বঙ্গনিউজ ডটকমঃ জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন, ঠিকানা পরিবর্তন ও হারানো কার্ড পেতে পদে পদে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে নাগরিকদের। অনেকে মাসের পর মাস অপেক্ষা করেও পাচ্ছেন না এ সেবা। ক্লান্ত হয়ে অনেকে দ্বারস্থ হচ্ছেন দালালদের। ১ সেপ্টেম্বর থেকে এ সেবা পেতে টাকা লাগবে জেনে হাজারো নাগরিক হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগে। প্রয়োজনের তুলনায় কম জনবল থাকায় বেসামাল হয়ে পড়েছে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগ। অন্যদিকে অনলাইনে আবেদনের সুযোগ দিলেও কাজে আসছে না এ সেবা। অনেকে অনলাইনে আবেদন করে মাসের পর মাস ঘুরেও এনআইডি কার্ড পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন। জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিদিন হাজারো নাগরিক এসে ভিড় জমাচ্ছেন। কেউ এসেছেন জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের জন্য, কেউ ঠিকানা পরিবর্তানের জন্য, আবার কেউ হারানো কার্ড তোলার জন্য। তবে এসবের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগই এসেছেন কার্ডের ভুল সংশোধনের জন্য। দেশের নাগরিকদের এত বড় সেবা দিতে মাত্র তিন-চারটি ডেস্কের ব্যবস্থা আছে প্রতিষ্ঠানটিতে। এ কারণে সকাল থেকেই দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে সেবা পেতে হচ্ছে নাগরিকদের। এছাড়া জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বড় ধরনের দালালচক্র। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ভবনে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের গেটে ঢোকার আগেই দেখা মিলবে অসংখ্য দালালের। দ্রুত কার্ড পাওয়ার আশ্বাস দিয়ে প্রশাসনের নাকের ডগায় নাগরিকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অঙ্কের অর্থ। এদের সঙ্গে এনআইডির বেশকিছু অসাধু কর্মকর্তাও জড়িত রয়েছেন। সম্প্রতি এমন অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তিনজন আইটি এক্সপার্ট চাকরিও হারিয়েছেন। আরও একডজন কর্মকর্তা নজরদারিতে রয়েছেন বলে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের পরিচালক (অপারেশন) মোঃ মোহসীন আলী জানিয়েছেন।
জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগে গিয়ে দেখা যায়, করিডোরে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছিলেন রিমা খন্দকার নামের এক ভদ্রমহিলা। তার সঙ্গে আলাপে জানা গেল, তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। দুই মাস আগে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) জন্য আবেদন করেছেন। কবে নাগাদ পাওয়া যাবে, সংশ্লিষ্ট কেউ জানেন না। কার্ড না পাওয়ায় আয়কর রিটার্নের জন্য ই-টিআইএন রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করতে পারছেন না তিনি। এভাবে ১ বছর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের মোঃ আবুল কাশেম জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের জন্য নিজ জেলা নির্বাচন অফিসে আবেদন করেছিলেন। এখন পর্যন্ত তিনি কার্ড পাননি। অবশেষে তিনি ঢাকায় এসে কর্মকর্তাদের কাছে ধরনা দিয়েছেন। ধানমন্ডির বাসিন্দা সি্নগ্ধা রহমান নাম সংশোধন করতে দুই মাস এনআইডি অফিসে ঘুরেছেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। অবশেষে দালালের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে সংশোধন করেছেন এনআইডি কার্ড। কার্ড পাওয়ার পর হাজারো হয়রানি সত্ত্বেও মুখে হাসির ঝলক। জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক কষ্ট করে পরিচয়পত্র সংশোধন করলাম। কিছু টাকা লাগলেও কার্ড তো পেয়েছি। অনলাইনে স্থানান্তরের আবেদন করার পর তিন মাসেও কোনো সাড়া না পেয়ে এসেছেন জান্নাতুল ফেরদৌস। পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের এ-গলি ও-গলি ঘুরেও কোনো লাভ হয়নি তার। এভাবে হাজারো নাগরিক প্রতিদিন ভিড় জমাচ্ছেন জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগে। দিনের পর দিন ঘুরেও সংশোধন করতে পারছেন না নিজের জাতীয় পরিচয়পত্র। ১ সেপ্টেম্বর থেকে সংশোধনে অর্থ গুনতে হবে জেনে এ দুর্ভোগের মাত্রা দ্বিগুণ হয়েছে। এদিকে বাধ্যতামূলক করা যাবে না- ইসির এমন নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে সেবা পেতে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এনআইডি। ফলে দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে নাগরিকদের ভোগান্তির তালিকা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নির্বাচন কমিশনের মাঠপর্যায়ের অফিস থেকে এসব কাজ করার নির্দেশ থাকলেও প্রয়োজনীয় জনবল ও যন্ত্রপাতির অভাবে এখনও তা শুরু করা যায়নি। ফলে বাধ্য হয়ে ঢাকামুখী হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এ মুহূর্তে নতুন রেজিস্ট্রেশন করতে সময় লাগে ন্যূনতম দুই মাস, মাইগ্রেশন করতে কমপক্ষে তিন মাস এবং ভুল সংশোধন করতে লেগে যায় কয়েক সপ্তাহ। কার্ড না পাওয়া পর্যন্ত আগতদের ঢাকায় অবস্থান করতে হয় অথবা ঢাকায় যাতায়াত করতে হয় একাধিকবার। এতে সময়, শ্রম ও অর্থের লোকসান হয়।
এসব বিষয়ে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের পরিচালক (অপারেশন) মোঃ মোহসীন আলী বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত আবেদনপত্র পাওয়ার পর দ্রুততার সঙ্গে কাজ করা হয়। তবে তথ্যের সত্যতা যাচাই ও অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া শেষ করতে কিছুটা সময় লাগে। তবে অনলাইনে আবেদনের বিষয়ে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক সুলতানুজ্জামান মোঃ সালেহ উদ্দিন জানান, অনলাইনে আবেদন গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রথম দিকে ভালো সাড়া পেলেও এখন কিছুটা কম আবেদন আসছে। সঠিক সময়ে অনলাইনে আবেদনকারীদের কার্ড দেয়া হচ্ছে না- এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, এটা সত্য নয়। আমরা সঠিক সময়ে সবার পরিচয়পত্র সরবরাহ করছি। তবে মাঝে-মধ্যে যান্ত্রিক সমস্যা হলে একটু সময় লাগে বলেও জানান তিনি।
মানুষের ভোগান্তির বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মোঃ শাহ নেওয়াজ বলেন, সংশ্লিষ্ট জেলায় আবেদন করে সংশোধন বা স্থানান্তরের সুযোগ রয়েছে। সবাই ঢাকামুখী হলে সমস্যা হবে। এছাড়া চলমান হালনাগাদে স্থানীয় জেলা ও উপজেলা নির্বাচন অফিসে এসব কাজ হচ্ছে বলেও জানান তিনি। ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সর্বশেষ ২০১৪ সালে ভোটার তালিকা হালনাগাদে প্রায় ৪৭ লাখ নতুন ভোটার করা হয়। এবার আবার নতুন করে ৭২ লাখ ভোটারের টার্গেট করে ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু এখনও গেল বছরের প্রায় অর্ধ কোটি ভোটারের এনআইডি কার্ড দেয়া হয়নি। তারা সরকারি বা বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সেবা পেতে প্রতিনিয়ত বিড়ম্বনায় পড়ছেন।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আরও জানান, ২০১১ সালের জুলাইয়ে শুরু হয় নাগরিকদের স্মার্টকার্ড প্রদানের প্রকল্প। আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেমস ফর ইনহ্যান্সিং অ্যান্ড অ্যাক্সেস টু সার্ভিস (আইডিয়া) প্রকল্পের আওতায় সব ভোটারকে স্মার্টকার্ড দেয়া হবে। চলতি আগস্টের শেষেই এ কার্ড তৈরি শুরু হবে বলে জানিয়েছে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক সুলতানুজ্জামান মোঃ সালেহ উদ্দিন। এরই মধ্যে এ কার্ডের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশ সময়: ১৬:২৫:৫৫ ৩৬৯ বার পঠিত