বঙ্গনিউজ ডটকমঃ মানুষ দূরে বসে কত সহজেই আকাশে ভাসমান ড্রোন নিয়ন্ত্রণ করে। ভাবতে সত্যিই অবাক লাগে। অবাক হওয়ার মতো তেমনি নতুন এক খবর হলো- জার্মান বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যতে বিশাল মালবাহী জাহাজও সেভাবে কন্ট্রোলরুমে বসে চালাতে চান। এক্ষেত্রে তাঁরা বিশেষ সফটওয়্যার ব্যবহার করবেন। তাঁদের এ স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিলে ভবিষ্যতের জাহাজ মহাসাগর পাড়ি দেবে একেবারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে।
শুধু বন্দরের মধ্যে এলে কয়েকজন নাবিক সেটি চালনা করবেন। তারপর সমুদ্রে গিয়ে পড়লে ন্যাভিগেশন ও লোকালাইজেশন প্রযুক্তির নেটওয়ার্ক জাহাজটিকে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাবে।
প্রায় দুই বছর ধরে জার্মানির ফ্রাউনহোফার সামুদ্রিক গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা নাবিক ছাড়াই মালবাহী জাহাজ চালানোর সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করছেন বলে জানা গেছে। মনে প্রশ্ন জাগতে পারে- এমন অ্যাটোম্যাটিক জাহাজের সুবিধা কি?
এ প্রসঙ্গে ফ্রাউনহোফার সিএমএল-এর কার্লোস ইয়ান বলেন, ‘প্রথমত, কর্মীর প্রয়োজন না থাকায় অর্থ বাঁচবে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া যাবে। দ্বিতীয় সুবিধাটি হলো, সেন্সর প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে সমুদ্রে জাহাজকে আরও নিরাপদ করে তোলা যাবে। তাছাড়া ধীর গতিতে চলা স্বয়ংক্রিয় জাহাজ পরিবেশ দূষণ কমাতেও সাহায্য করবে। কার্বন নির্গমন ও জ্বালানির ব্যবহার কমবে। তবে ভুললে চলবে না, মানুষের ভুলের কারণেই সবচেয়ে বেশি জাহাজ দুর্ঘটনা ঘটে।’
সম্প্রতি গবেষকরা তাঁদের সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব সিমুলেটরে পরীক্ষা করে দেখছেন। পরীক্ষায় সিমুলেশনের মাধ্যমে দ্রুত বোঝা গেছে যে, নাবিক ছাড়া বন্দরের মধ্যে জাহাজ চলতে পারবে না। কারণ বন্দরে জাহাজ চালানো অত্যন্ত জটিল কাজ।
এমন বাস্তবতায় ভবিষ্যতেও বন্দর ছেড়ে যাওয়ার এবং সেখানে প্রবেশের সময় নাবিকদেরকেই জাহাজ চালাতে হবে। তারপর মালবাহী জাহাজ সমুদ্রে পৌঁছালে নাবিকরা ছোট নৌকা বা হেলিকপ্টারে চড়ে জাহাজ ছেড়ে চলে যাবে। তবে গন্তব্যে ঠিক উল্টোটা ঘটবে। বন্দরে প্রবেশের আগে যথাসময়ে নাবিকরা জাহাজে পৌঁছবেন। তারপর নিরাপদে জাহাজটি নোঙর করবে। সমুদ্রে চলার সময়ে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জাহাজের দায়িত্ব নেবে। সবচেয়ে বড় আশা হলো, জাহাজ চলাচল আরও নিরাপদ হবে, কারণ সেন্সর মানুষের তুলনায় অনেক বেশি দক্ষতার সঙ্গে চারদিকে নজর রাখবে।
এ প্রসঙ্গে ফ্রাউনহোফার ইনস্টিটিউটের হান্স-ক্রিস্টফ বুয়রমাইস্টার বলেন, ‘কোনো বাধা শনাক্ত করতে আগের মতোই আমরা রাডার ও অটোম্যাটিক আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ব্যবহার করছি। সেইসঙ্গে জাহাজে সাধারণ ও ইনফ্রারেড ক্যামেরাও থাকছে। সব সিস্টেম একসঙ্গে কাজ করতে পারে। এক সেন্সর ফিউশন কনসেপ্টের সাহায্যে তখন অপেক্ষাকৃত ছোট বস্তুও শনাক্ত করা সহজ হবে, যা রাডারে সরাসরি ধরা পড়ে না। ইন্টেলিজেন্ট অ্যালগোরিদম যা সম্ভব করবে।’
এক্ষেত্রে অন্য কোনো জাহাজের সঙ্গে সংঘাতের উপক্রম হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারা হলো প্রথম পদক্ষেপ। স্বতন্ত্র জাহাজটি তখন নিজেই স্থির করবে, এই অবস্থায় কী করা উচিত- তার নিজের এগিয়ে যাওয়ার অধিকার আছে, না কি পাশ কাটিয়ে যেতে হবে?
ফ্রাউনহোফার ইনস্টিটিউটের হান্স-ক্রিস্টফ বুয়রমাইস্টার বলেন, ‘আমরা জাহাজকে আরও বুদ্ধি দিতে চাই, যাতে সে নিজস্ব ক্ষমতায় যাত্রাপথ স্থির করতে পারে এবং নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে- যেমন সংঘাত এড়িয়ে যাওয়া, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় নিরাপদে এগিয়ে যাওয়া ইত্যাদি।’
তবে একেবারেই কোনো নজরদারি ছাড়া নাবিকহীন জাহাজ চলবে না। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি সব কিছুর উপর নজর রাখবেন এবং প্রয়োজনে হস্তক্ষেপ করবেন- যেমন জাহাজের স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম পরিস্থিতি সামলাতে না পারলে অথবা সেগুলো বিকল হয়ে গেলে। এমন পরিস্থিতিতে দূর থেকে একযোগে ৬টি জাহাজ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
গবেষকদের দাবি, এই যান্ত্রিক উদ্ভাবনের ফলে নাবিকদের পেশার চরিত্রও বদলে যাবে।
ফ্রাউনহোফার সিএমএল-এর প্রধান কার্লোস ইয়ান বলেন, ‘আমাদের ধারণা, খোলা সমুদ্রে জাহাজ স্বতন্ত্রভাবে চলবে। তবে সীমাবদ্ধ জলপথ বা বন্দরে সেটা সম্ভব হবে না। তখন জাহাজ বন্দর থেকে বার করা এবং বন্দরে নিয়ে আসা নতুন এক পেশা হয়ে উঠবে। অথবা কন্ট্রোলরুমে বসে দূরের জাহাজ নিয়ন্ত্রণ করাও নতুন কাজ হবে।’
জার্মানির ফ্রাউনহোফার সামুদ্রিক গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীদের স্বপ্ন একদিন সফল হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। তবে আইনি জটিলতার কারণে কিছুটা হলেও দেরি হবে। কারণ এই মুহূর্তে নাবিকহীন জাহাজ সমুদ্রে পাঠানো বেআইনি কাজ। তাই আজই এই ব্যবস্থা যাচাই করতে এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হতে সিমুলেটারই একমাত্র ভরসা।
বাংলাদেশ সময়: ২০:২৮:৩৫ ৩৮৪ বার পঠিত