বঙ্গনিউজ ডটকমঃ
বিদ্যুৎ ও বাসাবাড়িতে ব্যবহূত গ্যাসের পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাসের (সিএনজি) দাম, যা আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হবে। আর এ সুযোগেই রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামে ভাড়া বাড়ানোর তৎপরতা শুরু করে দিয়েছেন গণপরিবহন মালিকরা। গত বৃহস্পতিবারই বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাছে বাস ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। পাশাপাশি সিএনজিচালিত অটোরিকশার বর্ধিত ভাড়াও চূড়ান্ত করা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি (বিইআরসি) বিদ্যুতের পাশাপাশি প্রতি ঘনমিটার সিএনজির দাম ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৫ টাকা করার ঘোষণা দেয়। সে হিসাবে সিএনজির দাম বাড়ছে ১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। সিএনজির দাম বাড়ানোর অজুহাতে অটোরিকশার ভাড়া ৬০ শতাংশ ও বাস-মিনিবাসের ভাড়া ২৫ শতাংশ বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে।
বর্ধিত হিসাবে, ঢাকা ও চট্টগ্রামে কিলোমিটারপ্রতি বাস ভাড়া পড়বে ২ টাকা, আর মিনিবাসে তা ১ টাকা ৮৮ পয়সা। বাস মালিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শিগগিরই ব্যয় বিশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভাড়ার এ হার চূড়ান্ত করা হবে। বর্তমানে প্রতি কিলোমিটার বাসে ১ টাকা ৬০ পয়সা ও মিনিবাসে ১ টাকা ৫০ পয়সা ভাড়া ধার্য রয়েছে। সর্বশেষ ২০১১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর এ ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। যদিও সরকার নির্ধারিত ভাড়া মানে না বিভিন্ন বাস কোম্পানি। এ নিয়ে প্রায়ই যাত্রীদের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের বচসাও হয় নিয়মিত। তবে ন্যূনতম ভাড়া মিনিবাসে ৫ টাকা ও বাসে ৭ টাকা অপরিবর্তিতই থাকছে।
সিএনজির অটোরিকশার ভাড়া ৬০ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য এরই মধ্যে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে পাঠিয়েছে বিআরটিএ। এ হিসাবে অটোরিকশার ভাড়া প্রথম দুই কিলোমিটার হবে ৪০ টাকা। পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারে ১২ টাকা ও ওয়েটিংয়ের (যাত্রাবিরতি, সিগনাল ও যানজট) জন্য ২ টাকা মিনিট আদায় করা হবে।
বর্তমানে প্রথম দুই কিলোমিটারের ভাড়া ২৫ টাকা, পরবর্তী প্রতি কিলোমিটার ৭ টাকা ৬৪ পয়সা ও ওয়েটিং চার্জ ১ টাকা ৪০ পয়সা নির্ধারিত রয়েছে। যদিও সরকার নির্ধারিত এ ভাড়া মানে না কোনো অটোরিকশার চালকই। বরং তারা মিটারের পরিবর্তে চুক্তিতে যাতায়াত করেন। ভাড়ার পাশাপাশি মালিকদের জমা ৬০০ টাকার পরিবর্তে ৮৫০ টাকার প্রস্তাবও করেছে বিআরটিএ।
এ প্রসঙ্গে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বলেন, ব্যয় বিশ্লেষণ করেই অটোরিকশার ভাড়া ৬০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তা অনুমোদনে প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আর মালিক সমিতির প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যয় বিশ্লেষণ করে বাস ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এক্ষেত্রে সব বিষয়ই বিবেচনা করা হবে।
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবারের ঘোষণার আগে ২০১১ সালে দুই দফায় ১৩ টাকা ২৫ পয়সা বাড়ানো হয় সিএনজির দাম। সে সময় দুই দফায় ঢাকা ও চট্টগ্রামে বাস ও অটোরিকশার ভাড়াও বাড়ানো হয়।
সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির প্রস্তাবে বলা হয়, ২০১১ সালে ১৯ সেপ্টেম্বরে সর্বশেষ ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাস ভাড়া বাড়ানো হয়। প্রতি ঘনমিটার সিএনজির দাম ৫ টাকা বাড়লেও অন্যান্য সামগ্রীর দাম সে সময় কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। তবে কোনো ধরনের ব্যয় বিশ্লেষণ না করে কিলোমিটারপ্রতি ৫ পয়সা ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় বিআরটিএ। এতে পরিবহন মালিকদের বড় ধরনের লোকসানের সম্মুখীন হতে হয়। বন্ধও হয়ে যায় বেশ কয়েকটি বাস কোম্পানি। সরকার আবারো সিএনজির দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। এতে পরিবহন কোম্পানিগুলোর লোকসান আরো বাড়বে। ফলে দ্রুত ঢাকা ও চট্টগ্রামে চলাচলকারী বাস-মিনিবাসের ভাড়া বাড়ানো দরকার।
এ প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, চার বছর ধরে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ভাড়া বাড়ছে না। এর মধ্যে সব ধরনের খুচরা যন্ত্রাংশের দাম বেড়ে গেছে। বাসের দামও বেড়েছে। তাই হঠাৎ সিএনজির দাম বাড়ানোয় পরিবহন মালিকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এক্ষেত্রে ভাড়া বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।
ব্যয় বিশ্লেষণ যুক্তিতে বলা হয়, রাজধানীতে চলাচলকারী বেশির ভাগ বাসের গড় মূল্য ৪০ লাখ টাকা। ব্যাংকঋণে বাস কেনায় বাড়তি রয়েছে ১২ লাখ টাকা সুদ। ফলে বাসের দাম পড়ছে ৫২ লাখ টাকা। এছাড়া বছরে ব্যাটারি, টায়ার, সিলিন্ডার, কম্প্রেসার, খুচরা যন্ত্রাংশের দাম বৃদ্ধিসহ ১৬ ধরনের পরিচালন ব্যয় সবই বেড়েছে।
এদিকে বাস ভাড়ার ব্যয় বিশ্লেষণে বিবেচিত বেশির ভাগ উপাদানই সঠিক নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, রাজধানীতে চলাচলকারী বেশির ভাগ বাসই লক্কড়-ঝক্কড় ধরনের। এগুলোর দাম কোনোভাবেই ৪০ লাখ টাকা হতে পারে না। বেশির ভাগ বাসই ১০-১৫ বছরের পুরনো। তাই এগুলোর ঋণের সুদের প্রশ্নও আসে না। আর বাসের সিলিন্ডার, কম্প্রেসারও নিয়মিত পরিবর্তন করা হয় না। এতে কয়েকটি দুর্ঘটনাও ঘটেছে। তাই এ-সংশ্লিষ্ট ব্যয়েরও কোনো ভিত্তি নেই।
অটোরিকশার ভাড়া বাড়ানোর ব্যয় বিশ্লেষণ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সর্বশেষ অটোরিকশার ভাড়া বৃদ্ধি করা হয় ২০১১ সালে। সে সময় একটি অটোরিকশার স্যালভেজ ভ্যালু বা মেয়াদ শেষের মূল্য ধরা হয়েছিল ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু এবার অটোরিকশার মূল্য ধরা হয়েছে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা। যদিও অধিকাংশ অটোরিকশার মেয়াদ এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে। মেয়াদোত্তীর্ণ অটোরিকশার মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা। এভাবে অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে অটোরিকশার ভাড়া ও জমা দুই-ই বেড়ে যাচ্ছে।
অটোরিকশার মূল্যের সঙ্গে সুদ যোগ করা হয়েছে ৪৬ হাজার টাকা। যেখানে মালিকের বিনিয়োগ নেই, সেখানে কীভাবে ব্যাংকঋণের সুদ যুক্ত হয়, তার ব্যাখ্যা নেই। নিবন্ধন, রুট পারমিট, রোড ট্যাক্স ও ইন্স্যুরেন্স বাবদ খরচ ধরা হয়েছে ১৩ হাজার টাকা। কিন্তু পুরনো অটোরিকশার কীভাবে নিবন্ধন খরচ হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এছাড়া দুর্ঘটনা ও আপত্কালীন কারণে আকস্মিক খরচ হিসাবে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪০ হাজার টাকা, যার কোনো ভিত্তি নেই।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সিএনজির দাম বাড়ানো হয়েছে প্রতি ঘনমিটারে মাত্র ৫ টাকা। এক্ষেত্রে আনুপাতিক প্রভাব বিবেচনা করা জরুরি। প্রকৃতপক্ষে পরিবহন খাতে এর প্রভাব খুব বেশি পড়ার কথা নয়। এছাড়া সরকার নির্ধারিত ভাড়া বাস বা অটোরিকশায় এমনিতেই মানা হয় না। এর মধ্যে নতুন করে ভাড়া বাড়ানো হলে এ খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। সাধারণ যাত্রীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই বিআরটিএর উচিত, সব ধরনের ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা।
বাংলাদেশ সময়: ১২:২০:৪১ ৬৬৮ বার পঠিত