বঙ্গনিউজ ডটকমঃ ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সঙ্কটাপন্ন হিসেবে চিহ্নিত এলাকায় সেচের জন্য সেই পানি তোলা সীমিত করার পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। শুষ্ক মৌসুমে চাষাবাদের ৭৫ ভাগ পানি তুলতে হয় মাটির নিচ থেকে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ওপরের পানিতে টান পড়ছে। আর এতে ভূগর্ভের পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে। দেশের অনেক জায়গায় গ্রীষ্মকালে সাধারণ গভীরতায় টিউবওয়েল দিয়ে পানি উঠছে না। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় দেশের ৬১টি জেলার পানিতে আর্সেনিক পাওয়া গেছে।
এ পরিস্থিতিতে অবশেষে ভূগর্ভের ও ভূ-উপরিস্থ পানির সঙ্কটাপন্ন এলাকা চিহ্নিত করে সঙ্কট সমাধানের প্রয়োজনীয় গাইডলাইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার। বেশি সঙ্কটাপন্ন এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে বোরো ধানের সেচের জন্য ভূগর্ভের পানি উত্তোলন বন্ধ করে দেওয়া হবে। আগামী শুষ্ক মৌসুমেই সরকার এ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এজন্য পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা (ওয়ারপো) নেতৃত্বে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো কাজ করছে। এজন্য দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা হয়েছে এবং দুটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।
ওয়াপোর মহাপরিচালক আবদুর রব মিয়া এ বিষয়ে সকালের খবরকে জানান, দেশের দক্ষিণাঞ্চল ও বরেন্দ্র এলাকায় (রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চল) ভূগর্ভের পানির স্তর বেশি নিচে নেমে গেছে। আর ঢাকা শহরের পানির স্তর অনেক নিচে। এসব বিষয়ে ওয়ারপো ইতোমধ্যেই তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে। এখন এসব তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সঙ্কটাপন্ন এলাকার জন্য গাইডলাইন তৈরির কাজ চলছে। যাতে করে সঙ্কট মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় সুপারিশ থাকবে।
তিনি আরও জানান, দেশের পানি সঙ্কট এলাকার মধ্যে বরেন্দ্র এলাকার কিছু কিছু জায়গায় শুষ্ক মৌসুমে সেচের জন্য আমরা ভূগর্ভের পানি উত্তোলন বন্ধ করার
সুপারিশ করব। এসব এলাকায় গভীর নলকূপের পানি দিয়ে পানি সেচকাজ করা যাবে না। ভূ-উপরিস্থ পানি দিয়ে সেচকাজ করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।
আবদুুর রব মিয়া জানান, ভূ-উপরিস্থ পানি ও ভূগর্ভের পানির সঙ্কটাপন্ন এলাকার বিষয়ে গাইডলাইন প্রণয়ন করার পর পানি আইন অনুসারে তা বাস্তবায়ন করা হবে। একই সঙ্গে আমরা পানি আইন বাস্তবায়নের জন্যও বিধিমালা প্রণয়ন করছি। ঢাকা ওয়াসাসহ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভূগর্ভের পানির ব্যবহার কমানোর বিষয়টি বিশেষ সুপারিশ থাকবে গাইডলাইনে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই গাইডলাইন তৈরির কাজ শেষ হবে বলেও ওয়ারপোর মহাপরিচালক জানান।
১৯৯০-এর দশকে শুষ্ক মৌসুমে বোরো ধানের চাষ শুরু হয়। সময়ের ব্যবধানে বোরো ধান সারাদেশে ব্যাপকভাবে চাষাবাদ হচ্ছে। আর এই বোরো ধানের চাষের জন্য সেচের পানির অধিকাংশই মাটির নিচ থেকে উত্তোলন করা হয়। এতে বাড়তে থাকে ভূগর্ভের পানির ব্যবহার। আর এতেই ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নামতে থাকে। শুষ্ক মৌসুমে দেশের অনেক জায়গায় সাধারণ গভীরতার চেয়ে অনেক বেশি নিচে নেমে গেছে পানির স্তর। পানির সঙ্কটাপন্ন এলাকা চিহ্নিতকরণ ও গাইডলাইন প্রণয়ন করা ওয়ারপোর নেতৃত্বাধীন টাস্কফোর্স তাদের সুপারিশ জাতীয় পানিসম্পদ পরিষদের নির্বাহী কমিটির সদস্য সচিবের কাছে তুলে দেবেন। আর সদস্য সচিব সেই সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন।
জাতীয় পানিসম্পদ পরিষদের নির্বাহী কমিটির সদস্য পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত এ বিষয়ে সকালের খবরকে জানান, সরকার একটি ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে আমরা এ বিষয়ে বলে আসছি। বরেন্দ্র এলাকাসহ উত্তরের যেসব এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, সেসব এলাকায় সেচের জন্য পানি উত্তোলন বন্ধ করে দেওয়া দরকার। এসব এলাকায় বোরো ধান চাষ না করে, অন্য কোনো ফসল চাষ করা ভালো হবে, যাতে পানির ব্যবহার কম হবে। এছাড়া আমন ও আউশের চাষ তো হবেই। এতে ভূগর্ভের পানির সঙ্কট কমে যাবে।
আইনুন নিশাত আরও বলেন, দিন দিন ভূগর্ভের পানির চাহিদা বাড়ছে। এখন শুষ্ক মৌসুমে সেচ কাজের প্রায় ৭৫ ভাগ পানি মাটির নিচ থেকে উত্তোলন করা হয়। নতুন নতুন ডিব টিউবওয়েল (গভীর নলকূপ) এবং শ্যালো মেশিন (অগভীর নলকূপ) বসানো হচ্ছে। অনেক জায়গায় নতুন করে সেচের আওতায় এনে বোরো ধান লাগানো হচ্ছে। তাই পানি সঙ্কটাপন্ন এলাকায় সেচ কাজ বন্ধ বা কম সেচ দিয়ে চাষাবাদের ব্যবস্থা করাই ভালো।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরের ভূগর্ভের পানির স্তর বঙ্গোপসাগরের পানির গড় উচ্চতার তুলনায় ইতোমধ্যে ১৪০-১৬০ ফুট নিচে নেমে গেছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ‘দ্য প্রোগ্রাম অব ফোরকাস্টিং স্যালাইন ওয়াটার ইরিগেশন, ইরিগেশন ওয়াটার কোয়ালিটি অ্যান্ড ওয়াটার লগিং ইন সাউদার্ন এরিয়া’ প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত এই জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘যদি এখনই এ বিষয়ে সমন্বিত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়; এক সময় ঢাকা শহরের ভূগর্ভের ফাঁকা জায়গা লবণাক্ত পানিতে পূর্ণ হয়ে যাবে। ফলে ঢাকা শহরে বিশুদ্ধ খাবার পানির সঙ্কট আরও প্রকট হবে। পানযোগ্য সুপেয় পানির অভাবে শহরের জনজীবনে মারাত্মক অচলাবস্থা সৃষ্টি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘এর আগে ঢাকার উত্তরাঞ্চলসহ চারদিক থেকে ভূগর্ভের পানি এসে ঢাকার ভূ-অভ্যন্তরের ফাঁকা স্থান পূরণ করত। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে অপেক্ষাকৃত কম বৃষ্টিপাত, অপরিকল্পিতভাবে ভূগর্ভের পানি উত্তোলন এবং এর সঙ্গে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ধীরে ধীরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে লবণ-পানি দ্রুত গতিতে উত্তর দিকে প্রবাহিত হচ্ছে।’
২০১২ সালে তত্কালীন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম জাতীয় সংসদে জানান, ঢাকা মহানগরীর ভূ-গর্ভের পানির গড় অবস্থান ৫২ মিটার। ঢাকা মহানগরীতে প্রতিবছর এলাকাভেদে ভূগর্ভের পানির অবস্থান প্রায় ২-৩ মিটার নেমে যাচ্ছে। ঢাকা ওয়াসার পানি সরবরাহে ভূগর্ভের পানি ৮৭ ভাগ এবং ভূ-উপরিস্থ পানির ১৩ ভাগ।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক উম্মে কুলসুম নভেরা সকালের খবরকে জানান, সারাদেশের অনেক জায়গায় ভূগর্ভের পানির স্তরে নিচের দিকে নেমে গেছে। অনেক পরে হলেও সরকারের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। শুধু সঙ্কটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করলেই চলবে না। সরকার যে গাইডলাইন তৈরি করবে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা ধেয়ে আসছে। বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক।
বাংলাদেশ সময়: ১৩:৪৭:৩৫ ৬০৪ বার পঠিত