বঙ্গনিউজ ডটকমঃ প্রকৃত অর্থে জন্মগত দিক দিয়ে হিজড়া সাধারণত তিন প্রকার। যা নিম্নোক্ত ছকের আলোকে দেখানো হলো।
ক) একদিকে একটি শুক্রাশয় (ঞবংঃরং) ও একটি ডিম্বাশয় (ঙাধৎু) এবং অপর দিকে একটি শুক্রাশয় অথবা ডিম্বাশয় থাকবে।
খ) একদিকে ডিম্বাশয়, শুক্রাশয় এবং অপরদিকে ডিম্বাশয়।
গ) একদিকে একটি ডিম্বাশয় এবং অন্যদিকে একটি শুক্রাশয়।
অবশ্য আরেক প্রকারের হিজড়া আছে, যারা কৃত্রিম। এই ধরনের অধিকাংশ হিজড়াই পুরুষালি। মূত্রনালী স্বাভাবিক স্থানে থাকে। অনেকের পুরুষাঙ্গ না থেকে যোনি থাকে। তবে নারীদের মতো স্বাভাবিক যোনি থাকে না। মূত্রনালী ও যোনিপথ একইসঙ্গে থাকে। কৈশোরে এদের মধ্যে স্তনগ্রন্থির কিছুটা প্রকাশ ঘটে। কারও কারও অল্প বিস্তর ঋতুচক্র দেখা দেয়, তবে তা যথাযথ নয়। এছাড়া এমন অনেক মানুষ রয়েছে যারা মূলত ছদ্মবেশি হিজড়া। হিজড়াদের জন্ম প্রসঙ্গ ও তাঁদের জীবনমান উন্নয়ন ও বিশ্লেষণে, একটি কথা বলতে হয় আমাদের দেশে কুসংস্কার ও অজ্ঞতার জন্যে কিছু জীবনের ওপর নেমে আসে অমানবিক সামাজিক সিদ্ধান্ত। যার কারণে হিজড়ারা নিগৃহীত হয়ে থাকে।
প্রকৃতপক্ষে চিকিৎসাবিজ্ঞানে হিজড়া বলে কিছু নেই। হিজড়া কথাটি আমাদের সমাজেরই তৈরি। বাবা-মা দুজনের জিন ঘটিত সমস্যা থাকলে, তাঁদের শিশু হিজড়া হতে পারে। এক্ষেত্রে বাবা-মা স্বাভাবিক থাকে। কিন্তু উভয়ের কাছ হতে ত্রুটিপূর্ণ জিন পাওয়ায় শতকরা ২৫ ভাগ ক্ষেত্রে শিশুর শরীরে হরমোনের অস্বাভাবিকতা দেখা দিতে পারে। অল্প বয়সে এমন উপসর্গ ধরা পড়লে এর চিকিৎসা সম্ভব। কিন্তু আমাদের দেশের হিজড়া শিশুদের ব্যাপারে সচেতনতার অভাব রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় মানুষ জানেই না যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে হিজড়াদের চিকিৎসা এদেশেই সম্ভব।
হিজড়া শিশুকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার প্রবণতা আমাদের দেশে রয়েছে। এটা না করে তাদের যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে এরাও অন্য দশজনের মতো যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে বাস করতে পারে। হিজড়া শিশুর জন্ম দেওয়ায় অধিকাংশ বাবা-মা ও পরিবার সামাজিকভাবে লজ্জা ও গ্লানিতে ভোগেন। ফলে একটা বড় অংশ সম্পূর্ণ পরিবার থেকে আলাদা হতে বাধ্য হয়। সাধারণ বাংলাদেশে হিজড়ারা নিজেদের একটি আলাদা সমাজ তৈরি করে বসবাস করছে। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের হিজড়া সমাজ একই ধারায় গড়ে উঠেছে। এই উপমহাদেশের মতো হিজড়া সমাজব্যবস্থা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। ইউরোপসহ পাশ্চাত্য বিশ্বে হিজড়া বা জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধীরা তাদের পরিবারের সঙ্গেই থাকে। অনেক ক্ষেত্রে নিজেরা সঙ্গী খুঁজে নিয়ে সংসার করে।
উন্নত দেশে হিজড়াদের ওপর সামাজিক ও পারিবারিক সহানুভূতি রয়েছে। কিন্তু আমাদের সমাজে হিজড়াদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ বিদ্যমান। সেহেতু তারা নিজেদের মধ্যে আলাদা চালচলন, আইন-কানুন, এমনকি নিজস্ব জীবনযাত্রার ভাষা তৈরি করে মূলস্রোত থেকে সরে গিয়ে গড়ে তুলেছে এক স্বতন্ত্র উপসমাজ। হিজড়াদের সমাজে নেতৃত্ব দেন গুরু মা। হিজড়া সম্প্রদায়সহ অধিকাংশ গুরু মায়েরা মূলস্রোতে ফিরে আসতে চান না। তাছাড়া সমাজও হিজড়াদের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন অনুভব করে না। এ কারণেই বাংলাদেশের হিজড়া সমাজ সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক এক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। উল্লেখ্য, হিজড়া জনগোষ্ঠীর ওপর সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান ও তথ্য নেই।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো জানায়, এ পর্যন্ত কোনো শুমারিতে হিজড়াদের তথ্য সংগৃহীত হয়নি। এদিকে বাংলাদেশের হিজড়া সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের সূত্র ধরে বাংলাপিডিয়ায় তথ্যানুযায়ী প্রথমবারের মতো দেখা যায়, এদেশে হিজড়ার সংখ্যা ১ লাখ ৫০ হাজারের কাছাকাছি।
বাংলাদেশের উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আসা হিজড়ারা সঙ্গবদ্ধ হয়ে আলাদা সমাজ গড়ে তুলেছে। আর এই হিজড়া সমাজের বিশেষ একটি বৈশিষ্ট্য হলো, তাদের সবার সমান অধিকার বিদ্যমান। অবশ্য উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধী হিজড়াকে পারিবারিকভাবে চিকিৎসা এবং তৎপর পুনর্বাসন করে স্বাভাবিক জীবনে ধরে রাখতে সচেষ্ট হয়ে থাকে। কিন্তু নিম্নবিত্তের প্রায় সব জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধী হিজড়া সন্তানরা। যারা এই সম্প্রদায়ে আসতে বাধ্য হয়। এদিকে কথিত আছে যে, দলভারি করার জন্য সুন্দর শিশু বাচ্চাকে হিজড়ারা অপহরণ করে তাদের যৌন অঙ্গহানি করত। তাছাড়া বাংলাদেশের অনেক বাবা-মা লোকলজ্জার ভয়ে তাদের গুপ্তলিঙ্গের এই হিজড়া সন্তানকে স্বেচ্ছায় হিজড়া পল্লীতে দিয়ে আসে। কেননা বেশিরভাগ পরিবারের হিজড়ারা সহানুভূতি পায় না।
এদিকে গুপ্তলিঙ্গের সন্তানদের এ বিষয়টি সমাজ ও পরিবারের দৃষ্টিতে অস্বাভাবিক। অথচ বৈশিষ্ট্যগত দিক দিয়ে তারা হিজড়া নয়। এই কারণে তারা পরিবারের বা সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এভাবেই পরিবারের সঙ্গে তৈরি হতে শুরু করে দূরত্ব। এক সময় তারা হয়ে পড়ে নিঃসঙ্গ। সামাজিক এ অসঙ্গতির কারণে অনেকে স্বেচ্ছায় হিজড়া দলে চলে যেতে হয়। বাংলাদেশের হিজড়াদের মধ্যে রয়েছে সুসম্পর্ক, বিশেষ করে গুরু মায়েদের ছত্রছায়ায় এদের সারাদেশে সুগঠিত চেইন অব কমান্ড রয়েছে। এদেশের হিজড়াদের মধ্যে দুটি ধারা বিদ্যমান। ক) পেশাদার যৌনকর্মী খ) গান করা হিজড়া। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই দুই গ্রুপের মধ্যে ঠাণ্ডা দ্বন্দ্ব চলতেই থাকে।
এ প্রেক্ষাপটে নাচ-গান করা হিজড়ারা যৌনকর্মীদের সমপর্যায়ের মনে করে না। কেননা তাদের মতে ওরা সমকামী পুরুষ। এদিকে যৌনকামী হিজড়া বলে অভাবের তাড়নায় তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। এতকিছুর পরও হিজড়া সম্প্রদায়কে আমাদের মূল জীবন স্রোত থেকে দূরে সরিয়ে রাখার কোনো উপায় নেই। কারণ তারা আমাদেরই আপনজন। তাদের শিক্ষার হার বাংলাদেশের গড় শিক্ষা হারের থেকে অনেক নিচে। আর হিজড়াদের শিক্ষার হার কম হওয়ার কারণে সামাজিক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে পারে না। দরিদ্র পরিবারের যৌন প্রতিবন্ধীরাই মূলত সমাজে হিজড়া হিসেবে পরিচিত।
আমাদের দেশে এমনিতেই তাদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ কম। দারিদ্র্যের সঙ্গে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিকূল পরিবেশ হিজড়াদের শিক্ষার সুযোগ থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বঞ্চিত করে থাকে। এ কারণেই তাদের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নে প্রতিনিয়ত প্রতিকূল পরিবেশ তীব্রভাবে প্রবিন্ধকতা সৃষ্টি করছে। একদিকে যেমন শিক্ষার সুযোগ নেই, তেমনি চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার থেকেও তাদের হতে হচ্ছে বঞ্চিত।
এক্ষেত্রে দেখা যায়, হিজড়া সম্প্রদায়ের এই মানুষগুলো সার্বিকভাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের মতো মৌলিক অধিকার থেকে অনেকটাই বঞ্চিত। প্রাচীনকাল থেকে হিজড়াদের একমাত্র পেশা ‘তোলা’ সহ নবজাতকে নিয়ে ঢোল বাজিয়ে নাচ-গান করা। কেননা হিজড়াদের দিয়ে নাচ-গান করালে নাকি সন্তানের মঙ্গল হয়, এমন ধারণা প্রাচীন সমাজের মধ্যে প্রচলিত ছিল। তাছাড়া বিয়ের অনুষ্ঠানে কমেডিয়ান ও চিত্তরঞ্জক হিসেবে আমন্ত্রিত হতো। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে যুক্তিনির্ভর সমাজে এসব অবৈজ্ঞানিক প্রথা দিন দিন হ্রাস পেয়েছে।
বাংলাদেশ ও ভারতে হিজড়াদের মতে জন্ম নিয়ন্ত্রণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় হিজড়াদের এ পথে উপার্জন তুলনামূলক কমে গেছে। তাই নবজাতককে নাচানো পেশা হ্রাস পাওয়া এবং বাজারে তোলা তুলে জীবন চলছে না বলে তারা অন্য পেশায়ও যেতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও হিজড়ারা পছন্দীয় পেশায় আসতে পারছে না। এ কারণেই দিনে দিনে যৌনপেশা ও চোরাচালানের মতো ঘৃণ্য জীবিকার স্বার্থে জড়িয়ে পড়ছে। অথচ আমাদের সমাজ সচেতন হয়ে মানবতার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগোলে এবং যথাযথ প্রশিক্ষণ পেলে অন্যান্য পেশায়ও পারদর্শী হয়ে উঠতে পারে। কেননা হিজড়াদের বুদ্ধ্যঙ্ক সাধারণ মানুষের চেয়ে কোনো অংশে কম নেই।
ইদানীং ঢাকা মহানগরীতে চাঁদাবাজি ও এলাকার আধিপত্য নিয়ে হিজড়া সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরীণ কোন্দল বেশ প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরা কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পারস্পরিক ঝগড়া ঝাটিতে জড়িয়ে পড়ছে। প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয়া আসল হিজড়ারা ছদ্মবেশি হিজড়ারূপে পুরুষ চক্রের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে।
এখানে উল্লেখ্য, কিছু অসুস্থ মানসিকতার পুরুষ অস্ত্রোপাচারের মাধ্যমে লিঙ্গ কর্তনপূর্বক কৃত্রিমভাবে হিজড়ায় রূপান্তর হয়ে জোট বেঁধে প্রকৃত হিজড়াদের ওপর সব সময় জোর-জুলুম চালিয়ে যাচ্ছে। যতদূর জানা যায়, শ্যামলী, ধামরাই ও খুলনার ফুলতলায় কয়েকটি গোপন বেসরকারি ক্লিনিকে পেশাদার ডাক্তার দিয়েই পুংলিঙ্গ কেটে হিজড়ায় পরিণত হয়।
এরাই ঢাকাসহ সারাদেশে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসায়, খুনসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এরা এসব অপকর্ম করে অঢেল সম্পদের মালিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। উল্লেখ্য যে, এদের শুধু পুংলিঙ্গই কাটা হয় না, একইসঙ্গে বিশেষ হরমোন সংবলিত ওষুধের মাধ্যমে দৈহিক পরিবর্তন আনা হয়। মানুষের হাতে সৃষ্ট এই হিজড়াদের ঈযরহহর বলা হয়ে থাকে।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে, এ পুরুষরা কেন লিঙ্গ ছেদন করে হিজড়া সাজে? অবশ্য এর পেছনে যে কারণ আছে তা হলো, একদিকে চরম দারিদ্র্য, অন্যদিকে অসুস্থ দৃষ্টিভঙ্গির আবর্তে অতি লোভের বশবর্তী হয়ে অল্পসময়ে নিরাপদে অর্থ উপার্জন করার এটা সহজ পথ। তাছাড়া হিজড়ার প্রতি সমাজ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থারা এদেরকে অসহায় ভেবে তাদের ওপর সাধারণ মানুষের চেয়ে তুলনামূলক দুর্বল থাকে। সেহেতু হিজড়ারা সেই সুযোগ নিয়ে থাকে। আর যত দূর খবর নেয়া হয়েছে, তাতে জানা যায় এই পুংলিঙ্গ কর্তন করতে একটি ডাক্তার ন্যূনতম পনেরো হাজার টাকা নিয়ে থাকে।
উল্লেখ্য, হিজড়াদের মধ্যে কারও কারও রয়েছে প্রচুর সম্পদ। তারা কিভাবে এ সম্পদ গড়েছে সে ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত না হওয়া গেলেও যতদূর জানা যায় চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, সন্ত্রাসীদের আশ্রয়সহ নানা অপরাধমূলক কর্মকা-ের মধ্যদিয়ে তাদের অর্থের সমাগম হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩:৩৬:৩১ ৭৪৬ বার পঠিত