বঙ্গনিউজ ডটকমঃঅপেক্ষার রাজনীতিতে বিএনপি। অনেক কিছুর জন্যই প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। সবার কাছে একটি গ্রহণযোগ্য নতুন নির্বাচনের প্রত্যাশা করছেন তিনি। দলের নীতিনির্ধারকদের বিশ্বাস, সরকার ২০১৬ সালের শেষের দিকে কিংবা ‘১৭ সালের প্রথম দিকে একটি নতুন নির্বাচন দেবে। নইলে ‘১৯ সালে নির্বাচনের জন্যও অপেক্ষা করতে হবে বিএনপিকে। নতুন নির্বাচনের দাবিতে ফের আন্দোলনে যাওয়ারও চিন্তা রয়েছে বিএনপির। এর আগেই অবশ্য দল পুনর্গঠন করতে চান খালেদা জিয়া। দলে ফেরার অপেক্ষায় বিএনপির সংস্কারপন্থিরাও। সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য জানায়।সূত্রমতে, দলে আমূল পরিবর্তন আনতে লন্ডনে অবস্থান নেওয়া বড় ছেলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বেগম জিয়ার বৈঠকের অপেক্ষায় নেতা-কর্মীরা। দলের সর্বস্তরে তারুণ্যনির্ভর নেতৃত্ব আনতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। বিএনপি-প্রধান কবে লন্ডন সফর করবেন তা অবশ্য এখনো স্পষ্ট নয়। তবে এ সফর চলতি মাসের মাঝামাঝি হতে পারে। আবার ঈদুল আজহাও ছেলের সঙ্গে লন্ডনে করার কথা রয়েছে তার। এদিকে, দল পুনর্গঠনের আগে কারাবন্দী নেতাদের মুক্তির অপেক্ষা করছে বিএনপির হাইকমান্ড। খালেদা জিয়াসহ সিনিয়র নেতাদের সাজা আতঙ্কও বিরাজ করছে নেতা-কর্মীদের মধ্যে। চলমান পরিস্থিতিতে জাতিসংঘসহ প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর জরুরি কোনো পদক্ষেপ নেওয়ারও আশা করছে বিএনপি।
এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আন্দোলন হোক আর সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড হোক, বিএনপিকে শক্ত হাতে ঘর সামলাতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। বিএনপি ছোটখাটো কোনো দল নয়। তাদের সারা দেশে বহু কর্মী-সমর্থক বা শুভাকাঙ্ক্ষী রয়েছে। এখন কোনো আন্দোলন বা দল গোছানো সবকিছুর জন্য বিএনপির কিছু সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে। তবে দলকে সুসংহত করার কোনো বিকল্প নেই। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।’
বিএনপির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, অপেক্ষার প্রহর যত দীর্ঘই হোক না কেন, সবার কাছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া বিএনপি থামবে না। অপেক্ষাকে রাজনৈতিক কৌশলও বলছেন তারা। প্রয়োজনে আরও কিছু দিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে চান তারা। তবে দেশি-বিদেশি কূটনৈতিক মহল বিশেষ করে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ প্রভাবশালী রাষ্ট্র ও সংস্থাগুলো তড়িৎ কোনো উদ্যোগ নিলে নতুন নির্বাচন দিতে সরকার বাধ্য। সরকার হয়তো সে প্রক্রিয়ায় এগোচ্ছে। বিএনপিও নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। নেতা-কর্মীদের আশঙ্কা- বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখার জন্য অপতৎপরতা শুরু হয়েছে। জিয়া পরিবারসহ সিনিয়র নেতাদের নির্বাচন ও রাজনীতি থেকে দূরে সরাতেই ক্ষমতাসীন সরকার সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরই একটি অংশ হচ্ছে প্রতিনিয়ত ‘মিথ্যা’ মামলায় বিএনপির নীতিনির্ধারকদের জড়ানো। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এসব মামলায় অভিযোগপত্র গ্রহণ করা নিয়েও বিএনপিতে নানাভাবে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। উদ্দেশ্য, খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ সিনিয়র নেতাদের ‘সাজা’ দিয়ে নির্বাচন ও রাজনীতিতে অযোগ্য ঘোষণা করা। তবে এ নিয়ে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থাকলেও এটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে বলে জানান সিনিয়র নেতারা।
তারা বলেন, জিয়া পরিবারকে নিয়ে যত ষড়যন্ত্রই হোক না কেন, সরকারের কোনো উদ্দেশ্যই সফল হবে না। নেতারা বলছেন, সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলন যাতে গড়ে উঠতে না পারে সে জন্য বিএনপিতে ভাঙন সৃষ্টির পাঁয়তারাও চলছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে একাধিকবার এ চেষ্টা চালানো হয়। একইভাবে ২০-দলীয় জোটের মধ্যেও সন্দেহ-অবিশ্বাস সৃষ্টি করতে অপকৌশল গ্রহণ করা হচ্ছে। তারা বলেন, এসব করেও সরকারের শেষ রক্ষা হবে না। সরকার নির্বাচনের পথে না হাঁটলে চলতি বছর দল পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শেষ করে আগামী বছর ‘শান্তিপূর্ণ’ আন্দোলনের চিন্তাভাবনাও আছে বিএনপির। এ জন্য চলতি বছরের মধ্যেই তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত দলে শুদ্ধি অভিযান চালাবেন বেগম জিয়া। এদিকে, ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন ওয়ান-ইলেভেন থেকে বাইরে থাকা বিএনপির সংস্কারপন্থি নেতারা। সাবেক এমপিসহ বিভিন্ন পর্যায়ে অর্ধশত নেতা এখনো বিএনপির বাইরে। তারা নতুন কোনো দলেও যোগ দেননি। তাদের নিয়ে দলে ইতিবাচক চিন্তাভাবনাও রয়েছে। তবে দলের কট্টরপন্থি একটি অংশ অবশ্য চান না সংস্কারপন্থিরা দলে ফিরুক। এসব কারণে দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন বিএনপি চেয়ারপারসন। তবে সবাই না হলেও কিছু নেতাকে দলে ফেরাতে সবুজ সংকেত পাওয়া গেছে বলে জানা যায়। অবশ্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, সর্বশেষ বিএনপি ক্ষমতায় থাকার দুই বছর আগে থেকেই ষড়যন্ত্র শুরু হয়। ওই ষড়যন্ত্রের কারণে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দল ও দেশের জনগণকে খেসারত দিতে হচ্ছে। ওই ষড়যন্ত্র এখনো অব্যাহত রয়েছে। এ নিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের সতর্ক থাকার পরামর্শও দেন দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামের এই সদস্য। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কৌশলে বার বার ভুল পথে গেছে বিএনপি। সর্বশেষ তিন মাসের আন্দোলনেও হোঁচট খায় দলটি। এর আগে-পরে একাধিকবার ভুল রাজনীতিতে ছিল দলটি, যার খেসারত এখনো দিতে হচ্ছে বিএনপিকে। এতে সর্বস্তরের নেতা-কর্মীর মধ্যে হতাশা নেমে আসে। অবশ্য সে হতাশা কাটিয়ে দলকে একটি ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে সর্বাত্দক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন খালেদা জিয়া। বিশ্লেষকদের মতে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত একটা বড় ভুল ছিল। নির্বাচনে অংশ নিলে দলটির জয়ের সম্ভাবনা ছিল অনেক বেশি। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টেলিফোনের ডাকে সাড়া না দেওয়াটাও বিএনপি-প্রধানের সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না। প্রয়োজনে হরতাল স্থগিত করে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করা জরুরি ছিল। এ ধরনের রাজনৈতিক ভুলের পুনরাবৃত্তি যেন আর না হয়, তার ওপর জোর দিচ্ছেন নীতিনির্ধারকরা।
অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘বিএনপিতে পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে তৃণমূলে চিঠিও পাঠানো হয়েছে। সময়মতো জেলা-উপজেলার কমিটি হলে তৃণমূল চাঙ্গা হয়ে যাবে। এরপর কেন্দ্রেও এ প্রক্রিয়া চালাতে হবে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা নিয়ে বিএনপিকে কাজ করতে হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে আজ বিএনপি শক্তিশালী থাকলে ছাত্রদের হাতে শিক্ষক লাঞ্ছিত হতো না। শিশুদের অকাতরে জীবন দিতে হতো না। মা-বোনেরা নির্যাতিত হতো না। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়াতে পারত না। অবশ্য বিএনপি চেয়ারপারসনের সাম্প্রতিক বক্তব্য খুবই ইতিবাচক। প্রধানমন্ত্রীকেও ইতিবাচকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। আলোচনার দ্বার খুলে দিতে হবে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ বলেন, ‘বিএনপিতে অনেক বিচক্ষণ ব্যক্তি রয়েছেন। সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভুলে খোলা মন নিয়ে তাদের আলোচনা করতে হবে। বিশাল জনগোষ্ঠীর এ দলের প্রতি আস্থা রয়েছে। এটা কাজে লাগাতে হবে। বিগত আন্দোলনে বিএনপির তৃণমূলকে নাড়া দিয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে দৃঢ়তার পরিচয় দিয়ে এটা সামলাতে হবে। তাদের নিয়মতান্ত্রিক পথে হাঁটতে হবে, কোনোভাবেই জ্বালাও-পোড়াও সমর্থনযোগ্য নয়। আবার নির্বাচনের জন্যও বিএনপিকে প্রস্তুতি নিতে হবে, সেটা যখনই হোক। মোদ্দা কথা, বিএনপিকে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করে যেতে হবে। এতেই সফলতা আসতে পারে।’ বিশিষ্ট সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহর মতে, ‘অতীতে যেসব ভুলভ্রান্তি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে বিএনপিকে খুব দ্রুত তিনটি কাজ করতে হবে। প্রথমত. দলকে জনগণের কাছে দৃশ্যমান করে তোলা। দ্বিতীয়ত. দলকে কার্যকর করা। তৃতীয়ত. শহীদ জিয়ার আদর্শের পক্ষে কঠোরভাবে দাঁড়ানো। এসব কর্মকাণ্ড করতে হয়তো প্রতিকূলতা তৈরি হবে, তবে একটি গণতান্ত্রিক দলের এর কোনো বিকল্প নেই।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপি এমন একটি রাজনৈতিক দল যাকে নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতায় যেতে হবে, অন্য কোনোভাবে নয়। সেটা আত্দশক্তিতে বলীয়ান হয়েই, পরনির্ভরশীলতার মাধ্যমে নয়। কাজেই দল গোছানোর পাশাপাশি বিএনপিকে নির্বাচন সামনে রেখে প্রস্তুতি নিতে হবে। যেসব নেতা-কর্মী বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। কোনো মেকআপ নয়, বিএনপিকে একটি নতুন চেহারায় আধুনিক রাজনৈতিক দল হিসেবে জনগণের পাশে দাঁড়াতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় যেসব রাজনৈতিক প্রশ্ন সমাজে বিদ্যমান, সেসব প্রশ্নেও প্রকাশ্য অবস্থান জরুরি। কারণ, এ দেশের সরকার পরিচালনার কার্যক্রম অনেকাংশে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল।’
বাংলাদেশ সময়: ১০:৪৩:৫৯ ২৮৮ বার পঠিত