বঙ্গনিউজ ডটকমঃ রাজনীতি, সমাজসেবা, শিক্ষাবিস্তার, শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা ও সমাজ সংস্কারকের ভূমিকায় এ পণ্ডিতজনের অবদান অপরিসীম। কৃষক সমাজকে দেশের চালিকাশক্তি ভেবে তিনি সমগ্র বাংলায় কৃষক সমিতি ও আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের মধ্যে তিনি প্রথম বাংলায় প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন (দৈনিক হাবলুল মতিন, বাংলা সংস্করণ)। এতিম-অনাথ শিশুদের কল্যাণে তার ভূমিকা ছিল পিতৃতুল্য। তার অমর সাক্ষী ও অবদান চট্টগ্রাম শহরের মোমিন রোড কদম মোবারক মুসলিম এতিমখানা।
ক্ষণজন্মা পুরুষ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর জন্ম চট্টগ্রাম দক্ষিণ মহকুমার পটিয়া (বর্তমান চন্দনাইশ) থানার বরকল ইউনিয়নের আড়ালিয়ার চর গ্রামে ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে। বিখ্যাত শঙ্খ নদীর তীর ঘেঁষে বরকল গ্রামে দক্ষিণ পাশের এ আড়ালিয়ার চর (বর্তমানে শঙ্খ নদীর ভাঙনে এ চরটি বিলীন)।
মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী অনেক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেছেন। তুরস্কের সুলতান (জীবনী) প্রথম সংস্করণ : ২৯ মে ১৯০১ সাল, কনস্টান্টিনোপল অর্থাৎ তুরস্ক রাজধানী মহানগরী কনস্টান্টিনোপলের বিশেষ বিবরণ (ইতিহাস) প্রথম সংস্করণ : ১৩১৯ সন, ভারতে মুসলমান সভ্যতা, প্রথম খণ্ড (ইতিহাস) ১৫ জানুয়ারি ১৯১৪, ভারতে ইসলাম প্রচার (ইতিহাস) ১৫ এপ্রিল ১৯১৫, খাজা নেজামুদ্দীন আওলিয়া (জীবনী) প্রথম সংস্করণ : ১৩২৩, সমাজ সংস্কার (প্রবন্ধ) ২৪ চৈত্র ১৩২৫, বঙ্গীয় মুসলমান সমাজের জাতীয় উন্নতির উপায় (প্রবন্ধ), কুরআনে স্বাধীনতার বাণী (অভিভাষণ) ১১ এপ্রিল ১৯০৯, প্রথম সংস্করণ ১৯৩৯, ইসলামের শিক্ষা (ধর্মীয় উপদেশমূলক প্রবন্ধ), সুদ সমস্যা ও মুসলমান সমাজ (প্রবন্ধ পুস্তিকা), নিম্নশিক্ষা ও শিক্ষাকর (প্রবন্ধ পুস্তিকা) জানুয়ারি ১৯৪০ সাল, অভিভাষণ (পুস্তিকা) ১৩৩৪ সন, ইসলাম জগতের অভ্যুত্থান, আওরঙ্গজেব, মোসলেম বীরাঙ্গনা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
ভারতীয় উপমহাদেশে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী, বঙ্গীয় আইন পরিষদ সদস্য, বিশিষ্ট বাগ্মী, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি (১৯১১) প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্যোক্তা ও জাতীয়তাবাদী মুসলমান নেতা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী লাহোর জেলের নির্জন কক্ষে নানা নিগ্রহ নির্যাতন সহ্য করে শারীরিক দিক দিয়ে দুর্বল হয়ে পড়েন, তবে তাঁর মানবিক শক্তি ছিল অটুট। এত কষ্ট নির্যাতনের মধ্যেও তিনি ভোলেননি জন্মভূমির কথা, দেশ সেবার কথা, কারণ তিনি যে এ দেশের মাটি ও সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে উঠে আসা মানুষ। নির্জন জেল কুঠুরিতে বসে তিনি তাঁর মনোবাসনা ব্যক্ত করেছেন কবিতায়। তার ক’টি লাইন এ রকম :
‘‘ষাটের উপরে আরো দশ বছর
বৃথায় কেটেছে জীবন আমার
দেশদেশান্তরে ভ্রমি সমাজ সেবায়
রাজনীতি, সমাজনীতি, সাহিত্য চর্চায়।
ধর্ম প্রচারের কাজে, বিস্তারে শিক্ষায়,
এসব কাজে মোর কেটেছে সময়
কিন্তু হায়! জন্মস্থান নিজ বাসভূমে
সাধু কার্য করি নাই, নিজ পল্লীধামে,
সঙ্কল্প করিয়াছি জীবন সন্ধ্যায়,
জীবনের অবসান করিব তথায়।”
শেষবার জেল থেকে ছাড়া পেয়েই ইসলামাবাদী বার্মায় যান মোহাজেরদের সাহায্যার্থে কাজ করতে। তার শরীর তখন ক্রমেই ভেঙে পড়ছে। অবশেষে ১৯৪৭ সালে তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। আর্থিকভাবেও তখন তিনি দৈন্যদশায় পতিত। সে সময় ইসলামাবাদী চন্দনাইশে তার পৈতৃক বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। ইসলামাবাদীর মতো একজন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও হিন্দু-মুসলমানের মিলনকামী বাঙালি মনীষীর যোগ্য সম্মান পাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। তাই অনেকটা নীরবে, অবহেলায় তিনি মারা গেলেন জন্মস্থান চট্টগ্রামের বাইনজুড়ি, আড়ালিয়ার চর গ্রামে, ১৯৫০ সালেরর ২৪ অক্টোবর তারিখে। মৃত্যুর পর গ্রামের বাড়ি থেকে তাকে সমাহিতের জন্য চট্টগ্রাম শহরে নিয়ে আসা হয়। সমাহিত করা হয় চট্টগ্রাম শহরে তারই প্রতিষ্ঠিত কদম মোবারক মুসলিম এতিমখানা সংলগ্ন ও নবাব ইয়াসিন খাঁর বিখ্যাত কদম মোবারক গোরস্থানে। মাওলানা ইসলামাবাদীর মৃত্যুর পরের দিন চট্টগ্রামের নাগরিকদের উদ্যোগে এক শোকসভা অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে। ওই শোকসভায় সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট কৃষক নেতা, সাবেক মন্ত্রী ও তার এক কালের সহকর্মী কুষ্টিয়ার শামসুদ্দীন আহমদ ও বক্তব্য রাখেন সুসাহিত্যিক ও মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহারসহ তৎকালীন বাঘা বাঘা রাজনৈতিক নেতা। মৃত্যুর আগে ইসলামাবাদী সমাধি-লিপিও লিখে যান। সেটি এ রকম :
পথিক : ক্ষণেকের তরে বস মোর শিরে
ফাতেহা পড়িয়া যাও নিজ নিজ ঘরে
যে জন আসিবে মোর সমাধি পাশে।
ফাতেহা পড়িয়া যাবে মম মুক্তির আশে।
অধম মনিরুজ্জামান নাম আমার।
ইসলামাবাদী বলে সর্বত্র প্রচার।
ইসলামাবাদীর মতো সৎ রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংগঠক বর্তমান সময়ে বিরল।
- See more at: http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/65341#sthash.dyVBJW3m.dpuf
বাংলাদেশ সময়: ১৬:৪০:৩৬ ৫৬৩ বার পঠিত