বঙ্গনিউজ ডটকমঃস্বপ্ন স্বপ্নের জায়গায় থাকুক, আপাতত দমবন্ধ অবস্থা থেকে রেহাই দিনস্বপ্ন স্বপ্নের জায়গায় থাকুক, আপাতত দমবন্ধ অবস্থা থেকে রেহাই দিনমাত্র কয়েক দিন আগে ঢাকা শহরের উত্তর-দক্ষিণের মেয়র মহোদয়গণ প্রথম আলোর এক গোলটেবিল বৈঠকে বলেছেন যে ঢাকা শহরের যানজটের জট খোলার দায়িত্ব তাঁদের নয়। কারণ, এককভাবে তাঁদের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়। তাঁরা দুজনেই এ সমস্যা সমাধানের সমন্বিত ব্যবস্থাপনার কথা বলেছেন। অপর দিকে ঢাকা উত্তরের মেয়র প্রায়ই ঢাকাবাসীকে অনেক স্বপ্ন দেখান। তিনি এককভাবে ‘মিট দ্য প্রেস’-এ বলেছেন, সমস্যার সমাধান একার পক্ষে সম্ভব নয়। দৈনিক যুগান্তর পত্রিকা অফিসে মেয়র পদপ্রার্থীদের প্রাক্-নির্বাচনী আলোচনায় আমি স্পষ্টতই বলেছিলাম যে এত লম্বা ফিরিস্তি যে তাঁরা দিচ্ছেন, তা আদৌ করতে পারবেন না। যতটুকু করতে পারবেন, ততটুকু বলার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। এখন হয়তো তাঁরা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছেন যে আমাদের দেশের স্থানীয় সরকারপ্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু করার ক্ষমতাই নেই।
আমাদের মেয়র মহোদয় দুজনের মুখেই অভিন্ন সুর-তা হলো ঢাকা শহরের দায়িত্ব কার? মেয়র সাহেবদের কাজ কী, তা আমরা বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য ১০ শহরের মধ্যে ৯ নম্বর শহরের দায়িত্বের সমন্বয় তো অতীতেও দেখিনি, ভবিষ্যতেও দেখব কি না জানি না। এ সমন্বয়ের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে কয়েক দিন আগে প্রথম আলোর শিরোনামে ‘উন্নয়নের চাপে খাল সব নালা’-এর ওপর মন্তব্যে ঢাকা উত্তরের মেয়র মহোদয় বলেন যে খাল পুনরুদ্ধার করপোরেশনের কাজ নয়, এখানে জড়িত রয়েছে একাধিক সংস্থা। এ চিত্র শুধু খালেরই নয়, সমগ্র ঢাকা শহরের সব ধরনের সমস্যার। বারো ভূতের হাতে যখন এই শহর, তখন আমাদের কী হবে?
মেয়র সাহেবদের অসহায়ত্বের কথা পত্রিকায় পাঠের বহু বছর আগে বাংলা বা অন্য কোনো ভাষার কোনো এক বিখ্যাত লেখকের, যাঁর নাম আমি কিছুতেই মনে করতে পারছি না, একটি রম্য রচনা পড়েছিলাম। কোনো সুহৃদ পাঠক এই স্বনামধন্য লেখকের এ রচনার শিরোনাম ও তাঁর নামটি জানলে বা পরিচিত থাকলে আমাকে জানালে বাধিত থাকব। গল্পটি এ রকম: একজন কবি, ভাবুক ভদ্রলোক হঠাৎ বৃষ্টি থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখতে শহরের এক ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের দেয়ালের বাইরের বিশাল এক গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ প্রচণ্ড বাতাস আর বৃষ্টিতে এবং গোড়া দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারণে গাছটি পড়ল নেহাতই গোবেচারা ভদ্রলোকের ওপরে। তিনি চাপা পড়লেন গাছের নিচে। বের হতে পারছিলেন না। সাহায্যের জন্য তারস্বরে চিৎকার শুরু করলেন। চিৎকার আর আকুতি-মিনতি শুনে ক্লাবের লোকজন দৌড়ে এলেন। গাছের নিচে চাপা পড়ে থাকা ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করে ধৈর্য ধরতে বললেন আর জানালেন যে যেহেতু রাস্তার পাশের গাছ, তাই তাঁদের কিছু করার নেই। খবর দিতে হবে সড়ক ও জনপথ বিভাগকে। যেই কথা সেই কাজ। কর্মকর্তা এলেন, গাছ দেখলেন। চাপা পড়া ভদ্রলোককে ধৈর্য ধরতে বলে বললেন যে আসলে রাস্তার পাশে হলেও গাছ সরানোর এখতিয়ার তাঁদের নেই। কারণ, গাছটি বন বিভাগের দায়িত্বে।
এত সবের মধ্যে ভদ্রলোকের আকুতি আর কারও কর্ণকুহরে প্রবেশ করল না। পা ভেঙে টুকরো হয়ে গেছে, তিনি চাপায় পড়ে কাতরাচ্ছেন। বন বিভাগের কর্মকর্তা এলেন। নথিপত্র দেখে বললেন যে গাছটা তো তাঁদের ঠিকই, তবে এটা সরাতে কাটতে হবে। তার জন্য ঠিকাদার লাগবে, ফাইল মুভ করতে হবে। এরই মধ্যে তাঁরা জানলেন যে চাপা পড়া ভদ্রলোক একজন কবি। কর্মকর্তা ভড়কে গেলেন, এত বড় কবির গায়ে হাত দিতে পারবেন না, এটা তাঁদের দায়িত্বে পড়ে না। কবির দায়িত্ব সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের। তাদের খবর দেওয়া হয়েছে। ততক্ষণে চাপা পড়া কবির দম আসে আর যায়। সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের বড় কর্মকর্তা এলেন। কবিকে সাহস রাখতে বলে জানালেন যে বিষয়টা বেশ জটিল হয়ে পড়েছে। অনেক মন্ত্রণালয় জড়িত, তাই আন্তমন্ত্রণালয় মিটিং করতে হবে। এসব করে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যখন সব ঠিকঠাক, গাছ কেটে কবিকে বের করা হবে, ততক্ষণে কবি মহোদয় জীবনের শেষ কবিতা লিখে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলেন। পরে মহাসমারোহে কবির শেষ ক্রিয়া সমাপ্ত হলো। স্মরণসভা শেষ হলো। যে যাঁর কাজে মনোযোগ দিলেন।
হালে ঢাকার দুই মেয়র মহোদয়ের মন্তব্য শুনে অনেক বছর পরে এ রম্য রচনাটি মনে পড়ল। ঢাকা শহরের প্রতিদিনকার সমস্যাগুলো, যেগুলোর জন্য প্রতিদিন এ শহরের কোটি কোটি মানুষকে বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হচ্ছে, তাদের কী হবে? শত শত কোটি টাকা গচ্ছা যাচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে পড়ে থাকায়। ঢাকা শহরের জ্যামের বেশির ভাগ কারণ অব্যবস্থা। আমি আগেও নিবেদন করেছি, আবার করছি। উত্তরে থাকি, তাই উত্তরের সজ্জন ব্যক্তি এবং ব্যক্তিগতভাবে বেশ পরিচিত মেয়র সাহেবকে আমার ক্ষুদ্র মতামত ব্যক্ত করছি। প্রথমত, আপনার এলাকায় অনেক পদচারী সেতু রয়েছে, সেগুলো যে ব্যবহৃত হচ্ছে না, তার জন্য মেয়র সাহেব পথচারীদের উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। কোটি টাকা খরচ করে চলন্ত সিঁড়ির পদচারী সেতু বানানো হয়েছে, তা মোটেও ব্যবহৃত হচ্ছে না, এটা সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব নয় কি!
ঢাকায় রাস্তার পাশে বেশ কিছু বাসস্ট্যান্ড রয়েছে, কিন্তু সেগুলো বাসের জন্য ছাড়া আর সব কাজে ব্যবহার করা হয়। সামান্য উদ্যোগের প্রয়োজন। গুলশান অ্যাভিনিউয়ের ফুটপাত গাড়ি পার্কিংয়ের দখলে চলে গেছে। ফুটপাত গাড়ি পার্কিং থেকে মুক্ত করতে কার সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে, সাধারণ নাগরিকের জানা নেই। গুলশান-বনানী আর আবাসিক এলাকা নেই, বাণিজ্যিক এলাকা হয়ে গেছে। অথচ কোনো বিপণিবিতান, অফিসের, ব্যাংকের এবং অন্যান্য স্থাপনার কোনো গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা নেই। শুনেছিলাম, পিংক সিটির শপিং মলের পাশের পার্ক নামক জায়গাটিতে পার্কিংয়ের জায়গা করার কথা ছিল, সেই পরিকল্পনার কী হলো জানা নেই। আমরা
সাধারণ নাগরিকেরা তো ভুক্তভোগী। বিশ্বের কোনো বড় শহরে বাণিজ্যিক এলাকায় রাস্তার পাশে গাড়ি রাখার কথা চিন্তাও করা যায় না। তা-ও আবার বিনা মাশুলে।
শহরের প্রধান সড়কগুলোতে বহু নির্ধারিত বাসস্ট্যান্ড রয়েছে, কিন্তু সেগুলোতে বাস থামে না। বাস থামে যত্রতত্র, যাত্রী ওঠানো-নামানো হয় খেয়ালখুশিমতো জায়গায়, রাস্তার মোড়ে, রেললাইনের ওপরে। বাসস্ট্যান্ডগুলোতে বিভিন্ন ধরনের দোকান বসেছে। বাস দাঁড় করানো হয় মোড়ের মাথায়, সম্পূর্ণ সড়ক বন্ধ করে। ফুটপাত সম্পূর্ণ দখলে। মহাখালী রেলওয়ে ক্রসিংয়ের ওপরে লেগুনাজাতীয় গাড়ির স্ট্যান্ড আর অস্থায়ী ফেরি দোকান। এমনকি সময়ে সময়ে বাস থেকে যাত্রী ওঠানামাও করে কর্তব্যরত পুলিশের নাকের ডগার ওপরে। এগুলোর তো মেয়র সাহেবদের তৎপরতায় কিছুটা উন্নতি হতে পারে। সেনানিবাসে যদি এই শহরের বাস নির্দিষ্ট স্ট্যান্ড থেকেই যাত্রী ওঠাতে ও নামাতে পারে, তবে ওই একই বাস জাহাঙ্গীর গেট পার হলেই স্বরূপ ধারণ করে কেন? সেখানে রিকশা চলে নির্দিষ্ট পথে। এক শহরে দুই ধরনের ব্যবস্থা চোখে পড়ার মতো নয় কি? এর কারণ অতি সহজ, আইনের প্রয়োগ।
প্রার্থী থাকা অবস্থায় দুই মেয়রকেই বলেছিলাম ঢাকা শহরে পুরুষ-মহিলা উভয়ের জন্য পাবলিক টয়লেট তৈরির কথা। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগের কথা অদ্যাবধি শুনিনি। এই উপমহাদেশের বহু শহরে দাতব্য সংস্থাগুলোর এবং বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সিএসআরের মাধ্যমে এ ধরনের পাবলিক টয়লেট তৈরি করে পৌরসভা বা করপোরেশনকে সাহায্য করেছে। ওই সব পৌরসভা বা করপোরেশনের দায়িত্ব শুধু সুন্দর ব্যবস্থাপনা করা। বিদেশে এসব টয়লেট ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে যে মাশুল নেওয়া হয়, তা যোগ হয় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য। এমনি বেশ কিছু কাজ রয়েছে, সেগুলো মেয়রগণ স্ব-উদ্যোগে করতে পারেন। এর জন্য প্রয়োজন জনসাধারণের কাছে ভোট প্রার্থনাকালে প্রাক্-নির্বাচনী অঙ্গীকারের প্রতি কিছুটা হলেও সৎ থাকা।
সর্বশেষে অতি সংক্ষেপে বলতে চাই, ঢাকার বিভিন্ন ওয়ার্ডে ‘মিট দ্য সিটিজেন’-এর নিয়মিত আয়োজন করুন, তাঁদের কথা শুনুন। প্রয়োজনে এলাকাভিত্তিক পরামর্শক হিসেবে ওই এলাকার জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে উন্নয়নের রূপরেখা তৈরি করুন। সবকিছুই ‘প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ আর রাজনৈতিক সদিচ্ছার’-যেমনটি পত্রিকায় প্রকাশ-ওপর ছেড়ে দিলে এত কষ্ট করে মেয়র নির্বাচন অথবা পদ তৈরির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হবে। সব কাজে প্রধানমন্ত্রীকে টেনে আনা কতখানি সমীচীন, তা-ও ভেবে দেখার বিষয়।
আমরা ধৈর্য ধরে আশার বাণী শুনছি। বড় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে তো অনেক সময়, ততক্ষণে গাছের চাপায় পড়া কবির মতো ঢাকাবাসীর দম বন্ধ হয়ে আসতেও পারে। দয়া করে টাস্কফোর্স আর রাজনৈতিক সদিচ্ছার আশায় বসে না থেকে সামান্য হলেও যেগুলো এখন করার চেষ্টা করা যায়, সেগুলোতে হাত দিন। স্বপ্ন দেখা বা দেখানো অন্যায় নয়, তবে মোহে থাকা ঠিক নয়। স্বপ্ন স্বপ্নের জায়গায় থাকুক, আপাতত গাছ সরিয়ে চাপা পড়া ঢাকা শহরকে বাঁচান। আমাদের ধৈর্য ধরা ছাড়া আর করার কীই-বা আছে?
বাংলাদেশ সময়: ১:১৮:১৯ ৩৯৬ বার পঠিত