ফিকি-র সভায় অরুন্ধতী ভট্টাচার্য। শুক্রবার। ছবি: পিটিআই।
বঙ্গনিউজ ডটকমঃ শুধু প্রস্তাব আর পরিকল্পনায় চিঁড়ে ভেজেনি। বরং মারকাটারি প্রতিযোগিতার সম্ভাবনাই দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তে আরও বেশি করে ঠেলে পাঠাচ্ছে ব্যাঙ্কগুলিকে। আর তার জন্য খরচ কমাতে প্রযুক্তিকেই হাতিয়ার করছে তারা।
শুক্রবার কলকাতায় বণিকসভা ফিকি-র ব্যাঙ্কিং কনক্লেভে স্টেট ব্যাঙ্কের কর্ণধার অরুন্ধতী ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘পেমেন্টস ব্যাঙ্কের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রত্যন্ত প্রান্তের মানুষের দরজায় ব্যাঙ্কিং পরিষেবা পৌঁছে দিতে কম খরচের ব্যবসা-কৌশল তৈরি করছি আমরা।’’ তিনি মেনে নিচ্ছেন, খরচ কম হওয়ায় অজ গাঁয়ে পৌঁছে যাওয়া হয়তো তুলনায় সহজ হবে পেমেন্টস ব্যাঙ্কের পক্ষে। কিন্তু সেই বাজার দখলের লড়াইয়ে স্টেট ব্যাঙ্কের মতো দৈত্যও যে এক ইঞ্চি জমি ছাড়তে রাজি নয়, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি। জানিয়েছেন, দ্রুত আরও বেশি করে ওই বাজারে পৌঁছে যাওয়ার কথা।
অরুন্ধতীদেবী বলেন, প্রত্যন্ত এলাকায় পরিষেবা দিতে আরও বেশি বিজনেস করেসপন্ডেন্ট নিয়োগ করবে এসবিআই। তিনি জানান, ব্যাঙ্ক নেই এমন এলাকায় পরিষেবা দিতে কাস্টমার সার্ভিস পয়েন্ট (সিএসপি) খুলছেন তাঁরা। ব্যবহার করছেন উন্নত প্রযুক্তি। এ জন্য রাজারহাটে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও চালু করা হচ্ছে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রকে তিনি বলেন, এ রাজ্যেই ৫০০টি গ্রাম পঞ্চায়েতে সিএসপি খোলা হবে। সম্প্রতি মোবাইল ওয়ালেট-ও চালু করেছে এসবিআই।
এমনটা একেবারেই নয় যে, এখনও পর্যন্ত গ্রামের বাজারে স্টেট ব্যাঙ্ক আনকোরা। বরং সেই অর্থে ছোট শহর ও গ্রামে এখনও পর্যন্ত উপস্থিতি বেশি তাদেরই। কিন্তু তা সত্ত্বেও গ্রামের দরজায় আরও জোরে কড়া নাড়তে যে মরিয়া সুর অরুন্ধতীদেবীর গলায় ফুটে উঠেছে, তাতে আশার আলো দেখছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। কারণ, একই ভাবে পেমেন্টস ব্যাঙ্কের হাত ধরে গ্রামের বাজার কব্জা করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে এত দিন এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলি। তাই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শেষ পর্যন্ত তীব্র প্রতিযোগিতার দাওয়াইয়েই দ্রুত গ্রামমুখী হবে ব্যাঙ্ক। ব্যাঙ্কিং পরিষেবা পৌঁছবে সকলের দরজাতে। এত দিন সব অর্থমন্ত্রী প্রায় নিয়ম করে যে পরিকল্পনার কথা বারবার বললেও কাজ তেমন হয়নি।
আসলে অনেকেই মনে করছেন, ভারতের আর্থিক ক্ষেত্রের ছবি বদলে যাচ্ছে দ্রুত। ঠিক যে ভাবে গত এক-দেড় দশকে আমূল বদলেছে টেলিকম শিল্প। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের পাশাপাশি আজ অনেক দিনই মাথা তুলেছে একগুচ্ছ বিদেশি আর বেসরকারি ব্যাঙ্ক। কিন্তু তাতেও গ্রামে ব্যাঙ্কিং পরিষেবা না-থাকার ছবি তেমন বদলায়নি। অথচ হঠাৎই যেন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে সেই প্রেক্ষাপট বদলানোর। যার পিছনে রয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের একগুচ্ছ ঘোষণা।
শীর্ষ ব্যাঙ্কের ঘর থেকে লাইসেন্স পেয়ে আগামী রবিবার থেকে পরিষেবা চালু করতে চলেছে বন্ধন ব্যাঙ্ক। নিজেদের ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবসার ইতিহাসের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে গ্রামের বাজার ধরার বিষয়ে গোড়া থেকেই আত্মবিশ্বাসী তারা। তার উপর ১১টি পেমেন্টস ব্যাঙ্ক গড়ার অনুমতি আরও অনেক হিসেব উলট-পালট করে দেবে বলে মনে করছেন অনেকে।
গত ১৯ অগস্ট পেমেন্টস ব্যাঙ্ক খুলতে এগারো আবেদনকারীকে নীতিগত ভাবে অনুমোদন দিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। এর মধ্যে ডাক বিভাগের মতো সরকারি সংস্থা যেমন রয়েছে, তেমনই আছে রিলায়্যান্সের মতো প্রথম সারির কর্পোরেট। তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে ভোডাফোন এম-পেসা, এয়ারটেল এম কমার্স, টেক মহীন্দ্রার মতো প্রযুক্তি-নির্ভর সংস্থা। শুধু তা-ই নয়, এই ১১ সংস্থার কাজকর্ম দেখে আগামী দিনে আরও পেমেন্টস ব্যাঙ্ক গড়ার অনুমতি দেওয়া হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে শীর্ষ ব্যাঙ্ক। বিশেষ ধরনের ছোট ব্যাঙ্কের (স্মল ফিনান্স ব্যাঙ্ক) লাইসেন্সও দেওয়া হবে আগামী মাসে। এবং এই ভরা প্রতিযোগিতার বাজারে দেশের বৃহত্তম ব্যাঙ্কও যে প্রত্যন্ত গ্রামের জমি হারাতে রাজি নয়, তা পরিষ্কার স্টেট ব্যাঙ্কের পদক্ষেপে। রিলায়্যান্স গোষ্ঠীর প্রস্তাবিত পেমেন্টস ব্যাঙ্কে ৩০ শতাংশ অংশীদারি তাদের। একই ভাবে গাঁটছড়া বাঁধবে আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ক, কোটক মহীন্দ্রা ব্যাঙ্ক-সহ অন্যান্যরাও।
গোড়া থেকেই বলা হয়েছে যে, পেমেন্টস ব্যাঙ্ক তৈরির মূল লক্ষ্য হল ব্যাঙ্কিং পরিষেবা প্রত্যন্ত প্রান্তেও সকলের দরজায় পৌঁছে দেওয়া। যাতে সেখানে অন্তত ছোট অঙ্কের আমানত (এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত) জমা করা যায়। এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় টাকা পাঠাতে পারেন সাধারণ মানুষ। বিশেষত ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্য শহর বা ভিন্ রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকরা।
শুধু তা-ই নয়। পেমেন্টস ব্যাঙ্ক মারফত অনলাইনে কর দেওয়া থেকে শুরু করে ই-কমার্সের লেনদেনে টাকা মেটানোর পরিষেবা মিলবে। পেনশন বা ভর্তুকির টাকা সরাসরি অ্যাকাউন্টে পেতেও তা গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হতে পারে। পুরোদস্তুর বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের সঙ্গে তাদের মূল ফারাক ধার দেওয়ার এক্তিয়ার না-থাকা। কিন্তু তাতে আত্মতুষ্টির কারণ নেই বলে মনে করেন স্টেট ব্যাঙ্কের চেয়ারপার্সন।
বিশেষজ্ঞদের বড় অংশ, এমনকী খোদ অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিও মনে করেন, দেশে ব্যাঙ্কিং পরিষেবায় বিপ্লবের সূচনা হবে পেমেন্টস ব্যাঙ্কের হাত ধরে। যার প্রধান হাতিয়ার হবে প্রযুক্তি। কারণ, এই সমস্ত পেমেন্টস ব্যাঙ্ক বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের মতো বড় শাখা খুলে যত না ব্যবসা করবে, তার থেকে অনেক বেশি আঁকড়ে ধরবে ইন্টারনেটকে। বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়বে। আবার অন্য দিকে, খুলে যাবে নিত্য-নতুন উদ্ভাবনী চিন্তার দিগন্ত। বিশেষত এক লাফে খরচ কমে যাবে অনেকখানি। দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তে পৌঁছনোর পথে এত দিন যা মূল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হয়তো সেই কারণেই এ দিন বেঙ্গালুরুতে ইনফোসিসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নন্দন নিলেকানি বলেছেন, হোয়াটস্ অ্যাপ যে ভাবে নেট দুনিয়ার ছবি এক ঝটকায় অনেকখানি বদলে দিয়েছে, তেমনই দেশের ব্যাঙ্কিং পরিষেবাকেও পাল্টে দেবে পেমেন্টস ব্যাঙ্কের প্রযুক্তি নির্ভর পরিষেবা।
গ্রামের মানুষের হাতে আমানতে টাকা জমা দেওয়ার মতো অর্থ আছে। আছে টাকা এক জায়গা থেকে অন্যত্র পাঠানোর চাহিদা। মাথাপিছু অঙ্ক ছোট হলেও, সব মিলিয়ে এই বাজার নেহাত মন্দ নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এখন প্রতিযোগিতা ঘাড়ে এসে পড়ায় সেই আকর্ষণীয় বাজার ধরতে মরিয়া হয়ে ঝাঁপাচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি।
বাংলাদেশ সময়: ১৫:০৭:৪৪ ৩০৪ বার পঠিত