বঙ্গনিউজ ডটকমঃ খুব সকালেই কলম্বোর পি. সারা ওভাল স্টেডিয়ামে উপস্থিত কুমার সাঙ্গাকারার পুরো পরিবার- স্ত্রী ইয়েহেলি, ছেলে কেভিথ, মেয়ে সিড়ি এবং মা-বাবা, ভাই-বোন ও পরিবারের অন্যান্য সদস্য। গ্যালারিতে কানায় কানায় ভর্তি দর্শক। শ্রীলঙ্কা হারবে নাকি জিতবে- এ নিয়ে যেন কারও আগ্রহ নেই। শেষ দিনে জয়-পরাজয়ের চেয়েও বড় হয়ে উঠেছিল ক্রিকেট কিংবদন্তি সাঙ্গাকারার বিদায়।সত্যি, টেস্ট ক্রিকেটে কখনো কখনো এমন কিছু মুহূর্ত আসে যখন ম্যাচের ফলাফল ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে ‘ব্যক্তি’। গতকাল ‘ব্যক্তি’ সাঙ্গাকারার বিদায়ী মুহূর্তটাকে হৃদয়ের ফ্রেমে বন্দী করে রাখতেই পি. সারা ওভালে পরিবার এবং হাজারও লঙ্কান দর্শক উপস্থিত হয়েছিলেন।
শেষ দিনে সাঙ্গাকারাকে মাঠে নামতে হয়নি। আগের দিনই আউট হয়ে গিয়েছিলেন। শ্রীলঙ্কাও গতকাল ভারতের কাছে হেরে যায় ২৭৮ রানের বিশাল ব্যবধানে। তবে এ নিয়ে কারও বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল না। ভারতের বড় ব্যবধানের জয়টাকে মনে হচ্ছিল যেন স্বাদ-গন্ধহীন! ভারতীয় ক্রিকেটারদের মধ্যে কোনো উচ্ছ্বাসও ছিল না। তবে লঙ্কান ক্রিকেটাররা ঠিকই বেদনায় নীল হয়ে গিয়েছিলেন। সেটা যে ম্যাচে হারার যন্ত্রণায় নয়, তা সবারই জানা! প্রিয় সতীর্থ, প্রিয় বন্ধু, প্রিয় তারকার বিদায়ে যেন লঙ্কান ক্রিকেটারদের বুক এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাচ্ছিল। কেউ কারও দিকে তাকাতে পারছিলেন না।
ম্যাচ শেষে ধাম্মিকা প্রসাদ ও বিশ্ব ফার্নান্দো সাঙ্গাকারাকে কাঁধে তুলে নেন। দুই সতীর্থের কাঁদে চড়ে যখন গ্যালারির দিকে তাকিয়ে দর্শকের উদ্দেশ্যে সাঙ্গাকারা হাত নাড়ছিলেন তখন তার চোখ থেকে টপ টপ করে পড়ছিল জল। অশ্রুসিক্ত সাঙ্গাকারাকে দেখে গ্যালারিতেও কান্নার রোল পড়ে যায়। ভক্তদের কেউ কেউ একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। কাঁদছিলেন সতীর্থরাও। সত্যিই সে এক বেদনাদায়ক পরিস্থিতি!
ড্রেসিংরুমে এক পরম বন্ধুকে, এক গুরুকে আর দেখা যাবে না-হয়তো এমন কথা মনে হতেই কান্না আটকে রাখতে পারেননি সতীর্থরা। সত্যিই তো সাঙ্গাকারা ড্রেসিং রুমে শুধু নিছক খেলোয়াড় নন, কোচের দায়িত্বও পালন করতেন! তরুণ ক্রিকেটারদের কাছে সাঙ্গা ছিলেন প্রেরণার উৎস। তাই গ্রেট এই ক্রিকেটারের বিদায়ে শ্রীলঙ্কা একজন কোচকেও হারাল!
বিদায়ী বক্তব্য দিতে গিয়ে যেন আরও বেশি আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিলেন সাঙ্গাকারা। ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম এই মহানায়ক বাবা-মার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘আমার বাবা-মা পৃথিবীর সেরা বাবা-মা। এমন বাবা-মা কারও থাকলে তার আর অনুপ্রেরণা পেতে কারও কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।’
সাঙ্গাকারার অর্জনের ঝুলিটা রেকর্ডে রঙিন। তিনি যেমন ক্রিকেটকে সমৃদ্ধ করতে একাগ্রভাবে পরিশ্রম করেছেন, তেমনি ক্রিকেটও তাকে দিয়েছে দুহাত ভরে। ঘরের মাঠে টি-২০ বিশ্বকাপ জয়, টেস্টে ও ওয়ানডেতে হাজারও রান আরও কতো কী! তবে এসব সাঙ্গাকারার কাছে পরিসংখ্যানের খেরো খাতা ছাড়া আর কিছুই নয়। নিজের সেরা অর্জন হিসেবে সাঙ্গা অভিহিত করেছেন মানুষের ভালোবাসাকে। তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বকাপ জিতেছি, অনেক সেঞ্চুরি করেছি। তবে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন হচ্ছে মানুষের ভালোবাসা। সেটা এখানে আসা হাজার হাজার মানুষকে দেখেই বুঝতে পারছি।’
সব শেষে সাঙ্গা তার বক্তৃতায় সতীর্থদের বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। পনেরো বছরের ক্যারিয়ারে তিনি যা অর্জন করেছেন, সবই হচ্ছে পরিশ্রমের ফল। ব্যর্থতা আসবেই, তা নিয়ে চিন্তা না করে ক্রিকেট উপভোগ করার কথা বলেছেন। তবে সাঙ্গা সবচেয়ে বেশি জোর দিয়ে বলেন, ‘শ্রীলঙ্কার পতাকাটাকে সব সময় ঊর্ধ্বে তুলে রাখতে হবে।’
সাঙ্গার বিদায়ক্ষণে উপস্থিত থেকে ইতিহাসের সাক্ষী হতে গতকাল পি. সারা ওভালে গিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা, প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে, সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দ রাজা পাকসে। আর লঙ্কান কিংবদন্তির বিদায়ী মুহূর্ত দেখতে টিভির সামনে উপস্থিত ছিলেন হয়তো তার কোটি ভক্ত। মাঠের দর্শকের মতো হয়তো তারাও কেঁদেছেন। এমন এক গ্রেট ক্রিকেটারের বিদায়ে ভক্তদের চোখের জল কি আর বাঁধ মানে!
বাংলাদেশ সময়: ১৭:৫৪:৫৪ ২৫৫ বার পঠিত