বঙ্গনিউজ ডটকমঃ পর্দা থেকে বেরিয়ে কোটি তরুণের স্বপ্নের নায়ক হয়ে উঠেছিলেন তিনি। প্রত্যেকের ভেতর জাগিয়ে তুলেছিলেন স্ব স্ব অসাধারণত্ব। সে কারণেই তিনি এখনো অবিস্মরণীয়। বাংলা চলচ্চিত্রের যাবৎকালের অন্যতম সেরা তারকা সালমান শাহর ১৯তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে লিখেছেন প্রীনন পাখোয়াজবেলা ১১টার দিকে একটা ফোন আসে তার মা নীলা চৌধুরীর বাসায়। বলা হয় সালমানকে দেখতে চাইলে তখনি যেতে হবে। এ কথার পরেই তারা যান সালমানের বাসায়। সালমানের ইস্কাটনের বাসায় তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের ডাক্তাররা তার মৃত্যু নিশ্চিত করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ময়নাতদন্তে বের হয়ে আসে সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন। সম্পূর্ণ আকস্মিক এ ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে পড়ে তার পরিবার এবং পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় সালমানকে হত্যা করা হয়েছে।
দেশজুড়ে সালমানের অসংখ্য ভক্ত তার মৃত্যু মেনে নিতে না পারায় বেশ কয়েকজন তরুণীর আত্মহত্যার খবরও আসে পত্রিকায়। পরিবারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিতীয়বারের মতো ময়নাতদন্ত করা হয়। মৃত্যুর আট দিন পর সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে তিন সদস্যবিশিষ্ট মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়। সেই বোর্ডের প্রধান ছিলেন ডাক্তার নারগিস বাহার চৌধুরী, যিনি বলেছেন আত্মহত্যার স্পষ্ট প্রমাণ তারা পেয়েছিলেন।
তখন সালমানের ঘনিষ্ঠজনেরা বলেছিলেন, শেষের দিকে বেশ মানসিক চাপের মধ্যে ছিলেন সালমান। পরিবারের সদস্যদের সাথে সম্পর্কের টানাপড়েন ও প্রযোজকদের সাথে বোঝাপড়ায় ঘাটতি দেখা দিয়েছিল সে সময়। এ দিকে দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে আবার আত্মহত্যার বিষয়টি নিশ্চিত করা হলে মামলার কাজ সেখানেই থেমে যায়। তবে সালমান শাহকে নিয়ে আলোচনা থামে না। মাত্র চার বছরে ২৭টি সিনেমায় অভিনয় করে সালমান শাহ বাংলা সিনেমায় নিজের যে স্থানটি করে নিয়েছিলেন, তার অভাব এখনো অনুভব করেন দর্শক, পরিচালক, প্রযোজক সবাই।
কোনো চলচ্চিত্রভিনেতা মারা যাওয়ার পর ভক্তদের সারিবেঁধে আত্মহত্যার ঘটনা বিরল। সেই ঘটনাটিই ঘটেছিল ১৯৯৬ সালে। দেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম সেরা তারকাটির মৃত্যুর পর।
কিন্তু কেন? সালমান কী এমন করেছিলেন যে মানুষের বাস্তব জীবনের ওপর এতটা প্রভাব তিনি ফেলতে পেরেছিলেন?
আর দশজন মানুষের মতোই ছিলেন সালমান। সালমান শাহ তার শোবিজের নাম। মা-বাবার দেয়া নাম ছিল শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন। তিনি সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭০ সালে।
সোহানুর রহমান সোহানের পরিচালনায় কেয়ামত থেকে কেয়ামত চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ১৯৯৩ সালের ২৫ মার্চ দর্শকের সামনে আসেন। চার বছরের অভিনয়জীবনে তার উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র কেয়ামত থেকে কেয়ামত, অন্তরে অন্তরে, বিক্ষোভ, স্বপ্নের ঠিকানা, দেনমোহর, তোমাকে চাই, সত্যের মৃত্যু নেই, মায়ের অধিকার, আনন্দ অশ্রু প্রভৃতি। সালমান শাহ অভিনীত সর্বাধিক চলচ্চিত্রের পরিচালক ছিলেন শিবলি সাদিক। মৌসুমীর সাথে ছিল সালমান শাহের প্রথম জুটি বাঁধা। চরম সাফল্যের সম্ভাবনা থাকলেও এই জুটির চলচ্চিত্র মাত্র চারটি। শাবনূরের সাথে সালমানের চলচ্চিত্রের সংখ্যা ১৪। মজার বিষয় হলো, সালমানের আবিষ্কারক সোহানুর রহমান সোহান কেয়ামত থেকে কেয়ামত নির্মাণের পর আর দ্বিতীয় কোনো চলচ্চিত্রে সালমানকে নিয়ে কাজ করার সুযোগ পাননি। একই ব্যর্থতা প্রযোজক সিরাজুল ইসলাম ও সুকুমার রঞ্জন ঘোষের। তাদের প্রযোজিত কেয়ামত থেকে কেয়ামত ছিল সালমানের প্রথম চলচ্চিত্র। প্রথম সুযোগে চুক্তিতে পাঁচ বছর আনন্দ মেলা সিনেমায় থাকার কথা থাকলেও চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। তবু সালমান শাহ ছিলেন যৌবন বাউলশিল্পী। নিজের সত্তাকে স্বেচ্ছায় পরিবর্তন করা শিল্পী। সামগ্রিক অর্থে দ্যুতিময় এক শিল্পীর নাম সালমান শাহ।
প্রাণশক্তিতে ভরপুর সালমানের সংস্পর্শে যে-ই এসেছেন, অধিকাংশেরই তাকে নিয়ে আফসোস। এতবড় প্রতিভা নিয়ে জন্মানো এই অভিনেতা তার পুরোটা দিয়ে যেতে পারলেন না। তার অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র কেয়ামত থেকে কেয়ামতের শেষ দৃশ্যের মতো জীবনের রথও থেমে গিয়েছিল ওই ছবি করার ঠিক চার বছর পর। ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। সেদিন ছিল শুক্রবার।
১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ মাত্র চার বছর ছিল তার অভিনয়জীবন। এই স্বল্প সময়ে সালমান শাহর প্রাপ্তি ছিল আকাশচুম্বী। নিজের সাথে বোঝাপড়া করতে, মনের অতলে নিজেকে খুঁজতে, ভুলগুলো ভুল ভাবতেই সালমান হারিয়ে গেছেন। প্রায়ই ভুলে থাকা সালমান শাহ দর্শকদের কাছে সম্পূর্ণ অতীত। অনন্ত জিজ্ঞাসা, ‘সালমান কেন অসময়ে, অবেলায়, অভিমানে দর্শকদের ছেড়ে চলে গেলেন?’
সালমানের ক্যারিয়ার, লাইফ স্টাইল, জীবন দর্শন- এসবই তাকে সাধারণ ইমন থেকে অসাধারণ সালমান করে তুলেছিল। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই অসাধারণ কিছু একটা লুকিয়ে থাকে। আমরা অবচেতনে সেই অসাধারণত্বকে লালন করি। কিন্তু নিজেকে অসাধারণ বানাতে সবাই পারি না। সালমান সেটাই পেরেছিলেন। সবার থেকে আলাদা হয়ে নিজের অসাধারণত্ব মেলে ধরেছিলেন। ওটাই ছিল তাকে আপন করে ভাবার অন্যতম কারণ। ভেতরে লুকিয়ে থাকা আপন অসাধারণত্ব দিয়ে সালমানকে অনুভব করতে পেরেছিলেন দেশের কোটি তরুণ। ঠিক সে কারণেই সালমান এখনো অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন কোটি মানুষের হৃদয়ে।
সালমানের অনুপস্থিতি কতটা অপূরণীয় তা তার মৃত্যুর পরের দেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির হালচাল দেখলেই বোঝা যায়। আজ পর্যন্তু দেশের চলচ্চিত্রে এমন কোনো অভিনেতা এলেন না, যাকে দেখে দর্শক তার অনুপস্থিতি ভুলতে পারবেন। বরং দিনকে দিন সে অনুপস্থিতি ভয়ঙ্কর বিষণ্নতা আর আফসোস নিয়ে আরো বেশি উপস্থিত হচ্ছে।
সালমান স্বপ্ন জাগিয়ে গিয়েছেন তরুণদের বুকে। তিনি দেখিয়ে গিয়েছেন, তোমার মধ্যের সুপ্ত অসাধারণটুকু মেলে ধরতে পারলে তুমিও অসাধারণ কেউ হয়ে উঠতে পারো। দেশের তাবৎ তরুণদের মনে বিশ্বাস জাগিয়ে গিয়েছেন- তুমিও পারো। তুমিও সুন্দর ও সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে অন্যকে ভালোবাসতে পারো।
বাংলাদেশ সময়: ২৩:২৪:৪১ ৭৮২ বার পঠিত