বঙ্গনিউজ ডটকমঃ রাজধানীসহ সারাদেশে অবাধে ঢুকছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে পৌঁছে যাচ্ছে শীর্ষ সন্ত্রাসী থেকে অলিগলির পাতি মাস্তানদের হাতেও। সীমান্তের অর্ধশতাধিক পয়েন্ট দিয়ে এসব অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র দেশে প্রবেশ করছে। এই পয়েন্টগুলো চিহ্নিত করা হলেও তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ফলে খুন, ছিনতাই, ডাকাতিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডের মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে।
জানা গেছে, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আসা অবৈধ অস্ত্রগুলোর বেশিরভাগই আসছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, যশোর, সাতক্ষীরা, কুমিল্লা, আখাউড়া, টেকনাফ ও বান্দরবান সীমান্ত দিয়ে। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে বিভিন্ন জেলা শহর হয়ে রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ডে মজুদ হচ্ছে। সেখান থেকে পৌঁছে যাচ্ছে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পালিত বিভিন্ন সন্ত্রাসী ও পাড়া-মহল্লার পাতি মাস্তানদের হাতে।
সূত্র জানায়, দুইভাবে এই আগ্নেয়াস্ত্রগুলো নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। বিদেশ থেকে একটি গ্রুপ এবং দেশের আন্ডারওয়ার্ল্ডে ফেরারি সন্ত্রাসীদের একটি গ্রুপ এই অবৈধ অস্ত্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ করছে। দেশের বাইরে অবস্থানরত নিয়ন্ত্রকরা সিগন্যাল দিলেই ভাড়ায় আগ্নেয়াস্ত্রের সাময়িক হাতবদল হয়। অবৈধ এই অস্ত্র বেশিরভাগই চলে যাচ্ছে উঠতি বয়সের মাস্তানদের হাতে। ফলে প্রতিনিয়ত খুন, ছিনতাই ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকা- ঘটছে। এসব অস্ত্র প্রকাশ্যে যথেষ্ট ব্যবহারের ফলে আতঙ্ক বিরাজ করছে জনমনে।
সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অবৈধভাবে অস্ত্র ঢোকার কথা স্বীকার করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, ‘সীমান্ত খুবই বড়। আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। তাই হয়তো ছোট অস্ত্র আসে। আমাদের অভিযানে মাঝেমধ্যে অস্ত্র ধরাও পড়ছে। তবে বড় কোনো অস্ত্র আসছে না। আমার সন্দেহ, ফল ও পেঁয়াজসহ নানা আমদানি পণ্যের মধ্যে লুকিয়ে অস্ত্র পাঠাচ্ছে অপরাধীরা। অস্ত্র পাচার উভয় দেশের জন্যই সমস্যা।’ গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সাধ্যমতো ও আন্তরিকতার সঙ্গে অস্ত্র চোরাচালান রোধে কাজ করে যাচ্ছি। এজন্য ভারতের বিএসএফের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদানের বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।’
এদিকে হত্যা, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, হুমকি, ভীতি প্রদর্শনসহ নানা রকম অপরাধমূলক ঘটনায় বাড়ছে ক্ষুদ্রাস্ত্রের ব্যবহার। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহেই নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম ও নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীর দেওটিতে যুবলীগ নেতা মিলন সরকারকে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। একই সময়ে কলাবাগানে কলেজছাত্র সজীব আহমেদ ও নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় গাড়িচালক মাসুদ শেখ ছিনতাইকারীর গুলিতে আহত হন। এর আগে ২৩ জুলাই মাগুরায় যুবলীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয় মায়ের গর্ভে থাকা শিশু। মাগুরার ঘটনায় অন্তঃসত্ত্বা গুলিবিদ্ধ গৃহবধূর চাচাশ্বশুর মমিন ভূঁইয়া গুলিতে নিহত হন। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, সীমান্তের অরক্ষিত অংশের অর্ধশতাধিকের বেশি পয়েন্ট দিয়ে ঢুকছে অবৈধ অস্ত্রের চালান। কয়েক দফা হাতবদল হয়ে তা পৌঁছে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা অস্ত্র ব্যবসায়ী ও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কাছে। কখনও পণ্যবাহী ট্রাকে, কখনও যাত্রীবাহী বাসে নানা কৌশলে লুকিয়ে এসব অস্ত্র প্রবেশ করছে রাজধানীতে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় উদ্ধার হচ্ছে কিছু অস্ত্র। তবে বিপুলসংখ্যক আগ্নেয়াস্ত্র এবং এসবের মূল কারবারিরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
তথ্য অনুযায়ী, গত দেড় বছরে (জুন পর্যন্ত) পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট তিন হাজার ৬২৯টি এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ২৭৮টি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে। গোয়েন্দাদের মতে, এই সংখ্যা চোরাচালান হয়ে আসা অস্ত্রের ভগ্নাংশ মাত্র। অবশ্য দেশে কী পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র রয়েছে সে ব্যাপারে কোনো সংস্থাই সঠিক তথ্য জানাতে পারেনি।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান ভোরের পাতাকে বলেন, ‘ছিনতাই, চাঁদাবাজি, হত্যাসহ সংঘবদ্ধ নানা অপরাধে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার হয়। এজন্য র্যাব গুরুত্ব দিয়ে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে ৪৬০টি অস্ত্র ও সাত হাজার ৩৯৫ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। পাশাপাশি সীমান্তের যেসব পয়েন্ট দিয়ে অস্ত্র চোরাচালান হয় সেদিকে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।’
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন ভোরের পাতাকে বলেন, ‘দেশে ব্যবহৃত অবৈধ অস্ত্রের ৮০ ভাগই আসে সীমান্ত পথে। এ নিয়ে দীর্ঘদিন অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি অস্ত্র আসে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, যশোর, খুলনা ও জয়পুরহাট সীমান্ত দিয়ে। সীমান্তেই সাধারণত অস্ত্র হাতবদল হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে অস্ত্র বিক্রি করে এমন অন্তত ১৫ ব্যবসায়ীকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের কেউ গ্রেফতার বা কেউ রয়েছে নজরদারির মধ্যে। এখন সীমান্তের ওপারে ভারতীয় অংশ থেকে যারা অস্ত্র সরবরাহ করছে, তাদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। এ ব্যাপারে সে দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তা নেওয়া হবে।’
গোয়েন্দারা আরও জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসী রনির সহযোগী মিথু মগবাজারের ১২টি এলাকায় অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ করে। অস্ত্র চালানের বড় অংশটি যাচ্ছে পুরান ঢাকার কোতোয়ালি থানার দেবাশীষ গ্রুপের কাছে। এছাড়া রাহমান গ্রুপ, বোমা কামাল গ্রুপ, গোল তাইজু গ্রুপ, সাইমন গ্রুপ, লম্বা তাইজু গ্রুপ, জুবায়ের গ্রুপের কাছে এসব অবৈধ অস্ত্রের মজুদ রয়েছে। বিভিন্ন ছিনতাই, ডাকাতি, হত্যা মামলা রয়েছে এই গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে শীর্ষ সন্ত্রাসী কামাল চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র চোরাচালান আনছে। একইসঙ্গে সন্ত্রাসী শাহিন, রশিদ, দাল্লাস একই সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র আনছে। অন্যদিকে সন্ত্রাসী নাসির, ঝুমু ও শামীম যশোর সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অস্ত্রের চালান আনছে।
একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ৪৮ থেকে ৬০টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অবৈধ অস্ত্রের চালান আসছে। পেশাদার অস্ত্র ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ভারতে পালিয়ে থাকা বাংলাদেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীরা এ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। তারা দেশে অবস্থানরত সহযোগীদের কাছে ফরমায়েশের মতো অস্ত্রের চালান পাঠাচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন বস্তি ও এলাকায় বেচাকেনা হচ্ছে এসব। সুসজ্জিত ফ্ল্যাটেও অস্ত্র-গুলি বিক্রির ঘটনার কথা জানা গেছে।
ডিবি পুলিশের এক সহকারী কমিশনার জানান, অবৈধ অস্ত্রের মধ্যে ক্ষুদ্রাস্ত্র, অর্থাৎ রিভলবার বা পিস্তলের চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। একে-৪৭ রাইফেলের চাহিদাও রয়েছে আন্ডারওয়ার্ল্ডে। বড় অপরাধীরা প্রত্যেকেই একাধিক ক্ষুদ্রাস্ত্র কিনে নিজের ও বাহিনীর সদস্যদের কাছে রাখে। উঠতি সন্ত্রাসীরা অপরাধ সংঘটনের সময় তাদের কাছ থেকে অস্ত্র ভাড়া নেয়।
পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে সারাদেশে দুই হাজার ৩২৮টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে উদ্ধার হয়েছে এক হাজার ৩০১টি। অন্যদিকে র্যাব জানায়, চলতি বছরে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় তারা ৩৫২ জনকে গ্রেফতার করেছে। গত বছর ৬৩৭টি অস্ত্র উদ্ধার ও ৫০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
গত জুন-জুলাই মাসে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হঠাৎ করেই বেড়ে যায়। এর মধ্যে গত ১৪ জুলাই মাতুয়াইলে ব্যবসায়ী মজিবুর রহমান, ২৬ জুন কলাবাগানে মন্ত্রী নুুরুল ইসলাম বিএসসির ভাগ্নে ওবায়দুল হক, ১১ জুন মিরপুর-১১ নম্বরে জাহিদুল ইসলাম রাসেল ও ৭ জুন জুরাইনে মোহাম্মদ ইব্রাহিমকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৬:২১:১১ ২৮৪ বার পঠিত