বঙ্গনিউজ ডটকমঃ ঘটা করে অভিযান চালানো হলেও রাস্তায় বন্ধ হয়নি ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল। ঠিক হয়নি গাড়ির ফিটনেসও। কিছু কিছু গাড়ি আবার রং পাল্টে ফিটনেস ফিরে পেয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন-এমন অস্থায়ী অভিযান চালিয়ে অতীতেও ভোগান্তি বৃদ্ধি ছাড়া কাজের কাজ কিছু হয়নি,এবারও হবে না। দীর্ঘ মেয়াদী অভিযান ও আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগাতে হবে বলে মনে করেন তারা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত মঙ্গলবার থেকে ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর প্রথম দু’দিন মূলত অভিযান এড়াতে রাস্তায় নামেনি অধিকাংশ গাড়ি। এদের ঠিকানা ছিল গ্যারেজ কিংবা পাম্প। কিন্তু গতকাল থেকে আবার স্বরূপে নগরীর রাস্তায় দেখা যাচ্ছে এসব গাড়ি। সরেজমিন দেখা যায়, লক্কড়-ঝক্কড় গাড়িগুলোর চলাচলও অভিযানের পর বন্ধ হয়নি। অনায়াসে এগুলো নগরী ও আশে পাশের এলাকায় চলাচল করছে। গত পাঁচ বছরে ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে তিনটি অভিযান পরিচালনা করে সরকার। তবে খুব বেশি ফল হয়নি। সর্বশেষ গত বছরের ১০ নভেম্বর ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে বিআরটিএ। আগের অভিযানগুলোর মতো সরবে শুরু হলেও শেষ হয় নীরবে। অভিযান শুরুর চার দিন পর থেকেই বিআরটিএ’র কাছ থেকে আর কোনো বিজ্ঞপ্তি পাওয়া যায়নি। এবার ফিটনেসবিহীন গাড়ি ধরতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এক মাসের মধ্যে অগ্রগতি প্রতিবেদন জানাতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআরটিএ) নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
বর্তমানে নগরীতে ১১ ধরনের যানবাহনের মোট সংখ্যা হচ্ছে ১ লাখ ১৮ হাজার ২৪৬টি। চট্টগ্রাম জেলায় চলাচলকারী বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের সংখ্যা হচ্ছে ৫১ হাজার ৯০টি। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নগরী ও জেলায় মিলে ফিটনেস ছাড়া যানবাহনের সংখ্যা ৩৪ হাজার ৪২৩টি। জেলায় ১৯ ধরনের যানবাহন বিআরটিএ’র রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আছে। তবে জেলার তুলনায় নগরীতে ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা অনেক বেশি। বিআরটিএ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম জেলায় ফিটনেস ছাড়া যানবাহনের সংখ্যা হচ্ছে ৯ হাজার ৩০টি। মেট্রোপলিটন এলাকায় এ ধরনের গাড়ি রয়েছে ২৫ হাজার ৩৯৩টি।
পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর আগে ২০১১ সালেও এ ধরনের অভিযান পরিচালনা করা হয়। ওই সময়েও অভিযানের প্রথম কয়েকদিন গাড়ি চলাচল কমিয়ে রাখে পরিবহন মালিকরা। অভিযান শেষে আবারও রাস্তায় নামে সেসব পুরনো মেয়াদোত্তীর্ণ ফিটনেসবিহীন গাড়ি। তখন ৮০ হাজার ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান ছিল। এবার সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সোয়া ৩ লাখে। ওই ৮০ হাজার গাড়িও বর্তমান তালিকায় রয়েছে। ফিটনেসবিহীন গাড়ির তালিকা করা হয়েছে বিআরটিএ প্রতিষ্ঠার পর রেজিস্ট্রার্ড গাড়ির নবায়ন না করা থেকে। অর্থাৎ যেসব গাড়ি বছর ঘুরে ফি না দিচ্ছে সেগুলোকেই বলা হচ্ছে ফিটনেসবিহীন। এগুলোর একটা বড় অংশ এখন অস্তিত্বহীন। বছর শেষে ফি দিলেই মেলে ফিটনেস সনদ। মোটরযান পরিদর্শকরা গাড়ির মান যাচাই করেন খালি চোখে অনুমান নির্ভর। নেই যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা। আবার গাড়ি না দেখেও সনদ দেয়ার অভিযোগ আছে। তাই ত্রুটিপূর্ণ গাড়িও ফিটনেস সনদ নিয়ে চলছে।
অভিযোগ রয়েছে অভিযান শুরু হলে পরিবহন মালিকরা সরকারের কাছে সময়ের আবেদন করেন। তাঁরা নতুন গাড়ি নামানোর প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর বছরের পর বছর পার হয়, কিন্তু কথা রাখেন না মালিকরা। ফলে আবারও রাজপথে থেকে যায় লক্কড় ঝক্কড় গাড়ি। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ ও বিআরটিএ (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ) কর্মকর্তাদের নিয়মিত মাসোয়ারা দিয়েই ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো হয়। ভুয়া চালকরাও একই কায়দা ব্যবহার করে। অন্যদিকে পরিবহন মালিকরা বলছেন, তীব্র যানজট, ভাঙাচোরা রাস্তা, কম সুদে ব্যাংকঋণ না পাওয়া এবং শুল্ক সুবিধা না পাওয়ায় তাঁরা নতুন গাড়ি নামাতে পারছেন না।
বাস মালিকসমিতি সূত্র জানায়, প্রতিটি গাড়ি আমদানির পর ২০ বছর পর্যন্ত মেয়াদ থাকে। প্রতিবছর সরকারি ফিটনেস সার্টিফিকেট নিতে হয়। ২০ বছর পর গাড়িগুলো চলাচলের অনুমতি না থাকলেও এ গাড়িগুলো রাজধানীর বাইরে বিভিন্ন শহরে চলাচলের জন্য ব্যবহার করা হয়। তাই ঢাকা শহর থেকে ফিটনেসবিহীন গাড়ি তুলে দিতে পারলেও সারাদেশ থেকে তুলে দেয়া সম্ভব নয়।
সড়ক-মহাসড়কে চলছে ফিটনেসবিহীন লক্কড়-ঝক্কড় যানবাহন। সড়কে হঠাৎ বিকল হয়ে যাচ্ছে এসব পুরনো গাড়ি। এতে যানবাহন চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে, তীব্র হচ্ছে যানজট। ব্যস্ত নগরীর সড়কগুলোতে চলছে নিষিদ্ধ ঘোষিত ব্যাটারিচালিত রিকশা ও টমটম। দ্রুতগতির এসব যানবাহন প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে। রোববার সন্ধ্যায় নগরীর চকবাজার ফুলতলায় রাকিব নামে এক শিশুকে চাপা দেয় একটি টমটম। এতে ওই শিশুটি গুরুতর আহত হয়। ক্ষুব্ধ জনতা রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে ওই টমটমসহ দুটি টমটমে আগুন ধরিয়ে দেয়। ভাঙচুর করে আরও ৫টি টমটম। একসময় এসব টমটম শহরতলিতে চলাচল করলেও এখন তা নগরীর বড় বড় সড়কেও উঠে আসছে। বুয়েট অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, সারা বছর যদি নজরদারিটা থাকে তাহলে তারা কিভাবে অবৈধ গাড়ি চালাচ্ছে। শতভাগ ট্রাক কিভাবে রূপান্তর হল এবং কিভাবে তারা রেজিস্ট্রেশন পাচ্ছে। এই জায়গাগুলোতে যদি অভিযান চালানো হয় তাহলে হয়ত প্রক্রিয়াটার মধ্যে একটা সংস্কার হবে। এমন অবস্থায় কার্যকর ও দীর্ঘ মেয়াদী অভিযানের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
এ ব্যাপারে বিআরটিএ চট্টগ্রাম সার্কেল-২ এর সহকারী পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার শহিদুল আযম জানান, ফিটনেসবিহীন গাড়ির ব্যাপারে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কাজ করছি। মন্ত্রী ও হাইকোর্ট এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়ার পর অভিযান চলছে। এতে প্রতিদিনই ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা কমছে স্বাভাবিকভাবেই।
চট্টগ্রাম জেলা ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তা (টিআই, প্রশাসন) মীর গোলাম ফারুক বলেন, চট্টগ্রামে চলাচলকারী কিছু কিছু যানবাহনের কাগজপত্র নেই। ট্রাফিক বিভাগ পরিচালিত বিভিন্ন অভিযানে এর সত্যতা মিলে। ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকা, রেজিঃবিহীন যান, ফিটনেসবিহীন যান,ট্যাক্স টোকেনবিহীন যানসহ মোটরযান আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ট্রাফিক বিভাগ পরিচালিত অভিযানে প্রতিদিন মামলার সংখ্যা বৃদ্ধিই প্রমাণ করে মোটরযান আইন অমান্যকারীর সংখ্যা বাড়ছে।
একই বিষয়ে সিএমপি ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তা (প্রসিকিউশন) মো: মহিউদ্দিন বলেন, মঙ্গলবার থেকে ফিটনেসবিহীন যানের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। এতে কাজ হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অভিযান চললে অন্তত: কিছু গাড়ি হলেও নিজেদের কাগজপত্র সংশোধন করে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭:১৫:৩৪ ২৮৮ বার পঠিত