বঙ্গনিউজ ডটকমঃ প্রতিটি বাসে কিলোমিটারের হিসাবসহ ভাড়ার তালিকা টানানোর কথা থাকলেও এখনও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা টানানো হয়নি। আবার কিছু কিছু বাস তালিকা টানালেও তাতে জালিয়াতির মাধ্যমে এক স্টপেজ থেকে অন্য স্টপেজের দূরত্ব ভিন্ন ভিন্ন দেখিয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। আর এই জালিয়াতির সঙ্গে পরিবহন মালিক-শ্রমিক চক্র ছাড়াও জড়িত খোদ বিআরটিএ’র কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী। বিআরটিএ’র ওয়েবসাইটে দেওয়া ভাড়ার তালিকা বিশ্লেষণ করে এই জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।মিরপুর চিড়িয়াখানা-সায়েদাবাদ (এ-১১৪) রুটে রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটির নির্ধারিত ভাড়ার তালিকায় ফার্মগেট থেকে প্রেসক্লাব পর্যন্ত দূরত্ব দেখানো হয়েছে ৪ দশমিক ১ কিলোমিটার। এই একই গন্তব্যে বালুঘাট-সায়েদাবাদ (এ-১৩৭) রুটে গন্তব্য দেখানো হয়েছে সাড়ে ৩ কিলোমিটার। আবার পল্লবী (সিরামিক) থেকে মতিঝিল পর্যন্ত (এ-১১১) নম্বর রুটের ভাড়ার তালিকায় ফার্মগেট থেকে পল্টনের দূরত্ব দেখানো হয়েছে ৪ দশমিক ৫ কিলোমিটার। এ রুটে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম থেকে নটর ডেম কলেজ পর্যন্ত ৩ দশমিক ২ কিলোমিটার দূরত্ব দেখানো হলেও চিড়িয়াখানা-সায়েদাবাদ রুটে স্টেডিয়াম থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত দূরত্ব দেখানো হয়েছে মাত্র ১ দশমকি ৩ কিলোমিটার। বাংলাদেশ ব্যাংক মোড় ও নটর ডেম কলেজ একসঙ্গে লাগোয়া হওয়ার পরও দুই রুটের ভাড়ার তালিকায় দূরত্ব পার্থক্য প্রায় ২ কিলোমিটার। অন্যদিকে আবদুল্লাহপুর-ফুলবাড়িয়া রুটে প্রেসক্লাব থেকে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ পর্যন্ত দূরত্ব দেখানো হয়েছে দেড় কিলোমিটার।
অন্যদিকে কালশী-ফুলবাড়িয়া রুটে (এ-১২৫) হাইকোর্ট মোড় থেকে ফুলবাড়িয়া পর্যন্ত দূরত্ব দেখানো হয়েছে ১ দশমিক ৯ কিলোমিটার অর্থাত্ প্রায় ২ কিলোমিটার। এরকম অধিকাংশ রুটের ভাড়ার তালিকার সঙ্গে অন্য রুটের ভাড়ার তালিকায় একই গন্তব্যে দূরত্বের তারতম্য পাওয়া গেছে বিআরটিএ’র দেওয়া তালিকায়। রাজধানীতে হাতেগোনা যে কয়েকটি বাসে রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটির নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা দেখা গেছে তাতে স্বাক্ষর করেছেন বিআরটিএ’র বিভাগীয় অফিসের কম্পিউটার অপারেটর মো. আনিসুর রহমান ও মোটরযান পরিদর্শক মো. আবুল হাছান।
পল্লবী-যাত্রাবাড়ী রুটের (এ-১০৭) ভাড়া তালিকায় ফার্মগেট থেকে মতিঝিল পর্যন্ত দূরত্ব দেখানো হয়েছে ৬ দশমিক ৪ কিলোমিটার। সেই হিসাবে মতিঝিল থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত কোনো মিনিবাসেরই ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি ১ টাকা ৬০ পয়সা হিসেবে ১০ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু নিউভিশন, বিকল্প, হাজী পরিবহনসহ সব পরিবহনই ভাড়া আদায় করে ১২ টাকা করে। সে ক্ষেত্রে এগুলো মিনিবাস হওয়ার পরও বাস দাবি করার পাশাপাশি দূরত্ব জালিয়াতি করে ভাড়া নির্ধারণ করেছে। যাত্রীরা অভিযোগ করেন, রাজধানীতে ছোট বাসগুলো মিনিবাস হলেও ভাড়া আদায় করার সময় বাস হিসেবে বেশি ভাড়া আদায় করছে। তাঁদের অভিযোগ, কিলোমিটার গরমিল করে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। কারণ সাধারণ মানুষ এক স্টপেজ থেকে অন্য স্টপেজের দূরত্ব কত তা জানেন না। একজন যাত্রী অভিযোগ করেন, কয়েক বছর আগে যখন ভাড়া বেড়েছিল তখন মিরপুর-১২ নম্বর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত দূরত্ব ৮ কিলোমিটার হিসেবে ভাড়া নেওয়া হতো ১৩ টাকা। কিন্তু এবার হঠাত্ করেই এই গন্তব্যের দূরত্ব ১ কিলোমিটার বেড়ে ৯ কিলোমিটার হয়ে গেল কীভাবে তা তাঁদের বোধগম্য নয়।
বাংলাদেশ যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি তুসার রেহমান বলেন, এবার ভাড়া জালিয়াতিতে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে ‘দূরত্ব জালিয়াতি’। এই জালিয়াতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়িত রয়েছে বলেই একেক রুটে একই গন্তব্যের দূরত্ব একেক রকম দেখিয়ে ইচ্ছামতো ভাড়া আদায়ের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের। তিনি বলেন, তাঁদের সংগঠনের একটি প্রতিনিধি দল সম্প্রতি একাধিকবার সরেজমিন পরিদর্শনের সময় রাজধানীতে কোনো মিনিবাস রয়েছে তার আলামত পায়নি। কারণ সব পরিবহনই ভাড়া আদায় করছে বাসের ভাড়া হিসেবে। অথচ মিনিবাসের ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি ১ টাকা ৬০ পয়সা ও বাসের ভাড়া ১ টাকা ৭০ পয়সা। এটা মালিক-শ্রমিকদের জালিয়াতি।
বিআরটিএ ও ট্রাফিক বিভাগকে ম্যানেজ করেই এই ভাড়া জালিয়াতি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পেয়েছেন তাঁরা। তিনি বলেন, মিনিবাসের সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ টাকা হলেও এ নিয়মও মানছে না কোনো পরিবহন। সিটিং সার্ভিসের নামে ১২ টাকার নিচে কোনো ভাড়া নেই রাজধানীতে। তিনি বলেন, মতিঝিল শাপলা চত্বর থেকে দৈনিক বাংলা মোড় হয়ে সরাসরি পল্টন চলাচলকারী বাসগুলোও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করার জন্য মতিঝিল থেকে গুলিস্তান হয়ে পল্টন চলাচল করে বলে খাতা-কলমে দেখিয়ে থাকে। দূরত্ব জালিয়াতির জন্য এটা করা হয়।
দূরত্ব জালিয়াতির বিষয়ে বিআরটিএ চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম বলেন, দূরত্ব অনুযায়ী ভাড়া নির্ধারণ করেছে রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটি। তবে এ ক্ষেত্রে কোনো জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, অতিরিক্ত ভাড়া ঠেকাতে বিআরটিএ’র ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করেই সরকার ভাড়া বাড়িয়েছে। তারপরও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। কেউ অতিরিক্ত ভাড়া নিলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিআরটিএকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যারাই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করবে তাদেরকেই আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট পরিবহনের রুট পারমিট বাতিল করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১০:৩৫:১৮ ৩৭৪ বার পঠিত