বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ
বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (বিপিএসসি) দুজন প্রভাবশালী সদস্যের কাছ থেকে ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেওয়া কয়েকজন অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন বলে অভিযোগ মিলেছে। পিএসসির ওই সদস্যের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা পাওয়া তিন পরীক্ষার্থীর আলাদা কথোপকথন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। তিনজনের মধ্যে একজন পররাষ্ট্র, একজন প্রশাসন ও অন্যজন পুলিশ ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়েছেন। ওই তিনজনের এ-সংক্রান্ত আলাপচারিতার ভিডিও ফুটেজ কালের কণ্ঠ’র হাতে এসেছে। এই কথোপকথন থেকে জানা যায়, বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেওয়া অন্তত ১২ জন আগাম ফল জানার সুযোগ পেয়েছেন, যাঁরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা। আইন অনুযায়ী পিএসসির কোনো সদস্য পরীক্ষার ফল আগাম কাউকে জানাতে পারেন না।
বিসিএসে উত্তীর্ণ এই তিনজন পিএসসির যে দুজন সদস্যের কাছ থেকে সুবিধা পাওয়ার কথা জানিয়েছেন তাঁরা হলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির এবং সাবেক অতিরিক্ত সচিব ওয়াজেদ আলী খান। গোপনে ধারণ করা ওই ভিডিও ফুটেজ থেকে জানা যায়, ৩৪তম বিসিএসে উত্তীর্ণ ও স্বীকারোক্তি দেওয়া দুজনের সঙ্গে পিএসসির সদস্য শরীফ এনামুল কবির ও ওয়াজেদ আলী খানের পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে।
জানা গেছে, ৩৪তম বিসিএসে যাঁরা উত্তীর্ণ হয়েছেন তাঁদের সবারই নিয়োগ প্রায় চূড়ান্ত। এখন বাকি শুধু স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পুলিশ ভেরিফিকেশন। আগামী দু-এক মাসের মধ্যে এসব প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করতে চায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
বিসিএস-উত্তীর্ণ ও স্বীকারোক্তি দেওয়া একজন হলেন ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. চৌধুরী মো. বাবুলের মেয়ে মুনিয়া চৌধুরী। তিনি প্রশাসন ক্যাডারে নির্বাচিত হয়েছেন। অন্যজন জান্নাতুল হাবিব নির্বাচিত হয়েছেন পররাষ্ট্র ক্যাডারে। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রভাষক। জান্নাতুল হাবিব জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য শরীফ এনামুল কবিরের ঘনিষ্ঠ বলে ভিডিও ফুটেজের কথোপকথন থেকে জানা গেছে। বিসিএসে উত্তীর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে শরীফ এনামুল কবির ও ওয়াজেদ আলী খানের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছেন বলে তাঁরা দাবি করেছেন। বিসিএসে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য সরাসরি কোনো পিএসসি সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করতেও অন্য পরীক্ষার্থীদের পরামর্শ দেওয়া হয় আলাপচারিতায়। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, পুলিশ ক্যাডারে উত্তীর্ণ হওয়া সাইফুল ইসলাম বলেছেন, কোনো মাধ্যম না ধরে সরাসরি পিএসসি সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ‘কাজ’ হয়। ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মুনিয়া চৌধুরী ওই আলাপচারিতায় বলেন, ‘ভাইভার আগে ওয়াজেদ আংকেলের বাসায় মাকে নিয়ে যাই। উনিও (ওয়াজেদ আলী খান) তো এক্সপেক্ট করেন আমি ওনার কাছে যাই। এরপর ওনার সঙ্গে বেশ কয়েকবার সিঁড়িতে দেখা হয়েছে।’ উনি শুধু মাথায় হাত দিয়ে বলেন, ‘দোয়া করো মা দোয়া করো।’ আমি মাকে গিয়ে বললাম, ‘মা দোয়া করোর মানে কী? আমার কী হইছে, কী হয় নাই? এর মানে যে এইটা, সেটা আমি বুঝি নাই।’
এই আলাপচারিতা কেউ একজন ভিডিওতে ধারণ করেছেন গোপনে। কালের কণ্ঠ’র হাতে আসা ওই ভিডি?ও ফুটেজে দেখা গেছে, মুনিয়া চৌধুরী বলছেন, তাঁর বাবা ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. চৌধুরী মো. বাবুলকে পিএসসির সদস্য ওয়াজেদ আলী খান বলেছেন, ‘কী বাবুল, তোমার মেয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে, আমি পিএসসির সদস্য আর আমি জানি না।’
ভিডিও ফুটেজে আরো দেখা যায়, মুনিয়া চৌধুরী আলাপচারিতার একপর্যায়ে বলেন, ‘আমার ভাইভা নিয়েছেন হাসিনুর রহমান। ওনার সঙ্গে বাবার ঝামেলার কারণে ৩৩তম বিসিএসে আমার হয় নাই। এটা সবাই জানে। তাই এবার (৩৪তম বিসিএস) আমার প্রতি সবার সহানুভূতি ছিল।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, মুনি?য়া চৌধুরী ইস্কাটন গার্ডেন সরকারি অফিসার্স কোয়ার্টারের নী?হারিকা ভবনের তৃতীয় তলায় থাকেন। আর ওয়াজেদ আলী খান থাকেন ওই ভবনের দ্বিতীয় তলায়।
ভিডিওতে ধারণ করা এই কথোপকথন সম্পর্কে জানতে চাইলে মুনিয়া চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই ভিডিও আপনি কোথায় পেয়েছেন? এ ধরনের কোনো ভিডিও থাকার কথা না। আমি এ ধরনের কথা বলিনি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়াজেদ আলী খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কোনো কথা বলব না। এ বিষয়ে আমার কোনো কথা নেই। আপনি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলুন।’ তাঁর বিরুদ্ধে বিসিএস পরীক্ষার্থীদের অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার অভিযোগের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি পিএসসির স্পোকস পারসন নই। সে কারণে কিছু বলব না।’
ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, ৩৪তম বিসিএসে পররাষ্ট্র ক্যাডারে উত্তীর্ণ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রভাষক জান্নাতুল হাবিব আলাপের একপর্যায়ে বলেন, ৩৪তম বিসিএসের ফল প্রকাশের ১২-১৫ দিন আগেই তিনি জানেন যে তিনি টিকেছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিসিএসে টিকেছেন এমন ১২ জনই ফল ঘোষণার বেশ আগেই জানতেন যে তাঁরা টিকেছেন, যেমন আর্কিওলজির হ্যাপি দাস। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর এক ছোট ভাইও আগে থেকে ফল জানতেন। জান্নাতুল হাবিব বলেন, ‘এটা জানা যায়। শরীফ স্যার তো আমাদের শিক্ষক। ওনার সঙ্গে তো আমাদের যোগাযোগ আছেই।’
ভিডিও ফুটেজে আরো দেখা যায়, জান্নাতুল হাবিব বলছেন, পিএসসির সদস্য এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির, ওয়াজেদ আলী খান ও শ্যামল চন্দ্র সরকার তাঁকে বিসিএসে উত্তীর্ণ হতে সহযোগিতা করেছেন। ওয়াজেদ আলী খানের ছেলে আজমল মাহমুদ খান জান্নাতুল হাবিবের সহকর্মী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক। জান্নাতুল হাবিব বলেন, ‘আজমল ভাই আমাকে একদিন এসে বললেন, তুমি তো বিসিএসে টপে আছো। তোমারটা আমি দেখেছি।’ জান্নাতুল হাবিব আরো বলেন, “শরীফ এনামুল কবির আমার আরেক সহকর্মীকে বললেন ‘ওর (জান্নাতুল হাবিব) তো বিসিএসে ফরেইনে (পররাষ্ট্র ক্যাডার) হয়ে গেছে। ও তো মনে হয় না থাকবে।’ এরপর আমি শরীফ স্যারের বাসায় গিয়ে দেখা করি। ওনি বলেন, ‘কাউকে বলাবলি করো না। তোমারটা হয়ে গেছে। তুমি তো এক নম্বর ক্যাডার পাইছো’।”
আলাপচারিতার একপর্যায়ে জান্নাতুল হাবিবের উদ্দেশ্যে উপস্থিত একজন প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘ওয়াজেদ স্যারের সঙ্গে আপনার আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল?’ উত্তরে জান্নাতুল বলেন, ‘ওয়াজেদ স্যার তো আমাদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড। ওনার ছেলে আমাদের এখানে জয়েন করার পর থেকে ওনার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। তবে আজমল ভাই বিসিএস নিয়ে প্যাসেইনেট না। ওনার বাবা যেহেতু পিএসসির সদস্য, ছেলে হিসেবে উনি তো জানতেই পারেন।’
জান্নাতুল হাবিব জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের জোট ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ’-এর একজন সদস্য।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জান্নাতুল হাবিব কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি ভিডিওর বিষয়টি জানি না। কার কাছে কখন কী বলেছি তাও এখন মনে করতে পারছি না। কারণ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি শরীফ এনামুল কবির ও আবুল কাশেম মজুমদার স্যারের সঙ্গে ভালো পরিচয় রয়েছে। ওনারা দুজনই পিএসসির সদস্য। হয়তো এরকম কিছু কারোর কাছে বলেছি, তারা গোপনে ভিডিও করেছে। আমি অত্যন্ত দরিদ্র ঘরের সন্তান। আমার প্রয়াত বাবার স্বপ্ন ছিল আমি যেন বিসিএস ক্যাডার হই।’ কোনো অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার কথা তিনি অস্বীকার করেন।
ফল আগে জানার স্বীকারোক্তি ফেসবুকেও : এদিকে ঢাকার আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির শিক্ষার্থী মো. ওয়ালিদ বিন কাশেম ফেসবুকে এক স্টেটাসের মাধ্যমে জানান, তিনি বিসিএস পরীক্ষায় মেধা তালিকায় প্রথম হয়েছেন। এ কথা তাঁকে জানিয়েছেন পিএসসিরই একজন সদস্য। পিএসসির ওই সদস্য তাঁর বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
জানা গেছে, বিসিএস পরীক্ষায় কোনো মেধা তালিকা প্রকাশ করা হয় না। এটা গোপন রাখা হয়। একমাত্র পিএসসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও সদস্যরাই এটা জানতে পারেন। ফল প্রকাশ হওয়ার আগে এ রকম ফেসবুক পোস্ট দেওয়ায় অনেকে এ নিয়ে প্রশ্ন করলে মো. ওয়ালিদ বিন কাশেম তাঁর পোস্টটি সরিয়ে ফেলেন। তিনি ৩৪তম বিসিএসে পররাষ্ট্র ক্যাডারে সুযোগ পেয়েছেন।
পিএসসি আইনের বরখেলাপ : পিএসসি আইন অনুযায়ী কোনো সদস্য পরীক্ষার ফল আগাম কাউকে জানাতে পারেন না। আর পরীক্ষায় উত্তীণ হওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করার তো সুযোগই নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিএসসির চেয়ারম্যান ইকরাম আহমেদ গত মঙ্গলবার নিজ কার্যালয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।’
পিএসসির কোনো সদস্যের পরীক্ষার ফল কাউকে আগাম জানানোর সুযোগ আছে কি না জানতে চাইলে ইকরাম আহমেদ বলেন, ‘এটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। পিএসসির মেম্বার ও আমি শপথ নিয়েছি। আমরা সংবিধানের কাছে দায়বদ্ধ। আগাম ফল প্রকাশ করার কোনো সুযোগ নেই কোনো সদস্যের।’ এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে বিষয়টি খতিয়ে দেখি। এরপর সে অনুযায়ী এর প্রতিকার নেওয়া হবে।’
অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবিরের বক্তব্য : এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির গতকাল শুক্রবার রাতে মোবাইল ফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এটা পুরনো ভিডিও। এটা ঠিক না। আমি এসবের মধ্যে জড়িত না। এ বিষয়ে পিএসসির চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বললে বিস্তারিত জানা যাবে।’
বাংলাদেশ সময়: ১১:৪৩:১২ ৪৬৫ বার পঠিত