বাঙালি সংস্কৃতি সমন্বয়ধর্মী সংস্কৃতি

Home Page » সাহিত্য » বাঙালি সংস্কৃতি সমন্বয়ধর্মী সংস্কৃতি
সোমবার, ৫ অক্টোবর ২০১৫



সালাহ্‌উদ্দীন আহমদ (১৯২২—১৯ অক্টোবর ২০১৪), প্রতিকৃতি: মাসুক হেলালবঙ্গনিউজ ডটকমঃ ২০১৪ সালে বাংলা একাডেমির ‘অমর একুশে স্মারক বক্তৃতা’ হিসেবে এই লেখাটি তৈরি করেছিলেন ইতিহাসবিদ সালাহ্উদ্দীন আহমদ। গত ২১ সেপ্টেম্বর ছিল প্রয়াত এ জাতীয় অধ্যাপকের জন্মদিন। সেই উপলক্ষে ছাপা হলো এই অগ্রন্থিত রচনা বাঙালি সংস্কৃতিকে সমন্বয়ধর্মী সংস্কৃতি বলা যায়। বহুবিধ এবং বিচিত্র উপাদানের সমন্বয়ের ফলে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সৃষ্টি হয়েছে। ঐতিহাসিক বঙ্গভূমি বা বাংলাদেশে (বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ ও স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ) এই অঞ্চলে সুপ্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন নরগোষ্ঠী এসে বসবাস করতে শুরু করেছে। এই সব নরগোষ্ঠী সঙ্গে নিয়ে এসেছে তাদের নিজস্ব বিচিত্র সাংস্কৃতিক উপাদান। এসব বহিরাগত উপাদান বা উপকরণের সঙ্গে দেশজ উপাদানের সংমিশ্রণ ও সমন্বয় হয়েছে; এবং এর ফলেই বাংলার সাংস্কৃতিক রূপান্তর ঘটেছে যুগে যুগে।
বাংলাদেশের মানুষের জীবনধারা ও সংস্কৃতির মধ্যে এমন কতগুলো দিক আছে, যেগুলো আমাদের স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বাঙালি চিরদিন ভাবপ্রবণ জাতি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘প্রাণের নামে মানবতার নামে দাবি করলে এখানে সাড়া মিলবে’; এবং বাঙালির ধর্ম সম্বন্ধেও একই কথা বলা যায়। বাংলার মানুষের মনকে ধর্মের—তা যেকোনো ধর্ম হোক না কেন—তার বাহ্যিক আচার-বিচারের চেয়ে ধর্মের অন্তর্নিহিত মর্মবাণী বেশি আকৃষ্ট করেছে। তাই এ দেশে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতা কখনো জনমনে বিস্তার করতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন, ‘মানবপন্থী বাংলাদেশ প্রাচীনকালেও ভারতের শাস্ত্রপন্থী সমাজনেতাদের কাছে নিন্দনীয় ছিল। তীর্থযাত্রা ছাড়া এখানে এলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো।’ তার মানে, বাংলাদেশ চিরদিনই শাস্ত্রগত সংস্কারমুক্ত। বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি মত এ দেশে বা তার আশপাশে চিরদিন প্রবল ছিল। তখন মগধও বাংলার সঙ্গেই ছিল একঘরে অর্থাৎ স্বাধীন হয়ে।
বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, মৌলবাদী রক্ষণশীল মৌলভি-মোল্লাদের প্রচারণার চেয়ে সুফি-সাধক, পীর-দরবেশ, আউল-বাউলদের অবদান এ দেশে ইসলাম প্রচারে অধিক কার্যকর হয়েছে। এসব মরমি সাধকদের অনেকে তাঁদের ব্যক্তিগত চারিত্রিক গুণাবলির জন্য সব শ্রেণির মানুষের কাছে শ্রদ্ধাভাজন হয়েছিলেন। ধর্মের ক্ষেত্রে তাঁরা যে ঐতিহ্যের সূত্রপাত করেছিলেন, তা ছিল আধ্যাত্মিক মানবতাবাদের ঐতিহ্য, পরমতসহিষ্ণুতার ঐতিহ্য, যা বাংলার মন ও মানসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে যে ধারাটি প্রাধান্য পেয়ে এসেছে, সেটি সংঘাত বা বিরোধের ধারা নয়—বিভিন্ন মতবাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সমন্বয়ের ধারা। বস্তুত আমাদের বাঙালিদের জীবন ও সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, আবার রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—বৈচিত্র্যের মধ্যে সুরসংগতি বা ‘হারমনি’। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের আগে কেবল বাংলাদেশ নয়, সমগ্র ভারত উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক বিরোধের তেমন নজির দেখা যায় না। সাম্প্রদায়িক বিরোধ বা ধর্ম নিয়ে হিংসাত্মক দাঙ্গা-হাঙ্গামা নানাবিধ ঐতিহাসিক কারণে ব্রিটিশ আমলের সৃষ্টি। বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা যেন সেই আবহমান ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলাম।
আঠারো ও উনিশ শতকে বাংলায় আউল-বাউল ও চারণকবির আবির্ভাব দেখা যায়। তাঁদের গানে ছিল মানবতার স্ফুরণ। আলোকচিত্রটি সম্প্রতি মুন্সিগঞ্জের পদ্মহেম ধাম–এর লালন শাহ্ বটতলায় আয়োজিত বাউল গান অনুষ্ঠানের। ছবি: কবির হোসেনআমাদের এই সমন্বয়ধর্মী ধর্মীয় ঐতিহ্য এবং মানবতাবাদী সংস্কৃতির একজন শ্রেষ্ঠ ধারক ছিলেন রাজা রামমোহন রায় (১৭৭৪-১৮৩৩)। সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি ভাষায় সুপণ্ডিত রামমোহন হিন্দু, বৌদ্ধ ও ইসলাম ধর্মের শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্যকে আত্মভূত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অপেক্ষাকৃত তরুণ বয়সেই তিনি হিন্দু, বৌদ্ধ ও ইসলামি শাস্ত্রীয় বিষয় সম্বন্ধে তুলনামূলক চর্চা করতে শুরু করেন এবং বিশেষ করে ফারসি সুফি সাধক কবি হাফিজের অনবদ্য রচনাবলির সঙ্গে পরিচিত হন। আরবি ভাষার মাধ্যমে তিনি প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিদ্যা সম্বন্ধেও জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। এর ফলে সব ঐতিহ্যিক ধর্মকে বৈপ্লবিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিচার করার মনোভাব তাঁর মধ্যে জাগ্রত হয়। ১৮০৩-১৮০৪ খ্রিষ্টাব্দে মুর্শিদাবাদ থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম পুস্তিকা তুহফাত্ উল্ মুওয়াহহীদ্বীন্ (একেশ্বরবাদীদের প্রতি উপহার) মূল পুস্তিকাটি ফারসি ভাষায় রচিত হলেও এর শিরোনাম ও ভূমিকা আরবি ভাষায় লিখিত ছিল।
বস্তুত তুহফাত্ প্রকাশিত হওয়ার কয়েক বছর আগেই রামমোহন হিন্দুদের প্রচলিত পৌত্তলিক বা প্রতিমা পূজা পরিহার করেছিলেন এবং হিন্দুদের চিরাচরিত কুসংস্কার ও আচার অনুষ্ঠান বিশেষ করে সতীদাহ প্রথার তীব্র সমালোচনা করতেন।
পরবর্তীকালে রামমোহন ইংরেজি, ফারসি, গ্রিক ও হিব্রু ভাষা শিখেছিলেন এবং তার ফলে তিনি যে কেবল ইহুদি ও খ্রিষ্টধর্ম সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন তা নয়, সমকালীন, উনিশ শতকের ইউরোপের উদার ও যুক্তিবাদী চিন্তাধারার সঙ্গেও তাঁর পরিচয় ঘটেছিল। ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে রামমোহন ছিলেন উপযোগবাদী (Utilitarian)। ১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি একটি নতুন ধর্ম সংস্থা ব্রাহ্মসভা (পরবর্তীকালে ব্রাহ্ম সমাজ) স্থাপন করেন। রামমোহনের বিশ্বাস ছিল, এটি কালক্রমে একটি সর্বজনীন বা বিশ্বজনীন ধর্মে পরিণত হতে পারে।
রামমোহন মনে করতেন যেহেতু প্রতিটি ধর্মের লক্ষ্য অভিন্ন অর্থাৎ মানবজাতির নৈতিক উন্নতি সাধন, সুতরাং পরিবর্তিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, যুগের প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিটি ধর্মকে পুনর্ব্যাখ্যা ও পুনর্মূল্যায়ন করা অপরিহার্য। তিনি বিশ্বাস করতেন, তাঁর বা যেকোনো লোকের নিজের ধর্ম পরিবর্তন করার কোনো প্রয়োজন নেই। সব ধরনের অন্ধবিশ্বাস, গোঁড়ামি ও কুসংস্কার বর্জন করে প্রতিটি ধর্মের নৈতিক উপদেশগুলো প্রত্যেক মানুষের গ্রহণ করা উচিত। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে ধর্ম সম্পর্কে রামমোহনের ব্যতিক্রমধর্মী ও বৈপ্লবিক মতামত তাঁর সময়কালে খুব বেশি লোককে আকৃষ্ট করতে পারেনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও আধুনিক হিন্দু সমাজচিন্তায় এর গভীর প্রভাব লক্ষ করা যায়।
বস্তুত রামমোহন রায় এ উপমহাদেশের ভাবজগতের ঐতিহ্যে এক নতুন ধারার প্রবর্তন করেছিলেন। সে ধারাটি ছিল ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে যুক্তির ব্যবহার।
উনিশ শতকের প্রথম দিকে অর্থাৎ রামমোহনের সময়কালে এই উপমহাদেশের মুসলিম ভাবজগতেও ঠিক এই ধরনের চিন্তার পরিচয় পাওয়া যায়। ইসলামি ধর্মবিশ্বাসকে অনমনীয় বলে মনে হলেও মুসলিম ভাবজগতে যুক্তিবাদের একটা স্থান সব সময় ছিল। খুব সম্ভব এর প্রথম নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায় খ্রিষ্টীয় নয় শতকের আরব দেশে মুতাজিলা মতবাদের মধ্যে। মুতাজিলা দার্শনিকেরা প্রাচীন গ্রিক যুক্তিবাদী দর্শন, বিশেষ করে অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিদ্যা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ধর্মবিশ্বাসকে কীভাবে যুক্তির সঙ্গে সমন্বিত করা যায়, এই চিরন্তন প্রশ্নটির উত্তর অনুসন্ধান ছিল তাঁদের লক্ষ্য। কিন্তু সনাতন ইসলামের গোঁড়া সমর্থকদের তীব্র বিরোধিতার মুখে চিন্তার ক্ষেত্রে এই দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা সফল হতে পারেনি। তা সত্ত্বেও এই ধারা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি, মুসলিম মনোজাগতিক ঐতিহ্যে এর একটা বিশিষ্ট স্থান সব সময় রয়ে গেছে। উনিশ শতকের উদারনৈতিক পরিবেশে এই যুক্তিবাদী ধারাটি যেন পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে যখন পাশ্চাত্য সভ্যতার অভিঘাতের ফলে এ দেশের চিন্তার ক্ষেত্রে এক উদার যুক্তিবাদী ধারার উন্মেষ ঘটেছিল, সেই যুগে আমরা এমন একজন দুঃসাহসিক যুক্তিবাদী মুসলিম বুদ্ধিজীবীর কথা জানতে পেরেছি, যাঁর নাম আবদুল রহীম। আবদুল রহীমের জন্ম হয় ১৭৮৫ সালে উত্তর ভারতের গোরাখপুর শহরে এক তাঁতি পরিবারে। তিনি লক্ষ্ণৌ ও দিল্লির প্রখ্যাত মাদ্রাসায় শিক্ষালাভ করে আরবি এবং ফারসি ভাষায় অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী হন। আবদুল রহীম তাঁর প্রথম জীবনে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন, শরিয়তের বিধিবিধান অনুযায়ী জীবনযাত্রা পরিচালনা করতেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ধর্ম সম্পর্কে আরবি ও ফারসি ভাষায় রচিত বিভিন্ন বইপুস্তক পাঠ করে এবং বিভিন্ন ধর্মীয় দর্শনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ফলে তাঁর মানসিকতায় এক বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়। আবদুল রহীম সব ধর্মের গোঁড়ামি পরিহার করে একজন মুক্তমনা যুক্তিবাদী মানুষে পরিণত হন। তিনি বিভিন্ন ধর্ম সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করার ফলে মুতাজিলা দার্শনিকদের যুক্তিবাদী চিন্তার প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হন এবং শেষ পর্যন্ত প্রচলিত ধর্মে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। এই কারণে তিনি ‘দাহরি’ অর্থাৎ ‘নাস্তিক’ হিসেবে পরিচিত হন। আবদুল রহীম প্রাকৃতিক আইনে বিশ্বাস করতেন। তাঁর মতে, সূর্যই হলো সব সৃষ্টির উৎস। ১৮১০ সাল নাগাদ আবদুল রহীম কলকাতায় চলে এসে এখানে স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করেন এবং এখানে ১৮৫৩ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। কলকাতায় আসার পর তিনি ইংরেজি ভাষা ভালো করে শিখেছিলেন এবং এই ভাষার মাধ্যমে সমকালীন ইউরোপীয় সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হন; যার ফলে তাঁর নিজস্ব যুক্তিবাদী চিন্তা আরও দৃঢ় হয়। কলকাতার মুক্ত পরিবেশে আবদুল রহীমকে কেন্দ্র করে এক বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। এই গোষ্ঠীর সদস্যরা আবদুল রহীমের মতো ‘নাস্তিক’ না হলেও তাঁরা উদার ও সংস্কারপন্থী ছিলেন এবং ধর্মবিশ্বাসকে যতটা সম্ভব যুক্তির আলোকে গ্রহণ করার চেষ্টা করতেন। আবদুল রহীমের অনুসারীদের মধ্যে বোধ হয় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদ মাওলানা ওবায়দুল্লাহ আল-ওবায়দী (১৮৩২-১৮৮৫)। তিনি ঢাকা মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে দীর্ঘ ১০ বছর কর্মরত ছিলেন। ওবায়দী তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন, তিনি দর্শন ও বিজ্ঞান সম্পর্কে প্রথম পাঠ গ্রহণ করেন তাঁর মহান শিক্ষক আবদুল রহীমের কাছ থেকে। ওবায়দুল্লাহ ছিলেন বহুভাষাবিদ, যুক্তিবাদী, উদারপন্থী শিক্ষাবিদ ও সংস্কারক। তাঁর উদ্যোগে ১৮৭৩ সালে ‘ঢাকা সমাজ সম্মিলনী’ প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি ঢাকা মুসলিম সুহৃদ সম্মিলন, কলকাতা মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি ও বেঙ্গল সোশ্যাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। তাঁর বন্ধু ব্রাহ্মসমাজ নেতা রাজনারায়ণ বসুর অনুরোধে তিনি রামমোহন রায়ের সুবিখ্যাত বই তুহফাত-উল্ মুযাহ্হিদ্বীন ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন। মনে হয় মাওলানা ওবায়দীর অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও সংস্কারবাদী মনোভাব তাঁর ছাত্রদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে নোয়াখালীর মৌলভি আবদুল আজিজের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। ওবায়দীর মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে তিনি একটা দীর্ঘ কবিতা লেখেন।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আধুনিকতার প্রবর্তক হিসেবে আমরা উত্তর ভারতের স্যার সৈয়দ আহমদ খান (১৮১৭-১৮৯৮) ও বাংলার সৈয়দ আমির আলীকে (১৮৪৯-১৯২৮) দেখতে পাই। তাঁরা উভয়ই সমকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকে এবং যুগের প্রয়োজনে ইসলামকে পুনর্মূল্যায়ন ও পুনর্ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। আরেকজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন দেলওয়ার হোসেন আহমদ (১৮৪০-১৯১৫), তাঁকে আমরা প্রকৃত অর্থে একজন রেনেসাঁ-ব্যক্তিত্ব বলে অভিহিত করতে পারি। তাঁর আদি নিবাস ছিল হুগলি জেলায়। সুতরাং তাঁকে আমরা খাঁটি বাঙালি হিসেবে ধরে নিতে পারি। দেলওয়ার হোসেন ১৮৬১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে বিএ পাস করেন। খুব সম্ভব তিনিই উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম গ্র্যাজুয়েট।
দেলওয়ার হোসেনের চিন্তাধারা ছিল তাঁর সমসাময়িক অন্য মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রগামী। ১৮৮৯ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় দুই খণ্ডে রচিত তাঁর ইংরেজি বই এসে অন মোহামেডান সোশ্যাল রিফর্ম। এ ছাড়া তিনি দ্য ইংলিশম্যান, দ্য মুসলিম ক্রনিকেল এবং দ্য মুসলমান—এসব সংবাদপত্রে ছদ্মনামে ও স্বনামে মুসলমান সমাজের বিভিন্ন সমস্যার ওপর প্রচুর প্রবন্ধ লিখেছিলেন। দেলওয়ার হোসেনের চিন্তায় পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী দর্শনের গভীর প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। দেলওয়ার হোসেনই খুব সম্ভব আধুনিক যুগের প্রথম মুসলমান বুদ্ধিজীবী, যিনি বলিষ্ঠ ও পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করেছিলেন যে মুসলমানদের জাগতিক আইনকে ইসলামি ধর্মীয় বিধান থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করাই হলো মুসলমান সমাজের অগ্রগতির পূর্বশর্ত। তিনি বিশ্বাস করতেন, পরিবর্তনশীল সমাজের চাহিদা অপরিবর্তনশীল ধর্মীয় আইন বা বিধান দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়।
কিন্তু দেলওয়ার হোসেনের অগ্রগামী চিন্তাধারা সমকালীন মুসলিম সমাজে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। কারণ, সেকালের মুসলমান সমাজ ছিল ঘোর রক্ষণশীল ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন। তা ছাড়া যেহেতু দেলওয়ার হোসেনের সব রচনা ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল, তাই তাঁর আধুনিক প্রগতিশীল মতামত সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। তা সত্ত্বেও বলা যায় যে দেলওয়ার হোসেনের চিন্তাধারার মধ্যে এমন কতগুলো বৈপ্লবিক উপাদান নিহিত ছিল, যেগুলো পরবর্তী সময়ে বুদ্ধিজীবীদের মানসভুবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।
আবদুল রহীম, সৈয়দ আমির আলি ও দেলওয়ার হোসেন আহমদ—তাঁদের অগ্রগামী ও আধুনিকতামুখী চিন্তার সঙ্গে সাযুজ্যের সন্ধান পাই বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে আমাদের এই ঢাকার ‘শিখা’ গোষ্ঠীর চিন্তানায়কদের মধ্যে। ওই সময় আবুল হোসেন (১৮৯৬-১৯৩৮), কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭৬), মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১), আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৮৩) প্রমুখ কতিপয় বাঙালি মুসলিম বুদ্ধিজীবীর উদ্যোগে ঢাকা শহরে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। তাঁদের মূলমন্ত্র ছিল ‘বুদ্ধির মুক্তি’। বুদ্ধির ও যুক্তির আলোকে এবং সমকালীন যুগের প্রয়োজনের তাগিদে ইসলামের পুনর্মূল্যায়ন ও পুনর্ব্যাখ্যা করাই ছিল এর প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু তখনকার ঢাকার মুসলমান সমাজের ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর প্রবল প্রতিরোধের মুখে এই আন্দোলন তেমন অগ্রসর হতে পারেনি। তবে এর রেশ একেবারে মিলিয়ে যায়নি। পরবর্তীকালে বেশ কিছুসংখ্যক বুদ্ধিজীবী এটিকে লালন করেছেন এবং আমাদের সময়কালে বাঙালি মুসলিম রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণে এঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আমাদের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এবং পরিশেষে একাত্তর সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ এই পটভূমিতেই সংঘটিত হয়েছিল।
বাংলার সমন্বয়ধর্মী ও মানবতাবাদী ঐতিহ্য সম্পর্কে একটি কথা বলে এই প্রবন্ধটি শেষ করতে চাই। আঠারো ও উনিশ শতকে বাংলার গ্রাম অঞ্চলে কিছুসংখ্যক আউল-বাউল ও চারণকবির আবির্ভাব দেখা যায়। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মরমি কবি ফকির লালন শাহ্। লালনের গান আজও বাঙালির মনকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। লালনের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে একটা বিতর্ক রয়ে গেছে। হিন্দুরা লালনকে হিন্দুসাধক বলে মনে করতেন; অন্যদিকে মুসলমানদের কাছে তিনি ছিলেন সুফি ফকির। লালন নিজেই জানতেন না তাঁর ধর্মপরিচয় কী? এই সংকটকে লালন এক সুন্দর গানের মধ্যে প্রকাশ করেছেন—
‘সব লোক কয় লালন কী জাত সংসারে।
লালন বলে জাতের কী রূপ দেখলাম না এই নজরে।
সুন্নত দিলে হয় মুসলমান নারীর তবে কী হয় বিধান
বামন চিনে পৈতে প্রমাণ বামনি চিনি কিসে রে
কেউ মালা কেউ তসবি গলে তাই তো রে জাত
ভিন্ন বলে।
আসা কিংবা যাওয়ার কালে জেতের চিহ্ন বয় কি রে।
জগৎ বেড়ে জাতের কথা লোকে গল্প করে যথা তথা
লালন বলে জাতের ফাতনা ডুবিয়েছি সাধ বাজারে।’
সম্প্রতি ইসলামের নামে কয়েকটি ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর হিংসাত্মক কার্যকলাপের ফলে আমাদের মানবতাবাদী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তথা গোটা মানবসভ্যতা এক বিরাট হুমকির সম্মুখীন। দলমত-নির্বিশেষে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এই হুমকি মোকাবিলা করতে হবে। এই মুহূর্তে বিশেষ করে স্মরণ করছি বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতায় কবির বিশ্ব মানবতাবাদী দর্শন সুন্দরভাবে প্রতিবিম্বিত হয়েছে।
‘গাহি সাম্যের গান—
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ, মুসলিম-ক্রিশ্চান।
গাহি সাম্যের গান!
কে তুমি? পারসি? জৈন? ইহুদি? সাঁওতাল, ভীল? গারো?
কনফুসিয়াস? চার্বাক-চেলা? বলে যাও বলো আরও!
বন্ধু, যা-খুশি হও,
পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা-খুশি পুঁথি ও কেতাব বও,
কোরআন-পুরাণ বেদ-বেদান্ত- বাইবেল-ত্রিপিটক—
জেন্দাবেস্তা গ্রন্থসাহেব পড়ে যাও, যত শখ—
কিন্তু, কেন এ পণ্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?
দোকানে কেন এ দর-কষাকষি? পথে ফুটে তাজা ফুল!
তোমারে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,
সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা, খুলে দেখ নিজ প্রাণ!
তোমারে রয়েছে সকল ধর্ম, সকল যুগাবতার,
তোমার হৃদয় বিশ্ব-দেউল সকল দেবতার।
কেন খুঁজে ফের দেবতা ঠাকুর মৃত পুঁথি-কঙ্কালে?
হাসিছেন তিনি অমৃত-হিয়ার নিভৃত অন্তরালে।’

বাংলাদেশ সময়: ১৩:৪৯:১৪   ৫৯২ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

সাহিত্য’র আরও খবর


সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন: স্বপন চক্রবর্তী
ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা “আমি তো গাঁয়ের মেয়ে ”
৫০ বছরের গৌরব নিয়ে জাবির বাংলা বিভাগ বিশাল ‘সুবর্ণ জয়ন্তী’ উৎসব আয়োজন করেছে
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা- ‘তোমার খোঁজে ‘
অতুলপ্রসাদ সেন: ৩য় (শেষ ) পর্ব-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন;পর্ব ২-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন-স্বপন চক্রবর্তী
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা ” যাবে দাদু ভাই ?”
বাদল দিনে- হাসান মিয়া
ইমাম শিকদারের কবিতা ‘ছোট্ট শিশু’

আর্কাইভ