বঙ্গনিউজ ডটকমঃ দুই বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনার মতো বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ খিজির খানের হত্যা নিয়েও অন্ধকারে আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
তবে খিজির খানের হত্যার ধরনের সঙ্গে গত বছরের আগস্টে ঢাকায় মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী, এর আগের বছর ইমাম মাহদীর প্রধান সেনাপতি দাবিদার লুৎফর রহমানসহ ছয়জন খুন এবং গত মাসে চট্টগ্রামে ল্যাংটা ফকির রহমতউল্লাসহ দুজনকে হত্যার অনেক মিল রয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের কর্মকর্তারা।
এসব হত্যার কোনোটারই কোনো কূলকিনারা করতে না পারলেও সবগুলোতেই তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সন্দেহ ধর্মীয় উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর দিকে।
এর মধ্যে গত সোমবার চট্টগ্রামে গ্রেপ্তার হওয়া জামাআতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) পাঁচ জঙ্গির একজন সুজন ওরফে বাবু প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে চট্টগ্রামে ল্যাংটা পীর হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন বলে চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত উপকমিশনার বাবুল আক্তার প্রথম আলোকে জানিয়েছেন।
এ তথ্য জানার পর সোমবার রাতে ঢাকার মধ্য বাড্ডায় খিজির খানকে হত্যার ঘটনায়ও জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রতি সন্দেহ জোরদার হয়েছে।
গত ৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের আকবর টিলা এলাকায় ‘ল্যাংটা ফকিরের মাজারে’ রহমতউল্লাহ ওরফে ল্যাংটা ফকির (৫৫) ও তাঁর খাদেম আবদুল কাদেরকে (৩০) দুর্বৃত্তরা জবাই করে হত্যা করে। এত দিন এই হত্যার কোনো সূত্র খুঁজে পায়নি পুলিশ।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) দেবদাস ভট্টাচার্য বলেন, আটক জেএমবি সদস্য সুজন ওরফে বাবু জিজ্ঞাসাবাদে ল্যাংটা ফকিরকে হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। তাঁর ভাষ্য, ‘শরিয়তবিরোধী কাজে লিপ্ত থাকায়’ তাঁরা ল্যাংটা ফকির ও খাদেমকে খুন করেছেন।
সুজনের তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে ঘটনাস্থলের পাশে একটি নর্দমা থেকে ল্যাংটা ফকিরকে হত্যায় ব্যবহৃত একটি দা এবং সুজনের ভাড়া বাসা থেকে রক্তমাখা টি-শার্ট উদ্ধার করেছে।
পুলিশি হেফাজতে থাকা সুজন গতকাল প্রথম আলোর প্রতিবেদককে বলেন, তিনি প্রথমে ঘুমে থাকা ল্যাংটা ফকিরকে খুন করেন। এ সময় তাঁর চিৎকারে খাদেম জেগে উঠলে তাঁকেও কুপিয়ে হত্যা করেন। তাঁর দাবি, ফারদিন নামে তাঁদের এক বড় ভাইয়ের নির্দেশে ল্যাংটা ফকিরকে খুন করেন তিনি। নিজেকে ট্রাকচালকের সহকারী বলে দাবি করে সুজন বলেন, তিনি ‘ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার’ লক্ষ্যে জেএমবিতে যোগ দিয়েছেন।
ল্যাংটা ফকিরের কায়দায় গত বছরের ২৭ আগস্ট রাতে ঢাকার পূর্ব রাজাবাজারের বাসায় ঢুকে বেসরকারি টিভি চ্যানেলের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উপস্থাপক নুরুল ইসলাম ফারুকীকে জবাই করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় শেরেবাংলা নগর থানায় হওয়া মামলাটি তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
ফারুকীর পরিবারের ধারণা, ধর্মীয় মতাদর্শের বিরোধী উগ্রপন্থীরা ফারুকীকে হত্যা করেছে। মামলার তদন্ত-তদারক কর্মকর্তা ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার আশিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা এখন পর্যন্ত ফারুকী হত্যা মামলার কোনো কূলকিনারা করতে পারেননি। তবে তাঁদেরও সন্দেহ, ধর্মীয় মতাদর্শগত বিরোধের জেরে এই খুন হয়ে থাকতে পারে।
এর আগে ২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর রাতে ঢাকার গোপীবাগের বাসায় দুর্বৃত্তরা ইমাম মাহদির প্রধান সেনাপতি দাবিদার লুৎফর রহমান ফারুক, তাঁর বড় ছেলে ও চার অনুসারীকে জবাই করে হত্যা করে। এ সময় তাঁর পরিবারের নারী সদস্যদের জিম্মি করে একটি কক্ষে আটকে রাখা হয়েছিল। প্রায় একই কায়দায় সোমবার রাতে খিজির খানের পরিবারকে জিম্মি করেছিল খুনিরা।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, লুৎফর হত্যায়ও তাঁদের সন্দেহ উগ্রপন্থীদের দিকে। এ ঘটনায় ইতিপূর্বে জেএমবির চার সদস্যকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল, কিন্তু কোনো তথ্য মেলেনি। জেএমবির ওই চার ভিন্ন ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
খিজির খান হত্যায় তিন সন্দেহ: এদিকে গতকাল পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) এস এম মোস্তাক আহমেদ খান সাংবাদিকদের বলেন, তিনটি সন্দেহকে সামনে রেখে তাঁরা খিজির খানের হত্যার তদন্ত করছেন। তা হলো পারিবারিক, সম্পত্তি নিয়ে ও ধর্মীয় মতাদর্শগত বিরোধ ছিল কি না।
খিজির খানকে হত্যার ঘটনায় তাঁর ছেলে আশরাফ আহমেদ বাদী হয়ে গতকাল রাত ১২টার দিকে বাড্ডা থানায় মামলা করেন। এতে অজ্ঞাতনামা ছয়-সাতজনকে আসামি করা হয়। গত রাত পর্যন্ত এ ঘটনায় কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে খিজির খানের লাশ গতকাল রাজধানীর আবদুল গণি রোডে বিদ্যুৎ ভবনের সামনে নেওয়া হয়। সেখানে বাদ জোহর তাঁর প্রথম জানাজা হয়। এরপর বাড্ডায় তাঁর বাসার কাছে বাদ আসর আরেক দফা জানাজা হয়। পরে লাশ দাফনের জন্য কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের ফিলিপনগরে তাঁর গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হয়।
প্রথম আলোর কুষ্টিয়া অফিস জানায়, আজ বুধবার সকাল সাড়ে নয়টায় স্থানীয় ফিলিপনগর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে খিজির খানের জানাজা হবে। এরপর বাড়ির পাশে নুরি খানকাহ শরিফে বাবা রহমতুল্লাহর কবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হবে বলে পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে।
বাবার মৃত্যুর পর নিজে পীর হন: খিজির খানের মুরিদ মাহবুবুর রহমান ও স্থানীয় লোকজন বলেন, খিজির খানের বাবা রহমতুল্লাহ পেশায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। ১৯৪২ সালে চট্টগ্রামের সৈয়দ হাবিবুল্লাহ পীরের মুরিদ হন তিনি। এরপর একই বছর ফিলিপনগর গ্রামে পদ্মা নদীর পারে নুরি খানকাহ শরিফ গড়ে তোলেন। ১৯৯০ সালের দিকে রহমতুল্লাহ মারা গেলে ছেলে খিজির খান পীর হিসেবে বাবার স্থলাভিষিক্ত হন। পরে খিজির খান ঢাকার বাড্ডায় নিজ বাড়ির দোতলায় খানকাহ শরিফ গড়ে তোলেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে এ রকম আরও বেশ কয়েকটি খানকাহ শরিফ রয়েছে। তাঁর মুরিদের সংখ্যাও অনেক।
এদিকে খিজির খানের হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি জানিয়েছে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদ ও বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন।
গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের সরকারদলীয় এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ। গ্রেফতারের চেষ্টা চালানো হলেও লিটনকে এলাকায় পাওয়া যায়নি বলে পুলিশ দাবি করেছে। অবশ্য সুন্দরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘আমরা এমপি লিটনকে গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছি। কিন্তু তাকে খুঁজে পাচ্ছি না।’ তিনি বলেন, সুন্দরগঞ্জের বামনডাঙ্গায় এমপির বাড়িতে পুলিশ গিয়েছিল। সেখানে তাকে পাওয়া যায়নি। এমপি লিটন ২ অক্টোবর তার নির্বাচনী এলাকায় শিশু শাহাদাত হোসেন সৌরভকে গুলি করেন। এতে শাহাদাত আহত হয়। তার পায়ে তিনটি গুলি করেন তিনি। এ ঘটনায় সুন্দরগঞ্জ থানায় এমপি লিটনকে একমাত্র আসামি করে একটি মামলা হয়েছে। ইতিমধ্যে এমপি লিটনের দুটি লাইসেন্সকৃত অস্ত্র জব্দ করে এর লাইসেন্স বাতিল করেছে পুলিশ। মামলা হলেও এমপি লিটনকে গ্রেফতার করেনি পুলিশ। ঘটনার পর পুলিশ তার বাড়িতেও ছিল। এমপি লিটনকে গ্রেফতার করতে বিভিন্ন মহল থেকে দাবি তোলা হচ্ছে। স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠনও তাকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে আসছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সম্ভবত এমপি লিটন এলাকায় নেই। তিনি ঢাকায় থাকতে পারেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, এমপির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমপি লিটনের এক ঘনিষ্ঠজন বলেন, ঘটনার পর দুই দিন লিটন এলাকায়ই ছিলেন। লোক দিয়ে থানায় অস্ত্রও পাঠিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, এমপি দেশেই আছেন। পালিয়ে আছেন, এটি ঠিক নয়। বলা যায়, সবকিছু থেকে নিজেকে তিনি একটু সরিয়ে রেখেছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে এমপি লিটনকে আর প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না। তার ঘনিষ্ঠজনদের বক্তব্য, ‘কিছুটা সরে’ আছেন এমপি। তবে তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, এমন অভিযোগ তারা স্বীকার করতে নারাজ। গতকাল এমপি লিটনকে এলাকায় দেখা যায়নি। তিনি কোথায় আছেন, সে ব্যাপারে কেউ কোনো তথ্য দিতে পারেনি। গাইবান্ধা শহরে ডিবি রোডে গতকাল কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন এমপি লিটনকে গ্রেফতারের দাবিতে মানববন্ধন করেছে। একই দাবিতে মুখে কালো কাপড় বেঁধে শহীদ মিনারে কর্মসূচি পালন করেছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট।
গ্রেফতার দাবিতে গণস্বাক্ষর-মানববন্ধন : সুন্দরগঞ্জে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের গুলিতে শিশু সৌরভ আহতের ঘটনায় সুন্দরগঞ্জের তিনটি কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি পদ বাতিল ও প্রধানমন্ত্রী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলায় সাধারণ মানুষ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। তবে লিটনের সংসদ সদস্য পদ বাতিল, অবিলম্বে গ্রেফতার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে গতকাল সুন্দরগঞ্জে গণস্বাক্ষর, জেলা শহরে অবস্থান ধর্মঘট ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। সুন্দরগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মাসুদুল ইসলাম চঞ্চল জানান, তিনটি কলেজের সভাপতির পদ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তাকে প্রত্যাহার করে সঠিক কাজ করেছে।একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী সংসদ সদস্য লিটনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলায় সাধারণ মানুষসহ আন্দোলনকারীদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। এমপি লিটনের পক্ষে সুন্দরগঞ্জে শোডাউন করার পরিকল্পনাও নিয়েছিল ক্যাডারবাহিনী, কিন্তু আজ তারা মাঠে নেই। নাগরিক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক বীরেন সরকার বলেন, আমরা লিটনের সংসদ সদস্য পদ বাতিল, গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করছি। প্রয়োজনে তা প্রধানমন্ত্রী বরাবর পাঠিয়ে দেওয়া হবে।এদিকে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট গাইবান্ধা জেলা শাখা শহরের শহীদ মিনারে মুখে কালো কাপড় বেঁধে অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচি পালন করে। এতে বক্তব্য রাখেন নারী মুক্তি কেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক রোকেয়া খাতুন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের নিলুফার ইয়াসমিন শিল্পী, শিক্ষক আফরোজা বেগম লিলি, মঞ্জুরুল আলম মিঠু প্রমুখ। আসাদুজ্জামান মার্কেট সংলগ্ন ডিবি রোডে মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। মানবাধিকার সংরক্ষণ পরিষদ জেলা শাখা, মানবাধিকার নাট্য পরিষদ, মানবাধিকার নারী সমাজ, মানবাধিকার আইনজীবী পরিষদ এ কর্মসূচির আয়োজন করে। এ সময় বক্তব্য রাখেন সিপিবি নেতা মিহির ঘোষ, জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মারুফ মনা, জাসদের সাংগঠনিক সম্পাদক জিয়াউল হক জনি প্রমুখ। বক্তারা বলেন, মাদকাসক্ত কোনো ব্যক্তির পক্ষে আইনপ্রণেতার দায়িত্ব পালন করা সমীচীন নয়। তার মতো মদ্যপ ও হঠকারী ব্যক্তি আওয়ামী লীগের মতো একটি দলের সংসদ সদস্যের দায়িত্ব পালন করলে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে।
প্রথম পাতা - See more at: http://www.bd-pratidin.com/first-page/2015/10/07/110369#sthash.t6jLeinq.dpuf
বাংলাদেশ সময়: ১০:৩২:২৬ ৩৬৯ বার পঠিত