বঙ্গনিউজ ডটকমঃ রান্নাঘরের জানালায় উঁকি দিচ্ছিল বিড়ালটা। অমনি গৃহকর্মীর ছোড়া ভাতের গরম মাড় পড়ল ওর গায়ে। এমন ঘটনা তো আমাদের আশপাশে প্রায়ই ঘটে। কিছুদিন আগে এমনই এক ঘটনা ঘটে রাজধানীর খিলগাঁওয়ের তিলপাপাড়া এলাকায়। ভাতের গরম মাড়ে গোটা শরীর ঝলসানো একটি বিড়ালকে পড়ে থাকতে দেখেন আফজাল খান। বিড়ালটিকে উদ্ধার করে পশু হাসপাতালে নেন তিনি। একটু সেরে উঠলে বিড়ালটির ঠাঁই হয় আফজালের নিজের ঘরে। আফজাল আদর করে ওর নাম রাখেন ফুরমতি। তার গলায় বেঁধে দেন একটা ছোট্ট লকেট। ওকে দেখলে যেতে হবে আফজালের চিলেকোঠায়।
চিলেকোঠার দরজা খুলতেই অভ্যর্থনা জানায় একটি কুকুর। ভেতরে ঢুকতেই হাত-পা শুঁকতে শুরু করে। আফজালের ছোট বোন তাইয়েবা নাসরীন বলল, ‘ওর নাম চওমিন। আপনার সঙ্গে খাতির করতে চাইছে।’ খানিকক্ষণ পরে দুই পায়ে দাঁড়িয়ে যেন করমর্দন করতেই চাইল কুকুরটা।
ঘরের ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল বন্ধ ল্যাপটপের ওপর বসে আছে ফুরমতি, গলায় একটা ব্যান্ড। তারপর বিস্মিত হওয়ার পালা। সারা ঘরের এখানে-ওখানে ছড়িয়ে আছে বিড়াল। আফজালের বিছানা, আলমারির ছাদ, ব্যায়ামের যন্ত্রপাতি—সব ওদের দখলে। খাটের নিচ থেকে উঁকি দিচ্ছিল একচোখা একটা কুকুর। তাইয়েবা জানায়, এই কুকুরটির নাম চেরি। গত ঈদুল ফিতরের আগের রাতে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পড়ে ছিল রাজারবাগের রাস্তায়। বের হয়ে গিয়েছিল নাড়িভুঁড়ি। কেন্দ্রীয় পশু হাসপাতালে কয়েক দফা অস্ত্রোপচার হয় ওর। চেরি এখন খানিকটা সুস্থ। আফজালদের সঙ্গেই থাকে। ওর মুখটা দুই হাতে তুলে ধরে নষ্ট চোখটা দেখালেন আফজাল। তাঁদের সঙ্গে এখন থাকে আটটি বিড়াল আর চওমিন ও চেরি নামের এই দুই কুকুর। দুই ভাইবোন মিলে ওদের দেখাশোনা করে।
এই সব কটি প্রাণী কোনো না কোনো দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিল। বিভিন্ন জায়গা থেকে এদের উদ্ধার করা হয়েছে।
আহত কুকুর-বিড়ালদের নিয়ে কাজ করেন আফজাল খান। যেন কুকুর-বিড়ালের ‘রবিন হুড’। এমনও শোনা গেল, কুকুর-বিড়ালের ওপর নির্যাতনকারীদের সঙ্গে মারপিটেও জড়িয়েছেন এই তরুণ। চলার পথে কুকুর-বিড়ালদের আহত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখলে সেগুলোকে হাসপাতালে নিয়ে যান আফজাল। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে গেলে আশ্রয় দেন নিজের ঘরে। চাইলে পোষার জন্য কেউ কেউ নিয়েও যান তাঁর কাছ থেকে।
ফেসবুকে ‘র্যা ন্ডম ১০’ নামে এ রকম একটি পেজ আছে। পোষার জন্য কুকুর-বিড়াল দেওয়া-নেওয়া করা হয় এই পেজে। এমনকি মালিকানাহীন প্রাণীর দেখাশোনার খরচ চেয়েও এখানে আবেদন জানান কেউ কেউ। ঢাকা থেকে চালানো হয়—এ রকম আরও বেশ কয়েকটি পেজ আছে ফেসবুকে।
সংগ্রহে থাকা এই প্রাণীদের চিকিৎসা ও দেখাশোনার খরচ আফজাল নিজেই বহন করেন। তাঁর চাওয়া—মানুষ যেন এদের প্রতি একটু সদয় হয়। আফজাল বলেন, ‘এদেরকে কোনো ব্র্যান্ডশপ থেকে পোশাক বা খাবার কিনে দিতে হবে না। নিজের খাবার থেকে সামান্য উচ্ছিষ্ট দিলেই ওরা আপনাকে ভালোবাসবে, আপনার যত্ন নেবে। বাবা বাড়ি ফিরলে সন্তানেরা যেমন আনন্দিত হয়, আমি ফিরলে আমার এই বন্ধুরা তেমনটাই খুশি হয়। এসে গায়ের ওপর লাফিয়ে পড়ে—এতটুকুই আমার আনন্দ।’
ওদের খাবারের জন্য খরচাও কিন্তু কম নয়। প্রতি মাসে এদের খাবার বাবদ আফজালকে কিনতে হয় প্রায় ৬০ কেজি মুরগি আর ১০ কেজি গরুর মাংস।
ছোটবেলা থেকে তাঁর শখ ছিল মানুষের জন্য কিছু করার। নানা কারণে তা হয়ে ওঠেনি। অবশেষে নিজের অজান্তেই এই অবলা প্রাণীগুলোর বন্ধুতে পরিণত হয়েছেন এই তরুণ। আফজালের ঘরের রেফ্রিজারেটরে বেশ কিছু ওষুধ দেখা যায়। তিনি জানান, ওষুধগুলো চেরির জন্য। দুর্ঘটনায় নষ্ট হওয়া চোখের ক্ষত সারেনি এখনো। কুকুরটিকে নেওয়া হয়েছিল কেন্দ্রীয় পশু হাসপাতালে। সেখানকার চিকিৎসকেরা বেশির ভাগই গবাদিপশু–পাখির চিকিৎসক। গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি বাদে কুকুর-বিড়ালকে চিকিৎসা দেওয়ার প্রয়োজনীয় উপকরণ ও ওষুধ সেখানে নেই বললেই চলে।
আফজাল আক্ষেপ করে বলেন, ‘ঢাকার পথে পথে অনেক লেজ কাটা কুকুর দেখা যায়। মালিকবিহীন এই কুকুরগুলোর লেজ কেটে সিটি করপোরেশনে জমা দিলে ৫০ টাকা পাওয়া যায়। এতে সিটি করপোরেশন কুকুরটাকে সহজে চিহ্নিত করতে ও মেরে ফেলতে পারে। ভাসমান মাদকাসক্তরা জীবিত কুকুরের লেজ কেটে ফেলে। জীবন্ত একটি প্রাণীর লেজ কেটে ফেলা যে কতটা অমানবিক, তা বলে বোঝানো যাবে না।’
আফজাল শহরের মালিকবিহীন কুকুর-বিড়ালগুলোকে একটা অভয়ারণ্যে ছেড়ে দিয়ে আসতে চান। সেখানে তারা নিজেদের মতো বাঁচুক। আর পক্ষাঘাতগ্রস্ত প্রাণীগুলোর জন্য তিনি একটি আশ্রয়কেন্দ্র করতে চান। সেখানে ওদের দেখাশোনার জন্য একজন চিকিৎসক রাখার পরিকল্পনা আছে তাঁর।
শখের অভিনেতা আফজাল তাঁর বাবার ব্যবসা দেখাশোনার পাশাপাশি স্বল্প পরিসরে প্রাণীদের নিয়ে কাজ করছেন। আফজালের চাওয়া—প্রাণীদের ব্যাপারে মানুষ একটু সচেতন হোক।
‘এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মনিরুল হাসান খান আফজালের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানান। তিনি বলেন, ‘দেশে প্রাণী অধিকার নিয়ে যেহেতু তেমন কোনো কাজ হচ্ছে না, তাই ব্যক্তিপর্যায়ে তাঁর এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। আমাদের আশপাশের কুকুর-বিড়ালের মতো যেসব প্রাণী আহত হয়, তাদের জন্য সরকারিভাবে কোনো চিকিৎসা-সুবিধা নেই। আশা করা যায়, এই তরুণদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে অন্যরাও এগিয়ে আসবেন। একপর্যায়ে সরকারিভাবেও এই প্রাণীদের জন্য চিকিৎসা-সুবিধা তৈরি হবে।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের আওতায় সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে একটি ‘ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টার’। তবে সেখানে শুধু আহত বন্য প্রাণীদের চিকিৎসা করিয়ে বনে ছেড়ে দেওয়া হয়। বন বিভাগ এই ধারণাকে কাজে লাগিয়ে বন্য প্রাণীদের জন্য শ্রীমঙ্গল ও খুলনায় এ রকম রেসকিউ সেন্টার খুলেছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩:৪৩:৫৫ ৫৬২ বার পঠিত