বঙ্গনিউজ ডটকমঃ
মোহাম্মদপুরের জাপান গার্ডেন সিটি থেকে শ্যামলী সিনেমা হলের দূরত্ব দেড় কিলোমিটারের বেশি নয়। অথচ এই পথটুকু পাড়ি দিতে সময় লেগেছে দুই ঘণ্টা। তা-ও আবার বাসে। কয়েকজন পথচারী জানালেন, ‘কি করার? বাস থেকে নেমে যে হেঁটে যাবেন তারও কোনো উপায় নেই। ফুটপাথে উঠতে কোমর পানি। মাথার ওপর বৃষ্টি। তার চেয়ে ভালো বাসেই বসে থাকা। অন্তত কাকভেজার হাত থেকে রেহাই মিলবে।’ এই ছিল গতকালের রাজধানীর চিত্র।
এক দিকে জলজট, অপর দিকে যানজট, আর সাথে দিনভর বৃষ্টিতো ছিলই। সব মিলিয়ে গতকাল ঢাকা ছিল স্থবির-অচল। যেন থমকে গিয়েছিল ঢাকা। বৃষ্টি ও পানির কারণে অধিকাংশ দোকানপাট বিকেল পর্যন্ত বন্ধ ছিল। কিছু কিছু মার্কেট-বিপণিবিতান সকাল থেকে খোলা থাকলেও বৃষ্টির কারণে ক্রেতা ছিল না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও উল্লেখযোগ্য শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। সকালের বৃষ্টি উপেক্ষা করে যারা সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়েছিলেন স্কুল ছুটির পড়ে তারা পড়েন মহা বিপাকে। প্রবল বৃষ্টি, রাস্তায় থইথই পানি, যানবাহন নেই। সব মিলিয়ে অনেককে গতকাল রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদতেও দেখা যায়। অনেকেই কর্মস্থলে যেতে পারেননি। ঠিক সময়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছতে না পেরে অনেকে ক্ষতির শিকার হয়েছেন।
গতকাল সকাল থেকেই রাজধানীতে ছিল থেমে থেমে বৃষ্টি। দুপুরের দিকে তা প্রবল রূপ নেয়। এতে মুহূর্তে রাজধানীর অধিকাংশ রাস্তাঘাট হাঁটুপানিতে তলিয়ে যায়। কোনো কোনো এলাকার রাস্তাঘাটে কোমরপানি জমে যায়। ড্রেনেজ ব্যবস্থা পুরোপুরি বিকল হয়ে পড়ায় পানি আটকে পড়ে সর্বত্র। বৃষ্টি আর রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় রাস্তায় যানজটও ভয়াবহ রূপ নেয়। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন রাজধানীর বাসিন্দারা। এর মধ্যে রাস্তাঘাটের খানাখন্দ ও বড় বড় গর্ত মানুষকে আরো ভোগান্তির মধ্যে ফেলে দেয়। রাস্তার ওপর শত শত যানবাহন অকেজো হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। বৃষ্টিতে রাজধানীর ধানমন্ডির বিভিন্ন রাস্তা, এলিফ্যান্ট রোড, নয়াপল্টন, ফকিরাপুল, শান্তিনগর, শান্তিবাগ, ফার্মগেট, গাবতলী, বাংলামোটর, মগবাজার, মিরপুর রোড, দৈনিকবাংলা, রামপুরা, মহাখালী, টিকাটুলি, সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ীর প্রধান প্রধান সড়কও পানিতে ডুবে যায়। এমনকি যেসব রাস্তায় দু’চার বছরে পানি জমতে দেখা যায়নি সেসব রাস্তায়ও গতকাল পানিতে তলিয়ে যায়। এমন কোনো অলিগলি ছিল না যেখানে হাঁটুপানি জমেনি।
দুপুর ১২টার দিকে রায়েরবাজার স্কুল থেকে ধানমন্ডি ১৫ নম্বর পর্যন্ত রাস্তা ও এর আশপাশের রাস্তাগুলো দেখা যায় পানিতে টইটম্বুর। পুরো রাস্তাই যানবাহনে অবরুদ্ধ। ওয়াসার লাইন মেরামতের জন্য এই রাস্তা এবং আশপাশের রাস্তায় শত শত ছোট-বড় গর্ত করা হয়েছে। এই গর্তগুলো গতকাল ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে পথচারীদের জন্য। অনেক পথচারীকে এই গর্তের মধ্যে পড়ে আহত হতে দেখা যায়। ঝিগাতলার রাস্তাটিরও ওই একই রূপ। ঝিগাতলা থেকে সায়েন্স ল্যাবরেটরি পর্যন্ত কোনো পানি দেখা যায়নি। এলিফ্যান্ট রোডে আবার হাঁটুপানি। এখানে এসে দেখা যায় অন্তত ১০টি গাড়ি রাস্তার ওপর অকেজো হয়ে পড়ে আছে। রোড ডিভাইডারের পাশ দিয়ে কোনোমতে একটি করে গাড়ি চলছে। এতে পেছনে যানজট লেগে গেছে পুরো মিরপুর রোডে। নয়া পল্টনে দেখা যায় ভয়াবহ চিত্র। রাস্তার উভয়পাশে প্রায় কোমরপানি। পানির ভেতর দিয়ে চলতে গিয়ে বেশ কয়েকটি গাড়ি অকেজো হয়ে পড়ে আছে রাস্তার ওপরে। এই গাড়িগুলো সরিয়ে নেয়ারও কোনো উপায় নেই। এতে পুরো রাস্তায় তীব্র যানজট লেগে যায়। ফকিরাপুল, শাহজাহানপুর এলাকায় পানির কারণে কয়েক হাজার গাড়ি ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকে। পানি ঢুকে নষ্ট হয়ে যায় অসংখ্য সিএনজি আটোরিকশা ও প্রাইভেট কার। ঘুরে ফিরে গতকাল একই চিত্র দেখা যায় রাজধানীর সবখানে। কোনো কোনো এলাকার পথচারীরা বলেছেন, তাদের সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে রাস্তার খানাখন্দ এবং বড় বড় গর্ত। শহরের বেশ কিছু এলাকায় ওয়াসার লাইন সংস্কারের নামে রাস্তাঘাটে বড় বড় গর্ত করা হয়েছে। হঠাৎ বৃষ্টিতে এই গর্তগুলো পানিতে ভরে যায়। পথচারীরা না জেনে অনেকেই এই গর্তের মধ্যে পড়ে যায়। এমনকি কোনো কোনো গর্তে গাড়ির চাকাও আটকে যায়। মিরপুর পীরেরবাগ থেকে টেলিফোনে ভোগান্তির কথা জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক শিক্ষক। তিনি বলেন, মাত্র তিন মাস আগে এলাকার রাস্তাটি কার্পেটিং করা হয়েছে। কিন্তু এখন সেটি খুঁড়ে রেখেছে ওয়াসা। বৃষ্টির কারণে কাদাপানিতে একাকার।
এ দিকে প্রবল বৃষ্টির কারণে পানি জমে কোনো কোনো এলাকায় বাসাবাড়ির নিচতলায় পানি জমে যায়। মার্কেট ও দোকানপাটের ভেতরেও পানি ঢুকে পড়ে। গতকাল দুপুরের দিকে নয়াপল্টন গলিতে দেখা যায় বেশ কিছু দোকানপাট ও বাসাবাড়ির নিচ তলায় হাঁটুপানি জমে গেছে। দোকানিরা মালামাল ওপরে তুলে কোনোরকম ক্ষতির হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করছেন। শান্তিনগরের একাধিক ব্যবসায়ী বলেন, তাদের দোকানের মালামাল পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। এতে তারা হাজার হাজার টাকার ক্ষতির শিকার হয়েছেন। এমনকি কোনো কোনো এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও পানি ঢুকে যায়। এতে ভোগান্তিতে পড়েন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
বৃষ্টির কারণে গতকাল অধিকাংশ এলাকার দোকানপাট বন্ধ ছিল। বিশেষ করে ফুটপাথের কোনো দোকানই গতকাল খোলা দেখা যায়নি। দুপুরের দিকে বায়তুল মোকাররম এলাকার এক ব্যবসায়ী বলেন, সকালে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি উপেক্ষা করে দোকান খোলার জন্য এসেছিলেন। কিন্তু এসে দেখেন ভয়াবহ চিত্র। ভয়ে আর দোকান খোলার সাহস পাননি। পুরানাপল্টনের অলিগলি ঘুরে দেখা যায় এই এলাকার অধিকাংশ দোকানপাটই বন্ধ। দু-একটি দোকান খোলা থাকলেও ক্রেতা নেই। শান্তিনগরে দেখা যায় বৃষ্টির পানিতে ভেসে যাচ্ছে তরিতরকারী।
এ দিকে বৃষ্টির কারণে পানি জমে যাওয়ায় যানবাহন চলাচল প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। রাজধানীর এমন কোনো রাস্তা ছিল না যেটা গতকাল সচল ছিল। অলিগলিতেও ছিল তীব্র যানজট। অনেকেই এই ভোগান্তির কথা প্রকাশ করেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তারা যে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে যাবেন তারও কোনো উপায় ছিল না। এমনও এলাকা ছিল যেখানে গাড়ি থেকে নেমে ফুটপাথে উঠতে কোমরপানি। ভিজে যাওয়ার আশঙ্কায় কেউ গাড়ি থেকেও নামেননি। ফলে তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ির মধ্যেই বসে থাকতে হয়। হামিদ নামে এক পথচারী বলেন, মহাখালী থেকে প্রেস কাব পর্যন্ত আসতে তার সময় লেগেছে সাড়ে তিন ঘণ্টা। অনেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য বের হয়েও তা সম্পন্ন করতে পারেননি। বিকেলে অফিসফেরত মানুষকে পড়তে হয় ভয়াবহ ভোগান্তিতে।
এ দিকে বৃষ্টির কারণে গতকাল গণপরিবহন সঙ্কট তীব্র হয়ে ওঠে। দুপুরের দিকে শাহবাগ এলাকায় দেখা যায় শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন গাড়ির জন্য। কিন্তু গাড়িতে উঠতে পারছেন না। বেলা ৩টার দিকে মতিঝিল এলাকায় দেখা যায় কয়েক হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছেন। বৃষ্টির পানি থেকে রক্ষা পেতে আশপাশে কোথাও গিয়ে আশ্রয় নেবেন তারও সুযোগ নেই। নজরুল নামে এক পথচারী বলেন, প্রায় দুই ঘণ্টা এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু কোনো গাড়ি পাচ্ছেন না। দুপুরের পর বাস অফিসপাড়ায় আসতে না পারায় দেখা দেয় আরেক দফা পরিবহনসঙ্কট। শত শত ঘরমুখো মানুষকে বাসের আশায় রাস্তার ওপর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। অনেকের বাসায় ফিরতে গভীর রাত হয়ে যায়।
বৃষ্টির কারণে গতকাল পরিবহন ভাড়াও হঠাৎ বেড়ে যায়। বিশেষ করে রিকশা ও সিএনজি অটোরিকশার ভাড়া যেন আকাশ ছোঁয়। যে রিকশা ভাড়া স্বাভাবিক সময়ে ৩০ টাকা, গতকাল সেই ভাড়া হয় ১০০ টাকা। এই অতিরিক্ত ভাড়া গুনেও অনেকে রিকশা-অটোরিকশা পাননি।
জলাবদ্ধতা ও যানজট নিয়ে ভোগান্তিতে পড়া মানুষের মুখে মুখে ছিল সমালোচনা। তাদের অনেককেই বলতে শুনা গেছে নতুন দুই মেয়র নির্বাচনের আগে রাজধানীকে জল ও যানজটমুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি নয়, অবনতি হয়েছে। গতকাল গণপরিবহন ও ফেসবুকে ছিল এ নিয়ে ব্যাপক চর্চা।
বাংলাদেশ সময়: ১৬:০২:১২ ৩২৭ বার পঠিত