বঙ্গনিউজ ডটকমঃ বিবাহিত জীবনে অসুখী এক চলচ্চিত্র পরিচালক ভালোবেসে ফেলেন এক নবাগতা নায়িকাকে। প্রতিভাবান এই পরিচালককে জীবনের আরাধ্য পুরুষ করে তোলেন সেই অভিনয়শিল্পীও। কিন্তু পরিচালকের সন্তানের অনুরোধে তিনি দূরে সরে যান। ধীরে ধীরে সেই পরিচালকের জীবনকে গ্রাস করে একাকীত্বের অন্ধকার।অনেকে বলেন ‘কাগজ কে ফুল’ সিনেমার এই গল্পই সত্যি হয়ে উঠেছিল পরিচালক-প্রযোজক-অভিনেতা গুরুদত্ত এবং অভিনেত্রী ওয়াহিদা রেহমানের জীবনে। সিনেমাটি শুরু হয় একটি গান দিয়ে, ‘বিছড়ে সাভি বারি বারি’ যার বাংলা করলে দাড়ায়, ‘একে একে সবাই ছেড়ে গেলো’ - এ গানটি গুরু দত্তের জীবনের নিদারুণ সত্য হয়ে ওঠে।
গুরু দত্তর জন্ম ১৯২৫ সালের ৯ জুলাই। তার নাম ছিল বসন্তকুমার শিব শংকর পাড়ুকোন। দক্ষিণ ভারতের অভিজাত ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান তিনি। গুরু দত্ত ছিল তার পর্দা নাম। বাবা-মা দুজনেই শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ফলে সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে ওঠেন তিনি।
কলকাতার ভবানীপুরে শৈশব কাটে তার। তিনি বাঙালি সংস্কৃতির অনুরাগী ছিলেন। বাঙালিদের মতোই বাংলা বলতে পারতেন। এই জন্যই বাঙালি নাম গ্রহণ করে হয়ে গেলেন গুরু দত্ত।
গুরু দত্ত ছিলেন একাধারে পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার ও অভিনেতা। এই চার ভূমিকাতেই তিনি ছিলেন সফল। শুধু তাই নয় গুরু দত্ত এগিয়ে ছিলেন তার সময়ের চেয়ে। তার পরিচালিত ‘পিয়াসা’, ‘কাগজ কে ফুল’ ছবি দুটিকে বলা হয় বলিউডের শতবর্ষের ইতিহাসে অন্যতম সেরা সৃষ্টি। তার পরিচালিত ছবির মধ্যে রয়েছে ‘বাজি’, ‘বাজ’, ‘পিয়াসা’, ‘আর পার’ , ‘জাল’, ‘কাগজ কে ফুল’, ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ফিফটিফাইভ’, ‘সয়লাব’। প্রযোজক ছিলেন ‘আর পার’, ‘সিআইডি’, ‘পিয়াসা’, ‘গৌরি’, ‘কাগজ কে ফুল’, ‘চৌধভিন কা চান্দ’, ‘সাহেব বিবি অউর গোলাম’,‘বাহারে ফির ভি আয়েগি’ ছবির। অভিনেতা হিসেবেও ছিলেন জনপ্রিয়। ‘সাহেব বিবি অউর গোলাম’সহ বিভিন্ন ছবিতে অনবদ্য অভিনয় করেন তিনি।
গুরু দত্ত ১৯৫৩ সালে বিয়ে করেন সে সময়ের সুপরিচিত প্লেব্যাক শিল্পী গীতা দত্তকে। তাদের বিবাহিত জীবন সুখের হয়নি। পরিচালক ও অভিনেতা হিসেবে দারুণ গোছানো হলেও ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন খামখেয়ালি, আবেগপ্রবণ ও ছন্নছাড়া স্বভাবের। ধূমপান ও মদ্যপানে আসক্ত ছিলেন।
এরই মধ্যে ১৯৫৬ সালে গুরু দত্তর সঙ্গে পরিচয় হয় ওয়াহিদা রেহমানের। ওয়াহিদা তখন তেলেগু ছবিতে অভিনয় করে খানিকটা খ্যাতি পেয়েছেন। এক ফিল্মি পার্টিতেই দুজনের আলাপ হয়। সুন্দরী ও পরিশীলিত ওয়াহিদার প্রতি আকৃষ্ট হন গুরু দত্ত। তিনি তাকে মুম্বাই নিয়ে আসেন। ‘সিআইডি’ ছবিতে খলচরিত্রে সুযোগ দেন তাকে। এর পর ‘পিয়াসা’তে কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রে অভিনয় করেন ওয়াহিদা। ‘চৌধভিন কা চান্দ’ ছবিতে ওয়াহিদার বিপরীতে অসামান্য অভিনয় করেন গুরুদত্ত। তাদের পর্দা-রসায়ন যেমন অনবদ্য ছিল, তেমনি ব্যক্তি জীবনেও তারা ছিলেন পরস্পরের সেরা বন্ধু। স্নিগ্ধ ও ধীরস্থির স্বভাবের ওয়াহিদার প্রেমে পড়ে যান ছটফটে ও আবেগপ্রবণ গুরু দত্ত।প্রথমদিকে এই প্রেমের ফলে তাদের ক্যারিয়ারেও সাফল্য যোগ হয়। দুজনেরই অভিনয়ে পরিপক্কতা আসে। কিন্তু এই প্রেম গুরু দত্তর দাম্পত্যজীবনকে করে তোলে বিষময়। গীতা দত্ত তাকে ত্যাগ করেন। যদিও তাদের বিচ্ছেদ হয়নি কিন্তু তারা পৃথকভাবে বাস করতে শুরু করেন যা গুরু দত্তের মানসিক টানাপড়েন আরও বাড়িয়ে দেয়। কারণ তিনি যেমন ওয়াহিদাকে ভালোবাসতেন তেমনি ভালোবাসতেন নিজের স্ত্রীকেও। দুজনের কাউকেই ত্যাগ করতে চাননি তিনি।
ব্যক্তিগত জীবনের এই টানাপড়েন নেতিবাচক ছাপ ফেলে তার ক্যারিয়ারে। আশানুরুপ বাণিজ্যিক সাফল্যের দেখা পায় না ‘কাগজ কে ফুল’। এ ছবিতেও অভিনয় করেছিলেন ওয়াহিদা-গুরু জুটি। যদিও কাহিনি, পরিচালনা, অভিনয় সব দিক থেকে ছবিটি ছিল এক অসামান্য সৃষ্টি। কিন্তু বিবাহিত পরিচালকের সঙ্গে নায়িকার প্রেমের কাহিনি সে সময়ের দর্শক গ্রহণ করতে পারেনি। পরবর্তীতে অবশ্য ক্ল্যাসিকের মযর্াদা পেয়েছে সিনেমাটি।
এ ছবির সে সময়কার ব্যর্থতা আবেগপ্রবণ দত্তকে আলোড়িত করেছিল। অন্যদিকে ওয়াহিদার ক্যারিয়ার তখন তরতর করে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। দেবানন্দের বিপরীতে তিনি তখন সফল নায়িকা। তার অভিনয় যেমন প্রশংসিত হতে থাকে তেমনি রূপের জন্যও তিনি পান দারুণ জনপ্রিয়তা। গুরু দত্তের কাছ থেকে কিছুটা দূরে সরে যান তিনি। অবশ্য ক্যারিয়ারে ব্যস্ততা ও সাফল্যই এই দূরত্বের একমাত্র কারণ ছিল না। ওয়াহিদা তার ঘনিষ্ট বান্ধবী নন্দার কাছে আক্ষেপ করেছিলেন যে, তিনি সরে গিয়েছিলেন এই কারণে যেন গুরু দত্তর বিবাহিত জীবনে শান্তি ফিরে আসে।
কিন্তু সেটি ছিল তার ভুল ধারণা। তিনি বুঝতে পারেননি অভিমানী গুরুদত্ত আত্মহননের পথ বেছে নিতে পারেন। একাকীত্বের হতাশা সম্ভবত তার জীবনকে অসহনীয় করে তুলেছিল।
১৯৬৪ সালের ১০ অক্টোবর মদের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে পান করেন তিনি। মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ ও অ্যালকোহলেরবিষক্রিয়া ৩৯ বছর বয়সী এই শিল্পীর মৃত্যু ঘটায়। এর আগেও দুবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। মৃত্যুর আগে তিনি ফোন করেছিলেন আশা ভোঁসলের বাড়িতে। জানতে চেয়েছিলেন তার স্ত্রী সেখানে আছেন কি না। আশা ভোঁসলেই শেষ ব্যক্তি যিনি গুরু দত্তের সঙ্গে কথা বলেন। গুরু দত্তের ছেলে অবশ্য এই মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে মেনে নেননি। তার মতে এটি ছিল দুর্ঘটনা।
মৃত্যুর আগে গুরু দত্ত নতুন ছবি নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন। এবং ‘পিকনিক’ ও ‘লাভ অ্যান্ড গড’ ছবির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। ‘পিকনিক’ ছিল তার নিজের ছবি। যেটি শেষ করা হয়নি। ‘লাভ অ্যান্ড গড’এর পরিচালক ছিলেন কে. আসিফ। ছবিটি প্রায় দুদশক পর মুক্তি পায়। গুরু দত্তের পরিবর্তে সেটিতে অভিনয় করেন সঞ্জীব কুমার। গীতা দত্তের মৃত্যু হয় ১৯৭২ সালে।
ওয়াহিদা রেহমান বিয়ে করেন ১৯৭৪ সালে, গুরু দত্তের মৃত্যুর দশ বছর পর। গুরু দত্ত ও ওয়াহিদা রহমানের এই প্রেম বলিউডের সবচেয়ে করুণ প্রেম কাহিনীর মধ্যে অন্যতম।
বাংলাদেশ সময়: ১১:৪২:২২ ৩৮৮ বার পঠিত