বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ
মহাবিপদে পড়েছেন রাজধানীর রমনা, গেণ্ডারিয়া, সূত্রাপুর, কোতোয়ালি ও ডেমরা এলাকার শত শত বাড়ি ও জমির মালিক। গত চার বছর ধরে বন্ধ রয়েছে তাদের জমির নামজারি, খাজনা পরিশোধ, বেচাবিক্রিসহ সব ধরনের কার্যক্রম। সরকারি খাস জমি উল্লেখ করে ভূমি অফিস এসব জমিজমা নিয়ে যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে। বিপদগ্রস্তরা বলছেন, জমিজমা বিক্রি, নামজারি বা খাজনা পরিশোধসহ কোনো কাজে গেলেই ভূমি অফিস থেকে একটি প্রজ্ঞাপন দেখিয়ে বলা হচ্ছে, জমি বিক্রি, নামজারি বা খাজনা পরিশোধ করতে চাইলে ওই জমির বর্তমান বাজারমূল্যের ২৫ শতাংশ অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে। বাড়িঘরের জমির ক্ষেত্রে দিতে হবে ৩০ শতাংশ। এসব এলাকায় কাঠাপ্রতি জমির বর্তমান বাজারমূল্য স্থানভেদে ২০ লাখ টাকা থেকে কোটি টাকা। ফলে এক কাঠা জমির জন্যই তাকে পরিশোধ করতে হবে ৫ থেকে ২৫ লাখ টাকা। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ তারা পরিশোধ করতে পারছেন না। তারা বলছেন, যুগ যুগ ধরে তারা এসব জমির মালিক। খাজনাও নিয়মিত পরিশোধ করেছেন। অনেক জমি কয়েকবার বেচাবিক্রি শেষে মালিকানাও পরিবর্তন হয়েছে। কেন এই অবস্থা_ জানতে চাইলে কোতোয়ালি সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আসলাম মিয়া সমকালকে বলেন, ব্রিটিশ আমলে এসব জমি সরকারি খাসমহল ছিল। ব্রিটিশ সরকার সেগুলো বিভিন্ন জনকে লিজ দিয়েছিল। ব্রিটিশ-পরবর্তী আমলের সরকারগুলো সেই বরাদ্দ ঠিক মেনে নিতে পারেনি। ততদিনে এসব জমি তাদের নামে রেকর্ডও হয়ে গেছে। অনেক জমির মালিকানাও পরিবর্তন হয়েছে। সর্বশেষ ২০১১ সালে সরকার এসব জমির বাজারমূল্যের ২৫ শতাংশ অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে তাদের স্থায়ী মালিক হওয়ার সুযোগ করে দেয়। এই অর্থ যারা দিচ্ছেন না তাদের জমির সব কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হচ্ছে। কেন এই ভোগান্তি :এ প্রসঙ্গে খোঁজ নিতে গেলে ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা জানান, ব্রিটিশ আমলের রেকর্ডপত্রে ডেমরা, সূত্রাপুর, কোতোয়ালি ও রমনা এলাকায় অন্তত এক হাজার একর সরকারি খাস জমি ছিল। ১৯৩০ সালে সরকার এসব জমি ৩০ বছর মেয়াদে বিভিন্ন ব্যক্তিকে লিজ দেয়। শর্ত ছিল_ দুই দফায় লিজ নবায়ন করার পর লিজ গ্রহীতা ওই জমির স্থায়ী মালিক হবেন। পাকিস্তান আমলে ব্রিটিশ সরকারের রেকর্ডপত্রগুলো আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিলেও সরকার ওই জমি আর সরকারি মালিকানায় ফিরিয়ে নেয়নি। লিজ গ্রহীতাদের নামে সে সময় ওইসব জমি রেকর্ড হয়ে যায়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও ওই জমি নিয়ে আর কোনো উচ্চবাচ্য হয়নি। ১৯৮৫ সালে এরশাদ সরকারের আমলে লিজ গ্রহীতাদের জমির মালিক ঘোষণা দিয়ে সরকার আদেশও জারি করে। এর পরই ওই সব এলাকায় গড়ে ওঠে শত শত ঘরবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্প-কারখানা। ২০০৫ সালে বিএনপি সরকার আকস্মিকভাবে ১৯৮৫ সালের সরকারি আদেশ বাতিল করে ওই সব জমিকে আবার খাস জমি উল্লেখ করে ‘দখলদারদের’ ছেড়ে দিতে বলে। এ নিয়ে ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি হলে ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার এই সমস্যার সমাধানে নতুন করে আরেকটি আদেশ জারি করে। এতে বলা হয়, ব্রিটিশ আমলে বৈধভাবে যারা খাস জমি লিজ নিয়েছিলেন, তারা এসব জমির মালিক হবেন। তবে এসব লিজ গ্রহীতাকে ওই সম্পত্তির বাজারমূল্যের ২৫ শতাংশ অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে। কোনো জমিতে ভবন উঠে থাকলে সে ক্ষেত্রে মোট দামের ৩০ শতাংশ অর্থ সরকারি কোষাগারে দিতে হবে। ফলে নতুন করে আবার বিপত্তি দেখা দেয়। অথচ ইতিমধ্যে এসব জমিতে বহুতল আবাসিক ও বাণিজ্যিক, শিল্প-কারখানাসহ নানাবিধ বহুতল অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। সহকারী কমিশনার (ভূমি) আসলাম মিয়া বলেন, সূত্রাপুরে এক কাঠা জমির বাজারমূল্য ৩০ লাখ টাকা। চার কাঠার একটি প্লটকে বৈধ করতে হলে একসঙ্গে ৩০-৪০ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া অনেকের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। তারা দিতেও চাইছেন না। না দিলে খাজনাও নেওয়া হচ্ছে না। জমি বিক্রিও করতে পারছেন না। তিনি জানান, বিষয়টি সরকারকে জানানো হয়েছে। এ ব্যাপারে বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। ভুক্তভোগীরা যা বলেন :ফরিদাবাদের ২০ হরিচরণ রোডের বাড়ির মালিক কাজী ফজলে মওলা ওরফে লাল মিয়া সমকালের কাছে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তার দাদা কাজী আজিজ আহমদ ও দাদি জেবুন্নেসা আরেকজনের কাছ থেকে পাকিস্তান আমলে ওই জমি কিনেছিলেন। ওই লোক যার কাছ থেকে কিনেছিলেন সেসব দলিলও তাদের কাছে আছে। নিয়মিত খাজনাও তিনি পরিশোধ করেছেন। মাস খানেক আগে জয়কালী মন্দির সংলগ্ন ভূমি অফিসে খাজনা দিতে গেলে বলা হয়, তার বাড়ি এক সময় খাস জমি ছিল। কাজেই ওই জমির মালিক সরকার। এখন নতুন করে মালিক হতে চাইলে ৪০ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে। তা না হলে কোনো খাজনা নেওয়া হবে না। পরে লাল মিয়া তার পক্ষের সব কাগজপত্র ভূমি অফিসের কর্মকর্তাদের দেখালেও কোনো কাজ হয়নি। প্রায় ১০০ বছর পর ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি খাস হওয়ার বিষয়টিও তার মাথায় ঢুকছে না। পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়ার ৩৩ শাঁখারীনগর লেনের বাসিন্দা আনোয়ার উদ্দিন আহমেদ সমকালের কাছে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, গত মাসে তিনি খাজনা দিতে গেলে তার বাড়িও খাস জমি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তাকেও বলা হয়, তার বাড়ির বর্তমান মূল্যের ৩০ শতাংশ অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে। এরপর তিনি বিস্মিত হয়ে ফিরে যান। এরপর থেকে তার রাতে ঘুম হচ্ছে না। উচ্চ রক্তচাপও বেড়ে গেছে। আনোয়ার উদ্দিন আরও অভিযোগ করেন, ভূমি অফিসের লোকজন অনেকের কাছ থেকে উৎকোচ নিয়ে তাদের খাজনা পরিশোধের সুযোগ করে দিচ্ছে। তার কাছেও কাঠাপ্রতি ২০ হাজার টাকা চাওয়া হয়েছিল। তিনি দিতে রাজি হননি। ভূমি অফিসে চলছে রমরমা বাণিজ্য :জানা গেছে, এসব এলাকায় খাস জমির ভীতি এমনভাবে চাউর হয়েছে, সবাই মনে করছে নামজারি বা খাজনা আদায়সহ জমিজমার সব কার্যক্রমই বন্ধ। কিন্তু ব্রিটিশ আমলের ওই খাস জমি ছাড়াও বিপুল পরিমাণ ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিও এসব এলাকায় আছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন জমির খাজনা পরিশোধ করতে গেলে ভূমি অফিসের লোকজন সেটাকেও খাস জমি হিসেবে জাহির করছে। পরে উৎকোচ নিয়ে খাজনা বা নামজারির কার্যক্রম সম্পন্ন হচ্ছে। এই সুযোগে ভূমি অফিসের একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী মোটা অঙ্কের আর্থিক ফায়দা লুটছে। আবার ভূমি অফিসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ম্যানেজ করলে খাস জমিরও নামজারির সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। দায়িত্বশীলদের বক্তব্য :এ প্রসঙ্গে ঢাকার সহকারী জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আবুল ফজল মীর বলেন, ব্রিটিশ আমলে লিজ দেওয়া জমি নিয়ে একটা সমস্যা তৈরি হয়েছে। কারণ কেউই এই বিপুল পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে চাইছে না। তারা তাদের পক্ষে জমির মালিকানার সব কাগজপত্রও দাখিল করছেন। এই সমস্যার কীভাবে সমাধান করা যায় তা গভীরভাবে চিন্তা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪:২১:০৮ ৩১২ বার পঠিত