বঙ্গনিউজ ডটকমঃ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কবে দেশে ফিরবেন? যাওয়ার সময় ফেরার যে সময়ের কথা বলা হয়েছিল তা পার হয়ে যাওয়ায় প্রশ্নটি সামনে এসেছে। দলের পক্ষ থেকে এটুকু আভাসই দেওয়া হয়েছে যে, তার ফেরার বিষয়টা নির্ভর করছে চিকিৎসকের পরামর্শের ওপর। নির্দিষ্ট কোনো সময়ের কথা বলা হচ্ছে না। দুই বিদেশি নাগরিক হত্যার পর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এর সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত জড়িত বলে শুধু সন্দেহ নয়, সরাসরি অভিযোগ করেছেন। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কোনো কোনো ব্যক্তি ‘লন্ডন ষড়যন্ত্রের’ কথাও বলছেন। বেগম জিয়ার জন্য এটা আর একটা উটকো বিপদ কিনা কে জানে! লন্ডনে তার ওভার স্টে’র এটাও একটা নতুন কারণ হতে পারে। তার লন্ডন যাওয়ার পরপরই লিখেছিলাম, অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি জনিত কারণে অনিরাপদ মনে করলে তার দেশে ফেরা বিলম্বিত হতে পারে। সেই বিলম্ব কতটা দীর্ঘ হবে তা নির্ভর করবে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিগত আচরণের ওপর। সেই লেখায় উল্লেখ করেছিলাম, দেশে যদি আগাম একটি ইনক্লুসিভ নির্বাচন হয়, সরকার চাইতে পারে খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং তার দলের পক্ষে নির্বাচনী প্রচার থেকে দূরে রেখে নির্বাচনটা সেরে নিতে। সরকার যথার্থই চিন্তা করছে যে, খালেদা জিয়া নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হলেও বিএনপি এবার নির্বাচনে আসবে। দলের নির্বাচনমুখী নেতা-কর্মীরা এ ব্যাপারে একটা চাপ সৃষ্টি করতে পারে। পাঠক, আপনাদের নিশ্চয়ই স্মরণ আছে যে, সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান ছাড়াই নির্বাচনে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করে আগাম নির্বাচন দাবি করেছেন। গয়েশ্বর রায়ের এ বক্তব্য দলের নীতিনির্ধারণী বক্তব্য না হলেও অর্থহীন নয়। কেউ কেউ তার ওই বক্তব্যের সঙ্গে সরকারের যোগসাজশ খুঁজছেন। রাজনৈতিক এ ধরনের বড় ইস্যুতে সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে কৌশলগত আলোচনা হতেই পারে। গয়েশ্বর বাবুর সঙ্গেও তেমন আলোচনা সরকার পক্ষের কারও হতেই পারে। গণতন্ত্রে এটা সম্ভব ও বাস্তব। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমগ্র দল সরকারি পরিকল্পনার সঙ্গে একমত না হলে সরকার পক্ষ দলের একটা অংশকে তার পরিকল্পনার অনুকূলে ‘বশে’ আনার চেষ্টা করতে পারে। এমনও হতে পারে যে, কোনো একটি বিষয়ে সরকারের কোনো সিদ্ধান্তের প্রশ্নে, জাতীয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে, যেমন বর্তমান অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে, বিশেষ করে দুই বিদেশি নাগরিক হত্যাকাণ্ডের পর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইতালি, জার্মানি, জাপানসহ উন্নয়ন সহযোগী বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র এবং ইইউ-জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার রেড অ্যালার্ট জারি ও নেতিবাচক অবস্থানের পর দেশের ভাবমূর্তি সংকট মোকাবিলায় এবং পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার সৎ উদ্দেশ্যে একটি আগাম নির্বাচন প্রশ্নে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার বিষয় নিয়ে একটি দলের ভিতর মতভেদও দেখা দিতে পারে এবং পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থানগত একটা আন্তঃদলীয় লড়াইও শুরু হতে পারে। গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বক্তব্য বিএনপিতে সেই রকম আন্তঃদলীয় সংগ্রামের সূচনা কিনা অথবা তার মুখ দিয়ে গোটা দল পরিস্থিতিটা বাজিয়ে দেখছে কিনা এখনই তা বলা মুশকিল। তবে তার অবস্থানের পেছনে সবল রাজনৈতিক-সাংগঠনিক যুক্তি আছে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি নিয়ে বিতর্ক এখনো আছে এবং তা ইতিহাসেরই অংশ হয়ে থাকবে যে, বাংলাদেশের দশম সংসদ নির্বাচনটি একটি আদর্শ নির্বাচন ছিল না। ৩০০ আসনের সংসদে ১৫৩ আসনে প্রত্যক্ষ কোনো নির্বাচনই হয়নি; অথচ বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদে তা বাধ্যতামূলক বলে নির্দেশ রয়েছে। সরকার তা অগ্রাহ্য করেছে। সমঝোতার মাধ্যমে তারা ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ এরশাদের জাতীয় পার্টি, মেননপন্থি সরকারি ওয়ার্কার্স পার্টি এবং ইনুপন্থি সরকারি জাসদ মিলে সিটগুলো ভাগাভাগি করে নিয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এমন নজির একটিও নেই। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সেই নির্বাচন বর্জন করেছিল নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের প্রতিবাদে। তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বলে পূর্বাহ্নেই ঘোষণা দিয়েছিল। তাদের প্রাথমিক সেই সিদ্ধান্তকে যৌক্তিক মনে করেছিলেন অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক। কেননা, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি সাংবিধানিক বিধি ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছিল আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সর্বদলীয় সিদ্ধান্তে। কিন্তু ব্যবস্থাটি বাতিল করা হয়েছে মূলত আওয়ামী লীগের একদলীয় সিদ্ধান্তে। সংবিধান সংশোধনের জন্য যে বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তাতে সরকারের অনুগামী-অনুসারী যেসব ক্ষমতার কাঙাল অন্তর্ভুক্ত ছিলেন মেনন, ইনু, আনিসুল ইসলাম মাহমুদসহ অন্যরাও কমিটি সভায় তত্ত্বাবধায়কের পক্ষে মত দিয়েছিলেন। এমনকি কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দুই দিন আগেও বলেছিলেন যে, ব্যবস্থাটি থাকছে। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা রাখাটা যে জরুরি ছিল, তা সরকারি দলগুলোও অনুভব করেছিল। কাজেই এ ব্যাপারে বিএনপি-জামায়াতের দৃঢ় অবস্থান যথার্থই ছিল। কিন্তু সরকার যখন নির্বাচনকালীন দলীয় সরকারের অবস্থান থেকে সরে গিয়ে সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব দেয়, বিএনপির তা বিবেচনায় নেওয়া অতীব জরুরি ছিল। শুধু সর্বদলীয় সরকার নয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৎকালীন সংসদীয় বিরোধী দল বিএনপিকে পছন্দমতো মন্ত্রণালয় বেছে নেওয়ারও অফার দিয়েছিলেন। সরকারের পক্ষে এর চেয়ে বেশি ছাড় আর কী হতে পারত? বিএনপি সেই প্রস্তাব গ্রহণ না করে ভুল করেছে এবং সেই ভুলেরই খেসারত দিচ্ছে এখন। তখন পরিস্থিতিটা বিএনপি-জামায়াতের অনুকূলে ছিল। বলাই বাহুল্য যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দলের বিভিন্ন অঙ্গ-সহযোগী দলের ওপর, এমনকি মূল দলের জেলা-উপজেলার ওপরও নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলে। ফ্রিস্টাইলেই চলতে থাকে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, অস্ত্রবাজিসহ নানা অন্যায়, অনিয়ম, দুর্নীতি। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমান যাকে ‘বাজিকরি’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘দেশ এখন বাজিকরের হাতে।’ ফলে ক্ষমতাসীন লীগ সরকার দিনে দিনে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তখনই একদলীয় সিদ্ধান্তে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়া হয়। কিন্তু তাতে জনমত সরকারের প্রতি আরও বিরূপ হয়। ওই পরিস্থিতিতে লীগ সরকারের প্রস্তাবিত সর্বদলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে গেলে বিএনপি-জামায়াত জোট অনেক ভালো করত। গত মাসের শেষ সপ্তাহে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের এক টকশোতে সরকারের ক্ষমতার পার্টনার ইনুপন্থি জাসদের প্রবীণ নেতা মইন উদ্দীন খান বাদল যথার্থই বলেছিলেন যে, ‘সেদিন অনেকের পেটে গুড়গুড়ি শুরু হয়ে গিয়েছিল।’ তার এ বক্তব্যটি খুবই অর্থবহ। তিনি কি ‘মিন’ করেছেন, কার বা কাদের ‘পেটের গুড়গুড়ি’র প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, তা দুর্বোধ্য নয়। বিএনপির রাজনীতিসচেতন নেতা-কর্মীরা এখন সে বাস্তবতা উপলব্ধি করছেন। যদি সেই নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত অংশগ্রহণ করত, জাসদ নেতা মইন উদ্দীন খান বাদলের ইঙ্গিত অনুযায়ী ২০ দলীয় জোট ক্ষমতায় যেতে পারত; আর ক্ষমতায় যেতে না পারলেও একটি প্রতাপশালী বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হতো। সেই সঠিক সিদ্ধান্তটি নিলে পরবর্তীকালে এই বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সরকার হটানোর আন্দোলনের নামে যে হঠকারিতা করা হয়েছে, সেই পথে যাওয়ার প্রশ্নই আসত না; এখন দেশের জনগণের মৌলিক অধিকার ভোগের পথে যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে, তা করতে পারত না সরকার। বিএনপির মতো একটি বিপুল জনসমর্থিত দল এখন মিটিং, মিছিল, বিক্ষোভ করা তো দূরের কথা, মানববন্ধনের মতো একটা নিরীহ কর্মসূচিও পালন করতে পারে না। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত যদি ১০০ প্লাস-মাইনাস সদস্য নিয়ে সংসদে বিরোধী দলেও থাকত, সরকার কি এমন রূঢ় আচরণ করতে পারত? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও বিরোধী দলের প্রতি সংযত আচরণে বাধ্য হতো। দলের শত-সহস্র নেতা-কর্মীকে জেলে যেতে হতো না, লাখো মামলার জালে আটকা পড়ত না বিএনপির মতো এখনো অস্বাভাবিক জনপ্রিয় একটি দল। ঈর্ষণীয় সৌভাগ্য নিয়ে বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটির জন্ম। এমন জনপ্রিয়তা নিয়ে জন্ম নিয়ে ৩৭-৩৮ বছর পরও সেই একই জনপ্রিয়তা ধরে রাখার ভাগ্য পৃথিবীর আর কোনো দলের ভাগ্যে জুটেছে খুবই কম। রাজনৈতিক সমর্থকরা বিষয়টি বিবেচনা করেন একভাবে; কিন্তু গবেষকরা এ বিষয়টির অর্থাৎ বিএনপির জনগণের মধ্যে স্থায়ী জনপ্রিয়তার বিষয়টির অন্তর্নিহিত কারণ বাস্তবতার নিরিখে তাদের মতো করেই অনুসন্ধান করবেন এবং সিদ্ধান্তে পৌঁছবেন। সন্দেহ নেই যে, দলটির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক কিংবদন্তি নায়ক। তার কণ্ঠ নিঃসৃত ‘আমি মেজর জিয়া বলছি…’ এখনো অসংখ্য বয়সী মানুষের কানে অনুরণিত হয়। তার দেশপ্রেম, সততার অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত অনেকের কাছে এখনো প্রেরণার উৎস। নেতার কারণেই শুধু নয়, নীতির কারণেও বিএনপি এখনো তার জনপ্রিয়তা অটুট রাখতে পেরেছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, প্রতিষ্ঠাতার চারিত্রিক গুণাবলি এখন বিএনপির মূল নেতৃত্ব ধারণ করেন না বলেই বিস্তর অভিযোগ। দলটি এখন নীতিচ্যুতও। অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সীমাহীন অভিযোগ। বিএনপি নেতাদের প্রায় সবাই জনগণের চেনা মানুষ। ১৫ বছর আগেও এদের অনেকে কী ছিলেন, এখন কী হয়েছেন মানুষ তা দেখছে। ধারণাটাও পরিষ্কার। অধিকাংশই এখন সহজ পথে অর্জিত বিত্তবৈভব রক্ষার কাজে নিয়োজিত। গা বাঁচিয়ে চলেন। কারও কারও বিরুদ্ধে সরকারের সঙ্গে আপস বা অাঁতাতেরও অভিযোগ বেশ জোরালো। নেতৃত্বের দুর্বলতা, ব্যর্থতা, ক্ষেত্রবিশেষে অদক্ষতার কারণে এত বিপুল জনসমর্থন থাকার পরও বিএনপি এখন ‘ফেরারি’। এই অবস্থান থেকে বিএনপিকে উদ্ধার করার চিন্তা ও চেষ্টা দলের মধ্য থেকে হতেই পারে। বিএনপির নীতিনির্ধারণী স্থায়ী কমিটির যে দশা আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সঙ্গে তুলনা করলে হতাশই হতে হয়। চ্যালেঞ্জ দিয়ে অনেকে বলতে চান যে, দলটির আদর্শিক ভিত্তি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণাও নেই এই কমিটির কারও কারও। কেউ কেউ আছেন, থানা-জেলা পর্যায়ে দল চালানো দূরের কথা, কখনো একটা ক্লাবও চালিয়েছেন কিনা সন্দেহ। বলা হতে পারে, নীতিনির্ধারকদের এতকিছুর প্রয়োজন কী? কিন্তু তাই বলে নীতিনির্ধারকদের নীতিজ্ঞানও থাকবে না? তা থাকলে বারবার দল এত ভুল করে কীভাবে? একটা কথা প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে, যে দলে কর্তৃত্বপরায়ণতা এত বেশি, পরিবার বিশেষ এবং অন্যদের সম্পর্ক যেখানে প্রভু ও দাসের মতো সেখানে নীতিনির্ধারণী কমিটি হোক বা অন্য কিছু হোক তাতে নিম্নমানের পছন্দের লোকই তো বাছাই করা হবে। কমিটি অর্নামেন্টাল করার জন্য কিছু উজ্জ্বল ব্যক্তিকে স্থান দেওয়া হলেও ‘মানটা’ সেরকম দেওয়া হয় না। ফলে তারা কোনো ভূমিকাও রাখতে পারেন না। নীতিনির্ধারণী কমিটির বিবর্ণ চেহারা দেখেই তো বোঝা যায় নিচের দিকের অবস্থাটা আরও কত ভয়াবহ! ঢাকায় বসে যদি সরিষাবাড়ীর কোনো ইউনিয়ন কমিটির নেতৃত্ব বিক্রি করে দেওয়া হয় কিংবা নোয়াখালীর বা পঞ্চগড়ের কোনো পৌর কমিটি এমনকি বগুড়ার কোনো থানা কমিটির নেতৃত্ব বেচাবিক্রি হয়ে যায় তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের অমতে ও অজ্ঞাতে, তা থেকে সংগঠনের অবস্থাটা যে কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তা সহজেই অনুমেয়। এ অবস্থায় দলের নিঃস্বার্থ নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীদের সব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার প্রকাশই হয়তো ঘটেছে গয়েশ্বর বাবুর বক্তব্যে, পর্যবেক্ষকরা এমনটাই ভাবছেন। তারা দলের ‘ফেরারি’ জীবনের অবসান চান। দলকে নিয়ে আসতে চান অন্ধকার থেকে আলোয়। হতে চান আলোর পথের অভিযাত্রী। দলে আরও অনেক রাজনীতিবিদ আছেন (যারা কোণঠাসা) এমন মতানুসারী; কিন্তু গয়েশ্বর রায়ের মতো সাহস করে হয়তো কথাটা বলতে পারছেন না।
ধারণা করা হয় যে, মুখে নেতা-কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা রাখার জন্য যাই বলা হোক না কেন, সরকার একটা আগাম নির্বাচনের ব্যাপারে দেশি-বিদেশি নানা চাপের মধ্যে রয়েছে। একটা নির্বাচন হয়তো ২০১৬ সালের মধ্যেই জাতির সামনে এসে যেতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার কি পরাজিত হওয়ার নির্বাচন দেবে? কোনো সরকারই পরাজিত হতে চায় না। বর্তমান সরকারপ্রধান বিএনপি দলের চেয়েও দলনেত্রী খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাকে বেশি ভয় পান। তাকে মামলা-মোকদ্দমায় জর্জরিত করে তার জনপ্রিয়তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার। কিন্তু ভুল শোধরানোর পথ নেই। সরকার তাই চাইতে পারে খালেদা জিয়াকে বাইরে রেখে, নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে বা নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার কোনো আইনি পথ বের করে নির্বাচনে যেতে। বেশ শোনা গিয়েছিল যে, সরকার খালেদা জিয়াকে ‘মাইনাস’ করার চিন্তা করছে। এমন প্রচার-প্রচারণা বা ধারণা থেকেই খালেদা জিয়া তার জেদ্দা সফর বাতিল করেছেন এবং লন্ডন সফর বারবার পিছিয়েছেন বলে নানা মহল থেকে বলা হয়েছে। খালেদা জিয়ার সামনে সংকট আছে তো বটেই! তিনি নিজেও নিশ্চয়ই তা অনুধাবন করেন। তিনি এও ভাবতে পারেন, চলমান মামলাগুলোতে যদি তার সাজা হয়ে যায় সরকার কারাগারে তার সঙ্গে ভালো আচরণ না-ও করতে পারে; এমনকি ওয়ান-ইলেভেনের পর মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকারের আমলে বিশেষ কারাগারে যে বিশেষ সুবিধা পেয়েছিলেন তা-ও না পেতে পারেন। তার শারীরিক অবস্থা তেমন ধকল সহ্য করার মতো নেই। তাই তিনি তার লন্ডন অবস্থান আরও কিছু বিলম্বিত হয়তো করতে পারেন পরিস্থিতি অাঁচ করার জন্য। সম্প্রতি দুই বিদেশি হত্যার ঘটনা পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে। সরকার এতে বিব্রতকর অবস্থায় আছে। দেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট হয়েছে। কখনো কখনো বিভিন্ন দেশে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যে, সরকারকে তার প্রধান প্রতিপক্ষ আঘাত না করলেও ‘ক্ষয়রোগে’ আক্রান্ত হয় সরকার। চতুর্দিক অন্ধকার হয়ে আসে। তখন তার জন্য একটা ‘সেইফ এঙ্টি’ প্রয়োজন হয়। খালেদা জিয়া এমনও ভাবতে পারেন যে, তেমন একটা ‘সেইফ এঙ্টি’ হয়তো লীগ সরকারের জন্যও জরুরি হয়ে যাচ্ছে। সরকার তার ব্যাপারে বৈরী সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথে অগ্রসর না হলে তিনি হয়তো শিগগিরই দেশে ফিরবেন, নতুবা রাজনীতির খেলাটা বাইরে থেকেও খেলার চিন্তা করতে পারেন। তিনি গেছেন চিকিৎসার কথা বলে। ওটা তো জরুরি ছিল। গিয়েই তো অপারেশনের কাজটা সারতে পারতেন। প্রথম কাজটা শেষে করলেন কেন? বিলেতে অবস্থান কিছুটা হলেও বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য? তিনি কি ভাবছেন ‘উপস্থিত’ খালেদা জিয়ার চেয়ে সরকারি রোষানলের কারণে ‘অনুপস্থিত’ খালেদা জিয়া অধিকতর শক্তিশালী হবেন? খালেদা জিয়াকে ছাড়াই গয়েশ্বর রায়ের নির্বাচন দাবির কি কোনো সংযোগ আছে এই রাজনৈতিক সমীকরণের সঙ্গে?
বাংলাদেশ সময়: ১৭:৩৩:৫০ ৩৯৩ বার পঠিত