ। পরে ওই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।
বাংলাদেশ সময়: ৭:৪৫:২৪ ২৮৯ বার পঠিত