বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ
শিক্ষানগরী রাজশাহীর বিনোদনের জনপ্রিয় স্থান পদ্মার পাড় ও লালন মঞ্চ। আর সেই উন্মুক্ত নদীতীরে শহর রক্ষা বাঁধ দখল করে দেওয়া হচ্ছে কাঁটাতারের বেড়া। দখলদার প্রতিষ্ঠান রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক)। আর উন্মুক্ত লালন শাহ মঞ্চ তৈরির পর এখন সেটিকে লিজ দিয়ে পরিণত করা হচ্ছে ফাস্ট ফুডের ভোজনালয়ে। অথচ ওই জমি পানি উন্নয়ন বোর্ড ও প্রশাসনের খাস খতিয়ানভুক্ত। এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত হলে নগরবাসীকে পদ্মার পাড়ে দাঁড়াতে হবে গাঁটের পয়সা খরচ করে টিকিট কেটে।
রাসিকের প্রকৌশল শাখা জানিয়েছে, বিনোদনকেন্দ্রটি দখল করে এটিকে একটি মিনি পার্ক ও ফাস্ট ফুডের স্থানে পরিণত করে ইজারা দেওয়া হবে। লিজ দেওয়ার যাবতীয় কাজ ইতিমধ্যে শেষ করে ফেলেছে সিটি করপোরেশন। লিজ প্রক্রিয়া শেষ হলে সেখানে প্রবেশ করতে গুনতে হবে মাথাপিছু পাঁচ টাকা করে। ফলে এসব নিয়ে চরম ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে নগরবাসীর মাঝে। তারা প্রতিবাদে নেমে এসেছে রাজপথে।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে স্বাধীনতা চর্চাকেন্দ্রের ব্যানারে নগরীতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনটির আহ্বায়ক জুলকার নাইন। বক্তব্য দেন সংগঠনটির অন্যতম সদস্য আবু সুফিয়ান নাজমুল হোসেন রাজু, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সেলিম রেজা নিউটন, ডাক্তার মাহফুজুর রহমান রাজ, অ্যাডভোকেট ইবনুল ওয়াক্ত প্রমুখ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, লালন শাহ মঞ্চের পূর্বপাশে শহর রক্ষা বাঁধের ওপর থেকে পদ্মা নদীর তীর পর্যন্ত ইতিমধ্যে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। লোহার শক্ত ক্লাম বসিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই বেড়া। সীমান্তে ভারতের তৈরি বেড়ার আদলে নগরীর পাঠানপাড়া এলাকায় পদ্মার তীর দখল করে এই কাঁটাতারের বেড়া তৈরি করা হয়েছে। এই বেড়া তৈরির কাজটি লালন শাহ মঞ্চের চারদিকেই হচ্ছে। এমনকি পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্মাণ করা শহর রক্ষা বাঁধের একটি অংশও দখল করে নিয়েছে রাসিক। আর তারা যে স্থানটিতে লালন শাহ মঞ্চসহ আশপাশের অন্য ফাঁকা জায়গাগুলো দখল করে নিয়েছে বা নিচ্ছে, সেটি ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত। অথচ জেলা প্রশাসকের নিয়ন্ত্রণাধীন জেলা পরিষদ থেকেও এ ব্যাপারে কোনো ধরনের অনুমতি নেয়নি সিটি করপোরেশন।
সূত্র মতে, লালন শাহ মঞ্চটি সাবেক মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের আমলে তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। ওই সময় এটির সিংহভাগ কাজও শেষ হয়। পরে মেয়র নির্বাচিত হয়ে মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল মঞ্চটির কাজ শেষ করার উদ্যোগ নেন। এরপর বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র নিযাম-উল-আযিমের সময়ে এসে মঞ্চটির কাজ শেষ করার পাশাপাশি লিজ দিয়ে সেখানে ফাস্ট ফুড ও মিনি পার্ক গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অথচ মঞ্চটি তৈরির উদ্দেশ্যই ছিল নগরবাসী যেন এখানে যেকোনো ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা আয়োজন করতে পারে।
স্থানীয় লোকজন জানায়, পদ্মার পাড়ে বসে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান উপভোগের বিষয়টি চিন্তা করে স্টেডিয়ামের মতো করে সিঁড়িও তৈরি করা হয়েছে। ধাপে ধাপে গোলাকার এ সিঁড়িগুলোতে বসে এখনো বিনোদনপ্রেমী মানুষ সেখানে বসে পদ্মার সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি নানা অনুষ্ঠান দেখতে পারে। আবার বিকেল হলেই সেখানে নানা বয়সী মানুষের ঢল নামে। কিন্তু এসব কেবলই অতীত হতে চলেছে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের জবরদস্তিমূলক কর্মকাণ্ডের ফলে।
রাসিকের স্থানীয় ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এ কে এম রাশেদুল হক টুলু জানান, এর আগে গত বছরের ২১ জুন জেলা বিএনপির সাবেক নেতা খন্দকার হাসান কবিরকে ইজারা দিতে সব প্রক্রিয়া শেষ করা হয়েছিল। তবে স্থানীয় লোকজনের বাধার কারণে তা আটকে যায়। এবার সেই উন্মুক্ত স্থানটিকে আরো বড় আকারে দখল করে ১০ বছরের জন্য লিজ দেওয়ার প্রক্রিয়া হাতে নিয়েছে নগর সংস্থা। এটিকে একটি মিনি পার্ক ও ফাস্ট ফুডের স্থানে পরিণত করে ইজারা দেওয়া হবে।
রাসিক সূত্র জানায়, লালন শাহ মঞ্চ ইজারা দিতে বহিষ্কৃত মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের সময়কালে গত বছরের ২৬ জুন দরপত্র আহ্বান করা হয়। তবে স্থানীয় লোকজনের বাধার মুখে পরে তা বাতিলও করা হয়। কিন্তু বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা নিযাম-উল-আযিম ক্ষমতা গ্রহণ করার পর পরই ওই স্থানটি আবারও লিজ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেন। অনেকটা গায়ের জোরেই তিনি এটি করছেন বলে স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করে।
স্থানীয় বাসিন্দা সুলতান মাহমুদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এভাবে নদীর তীর দখল করে বেড়া দিয়ে তা লিজ দেওয়ার ঘটনা রাজশাহীতে এই প্রথম। আর লিজ দেওয়া হলে স্থানটি আর সর্বসাধারণের থাকবে না, এটি হয়ে যাবে ব্যক্তি মালিকানার সম্পদ। সিটি করপোরেশন তা করার এখতিয়ার রাখে না। কারণ এটি খাস জায়গা। লিজ দিলে জেলা প্রশাসন বা পানি উন্নয়ন বোর্ড দিতে পারে। এই অপতৎপরতা অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার।
এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হলে রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হারুন-অর-রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশন আমাদের অনুমতি ছাড়াই শহররক্ষা বাঁধ দখল করে কাঁটাতারের বেড়া দিচ্ছে বা দিয়েছে। এটি তারা করতে পারে না। তারা কেন এ কাজটি করল, সেটি জানতে চেয়ে আমরা চিঠি দেব। সঠিক জবাব দিতে না পারলে ওই প্রাচীর ভেঙে ফেলা হবে।’
জানতে চাইলে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
অন্যদিকে রাসিকের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র নিযাম-উল-আযিম বলেন, সিটি করপোরেশনের আর্থিক দুরবস্থা কাটাতে লালন শাহ মঞ্চ লিজ দিয়ে রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া ওই মঞ্চেরও বিভিন্ন জিনিসপত্র স্থানীয়রা খুলে নিয়ে চলে যাচ্ছে। এটি দেখভালের জন্য সিটি করপোরেশনের নিজস্ব জনবল নিয়োগ দেওয়াও সম্ভব নয়। তাই ইজারা দিয়ে সেটিকে রক্ষণাবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’ সরকারি জায়গা দখল প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি আগে থেকেই রাসিকের আওতায় আছে। সে কারণেই সেখানে লালন শাহ মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে।’
বাংলাদেশ সময়: ১১:৪৭:০৬ ৪৪০ বার পঠিত